মঙ্গলবার ভোরে তেজগাঁও স্টেশনে মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনে নাশকতার আগুনে যে চারজন মারা গেছেন তার মধ্যে ব্যবসায়ী রশিদ ঢালী রয়েছে বলে পরিবার দাবি করেছে।
Published : 19 Dec 2023, 06:52 PM
বিএনপির ডাকা হরতালের ভোরে ঢাকায় মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনে নাশকতার আগুনে নেত্রকোণার ব্যবসায়ী মো. রশিদ ঢালী মারা গেছেন বলে পরিবার দাবি করেছে। সেই পরিবারে চলছে শোকের মাতম। পরিবারের উপার্জনক্ষম মানুষটিকে যারা পুড়িয়ে হত্যা করেছে তাদের বিচার চেয়েছেন স্বজনরা।
মৃত বশির মিয়া ও রাবেয়া আক্তারের ছেলে রশিদ ঢালী (৬৫) বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি নেত্রকোণা পৌর কমিটির সদস্য ছিলেন। শহরের বড় বাজারে তার কাপড়ের দোকান রয়েছে।
রশিদ ঢালী স্ত্রী, দুই ছেলে এনামুল ঢালী ও সামসুল ঢালীকে নিয়ে নাগড়া স্টাফ কোয়ার্টার রোডের নিজের বাসায় বসবাস করতেন।
দুপুরে সেখানে গিয়ে দেখা যায়, মূল রাস্তার পাশে দুই কক্ষের আধা পাকা বাড়ির উঠোনজুড়ে আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশীরা জড়ো হয়েছেন। ঘরের ভেতর নারীরা কান্নাকাটি করছিলেন। সেখানে মানুষের আহাজারিতে পরিবেশ ভারি হয়ে উঠে।
পরিবারের লোকজন জানায়, ব্যবসার কাজে মাঝে মাঝেই ঢাকায় যাতায়াত করতেন রশিদ ঢালী। কোনোদিন কোনো দুর্ঘটনার মুখোমুখি হননি তিনি। সোমবার রাতে নেত্রকোণা বড় স্টেশন থেকে তিনি ঢাকার উদ্দেশে যাত্রা করেন। পরিবার এ নিয়ে কোনো চিন্তাও করেনি। মূলত কাপড় কিনতেই তিনি ঢাকায় গিয়েছিলেন।
রশিদ ঢালীর ছেলে মো. মামুন ঢালী বাড়ির উঠানে চিৎকার করে কেঁদে কেঁদে বলছিলেন, “আমার বাবা ব্যবসার কাজে ঢাকা গেছিল ট্রেইনে। বাবা, জীবনের লাইগ্যা গেছে গা। আর আইব না।”
তিনি বলছিলেন, “ভোরে দুর্ঘটনার খবর পেয়ে আব্বারে ফোন দিতাছি। আব্বা তো ওই ট্রেইনে আছিল। তারে পাইতাছি না। পরে আমরার মহাজনদের ফোন দিছি তারাও আব্বারে পাইতাছে না। তখন ঢাকায় আমার এক চাচাত ভাই থাকে তারে ফোন দিছি। সেই ভাই ঢাকা মেডিকেলে গিয়া লাশ পাইছে।”
মঙ্গলবার ভোর ৫টার দিকে তেজগাঁও স্টেশনে মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনে নাশকতার আগুনে চারজন দগ্ধ হয়ে মারা যান। এ ঘটনায় পুড়ে গেছে ট্রেনটির তিনটি বগি।
নিরাপদ ভেবে ট্রেনে গেছিল পপি, হেইখানে মরল: আক্ষেপ বাবার
সন্তানকে বুকে জড়িয়ে পুড়ে অঙ্গার পপি, মর্গেও একসঙ্গে
ঢাকায় মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসে নাশকতার আগুন, মা-শিশুসহ নিহত ৪
বিএনপির কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তে নাশকতা, ট্রেনে আগুন: ডিএমপি কমিশনার
রেলে নাশকতা: নির্দোষ আসলামকে কেন মরতে হল, প্রশ্ন স্ত্রীর
নিহতদের মধ্যে তিনজনের বাড়ি নেত্রকোণায়। তারা হলেন- নেত্রকোণা সদর উপজেলার দক্ষিণ বিশিউড়া ইউনিয়নের বরুনা গ্রামের মিজানুর রহমানের স্ত্রী নাদিরা আক্তার পপি (৩৫) ও তার তিন বছরের ছেলে ইয়াসিন রহমান পিয়াস।
তবে বিএনপি নেতা রশিদ ঢালীর লাশ পরিবার শনাক্ত করলে তাদের কাছে হস্তান্তর করা হবে বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ। অন্য লাশটির পরিচয় এখনও শনাক্ত হয়নি।
রশিদ ঢালীর পরিবার জানিয়েছে, ঢাকা থেকে মরদেহ আনতে লোকজন গিয়েছে। মরদেহ আসার পর জানাজা শেষে পৌর কবরস্থানে দাফন করা হবে।
তবে এ ব্যাপারে রেলওয়ে পুলিশের কমলাপুর থানার এসআই সেতাফুর রহমান বিকালে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দুটি মরদেহ এখনও শনাক্ত হয়নি। শনাক্ত করার পর বুধবার সকালে মরদেহ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হবে।”
মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসে নাশকতা এই প্রথম নয়। এর আগে ১৩ ডিসেম্বর এই ট্রেনে নাশকতায় একজন নিহত এবং বেশ কয়েকজন আহত হয়।
সেদিন গাজীপুরের ভাওয়াল ও রাজেন্দ্রপুর রেলওয়ে স্টেশনের মধ্যবর্তী বনখড়িয়া এলাকায় রেললাইন কেটে ফেলায় ভোর ৪টার দিকে নেত্রকোণার মোহনগঞ্জ থেকে ঢাকার কমলাপুরগামী মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসের ইঞ্জিনসহ সাতটি বগি লাইনচ্যুত হয়। এতে ট্রেনযাত্রী আসলাম মিয়া নিহত ও লোকো মাস্টারসহ বেশ কয়েকজন গুরুতর আহত হন।
এর আগে গত ২৩ নভেম্বর রাতে বিএনপির অবরোধের মধ্যে নেত্রকোণা-ময়মনসিংহ রেলপথের নেত্রকোণা সদর উপজেলার রাজেন্দ্রপুর এলাকার মগড়া নদীর ওপর কমলগঞ্জ রেলসেতুর স্লিপারে আগুন দিয়ে পালিয়ে যায়।
পরে স্থানীয়রা এসে সেই আগুন নিভিয়ে ফেলায় কোনো দুর্ঘটনা ঘটেনি। ঢাকা-মোহনগঞ্জ পথে চলাচলকারী মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস সেই পথ দিয়েই চলাচল করে।
কাজের সুবিধার জন্য মোহনগঞ্জ ও নেত্রকোণা থেকে প্রচুর যাত্রী এই ট্রেনে যাতায়াত করেন। রাতে উঠে তারা সকালে ঢাকায় পৌঁছে সারাদিন কাজ করে আবার রাতেই ফিরে যেতে পারেন।
রশিদ ঢালীও এভাবেই যাতায়াত করতেন বলে জানান তার ভাগ্নে হানিফ খান। তিনি বলেন, “মামা ভালা মানুষ আছিল। আমরার অভিবাবক আছিল। মামা গেলোগা । আমরা এতিম অইয়া গেলাম। আমরা মামার মৃত্যুর বিচার চাই।”
প্রতিবেশী কয়েকজনের সঙ্গে কথা হলে তারা জানান, রশিদ ঢালীর সঙ্গে তাদের সম্পর্ক ভাল ছিল। খুবই সাধারণ পরিবার। কোনোদিন কারও সঙ্গে ঝাগড়া-ঝাটি হয়নি।
এক প্রতিবেশী বলেন, “কেউ মারা গেলে রশিদ ভাই আগে ছুইট্যা যাইতেন গোর খোদার জন্য। তিনি সবার আগে কোদাল দিয়ে কোপ দিতেন। এখন আমাদের তার জন্য গোর খোদতে হবে। এমন একজন ভাল মানুষকে এভাবে জীবন দিতে হল, এটা মেনে নেওয়া যায় না।”
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক বজলুর রহমান পাঠান বলেন, “রশিদ ঢালী পৌর বিএনপির সদস্য ছিলেন। তিনি খুব ভাল মানুষ ছিলেন। তার এমন মৃত্যু মেনে নেওয়া যায় না।”
এদিকে স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিহতদের পরিবারকে আর্থিক সহায়তা দেওয়ার কথা জানিয়েছেন সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তানিয়া তাবাসসুম।
তিনি বলেন, “নিহতের স্বজনদের সঙ্গে ঘটনার পর থেকেই আমরা যোগাযোগ রাখছি। মরদেহ এলাকায় আসার পর সেখানে যাব।
“নিহতদের পরিবারদের প্রাথমিকভাবে ২০ হাজার টাকা করে আর্থিক সহযোগিতা দেওয়া হচ্ছে। পরে পরিবারের পক্ষ থেকে আবেদন করলে সে অনুযায়ী সহযোগিতা দেওয়া হবে”, বলেন ইউএনও।