কুমিল্লা অঞ্চলে সড়ক-মহাসড়কে দুর্ঘটনার যত কারণ

কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের কয়েকটি স্থানে দেখা গেছে, ইউটার্নে রিফ্লেক্টিভ স্টিকার নেই; এতে রাতে এসব স্থানে দুর্ঘটনা বেশি ঘটছে।

আবদুর রহমানকুমিল্লা প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 Jan 2023, 03:58 AM
Updated : 27 Jan 2023, 03:58 AM

কুমিল্লা অঞ্চলের হাইওয়ে পুলিশের অধীন আট জেলায় থাকা ৭৮০ কিলোমিটার মহাসড়ক ও আঞ্চলিক মহাসড়কে দুর্ঘটনার বেশ কয়েকটি কারণ অনুসন্ধানে উঠে এসেছে। 

এই মহাসড়ক ও আঞ্চলিক মহাসড়ক তদারকির দায়িত্বে থাকা এই হাইওয়ে পুলিশের প্রধান কার্যালয় কুমিল্লা নগরীর হাউজিং এলাকায়। 

কার্যালয়টির অধীনে রয়েছে ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক, কুমিল্লা-নোয়াখালী ও কুমিল্লা-চাঁদপুর আঞ্চলিক মহাসড়ক এবং কুমিল্লা-সিলেট আঞ্চলিক মহাসড়কের হবিগঞ্জ পর্যন্ত। 

এই কার্যালয়ের তথ্যমতে, ২০২১ ও ২০২২ এই দুই বছরে ৭৮০ কিলোমিটার মহাসড়ক ও আঞ্চলিক মহাসড়কে দুর্ঘটনায় অন্তত ৮০০ জনের প্রাণহানি হয়েছে; আহত হয়েছে কয়েকশ। 

এ সব দুর্ঘটনার বেশ কয়েকটি কারণ চিহ্নিত করা গেলেও সেগুলো সমাধানে তেমন কোনো উদ্যোগ নেই বলে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সরেজমিন অনুসন্ধানসহ ভুক্তভোগী ও পুলিশের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে।  

হাইওয়ে পুলিশের কর্মকর্তারা বলছেন, এসব দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির অন্তত দশটি কারণ খুঁজে পেয়েছেন তারা। এগুলো সমাধানে উদ্যোগ নেওয়া এবং পথচারী, সাধারণ মানুষ ও চালকদের সতর্ক করা গেলে দুর্ঘটনার হার অনেক কমে যাবে। হাইওয়ে পুলিশও এসব সমস্যা সমাধানে কাজ করছে। 

বিপদজনক ইউটার্ন, সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও মোটরসাইকেলসহ কম গতির ছোট যানবাহনের জন্য আলাদা লেন না থাকা, পাঁচ শতাধিক ফিডার রোড (গ্রামীণ সংযোগ সড়ক), মহাসড়ক লাগোয়া বাজারসহ বিভিন্ন স্থাপনা এবং মানুষের ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহারে কম আগ্রহের কারণে ৭০ শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটছে বলে সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য। 

হাইওয়ে পুলিশের কুমিল্লা অঞ্চলের প্রধান কার্যালয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০২১ সালে এই কার্যালয়ের অধীনে থাকা মহাসড়ক ও আঞ্চলিক মহাসড়কে ৪৪১ দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছিলেন ৪৪৪ জন। ২০২২ সালে ৩২৭ দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৩৪৭ জন। ২০২২ সালে নিহতদের মধ্যে ১৩০ জন ছিলেন পথচারী। 

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ৭৮০ কিলোমিটার সড়কের মধ্যে রয়েছে ৫৪টি বিপদজনক ইউটার্ন, ৫২৭টি ফিডার রোড, সিএনজি স্টেশন রয়েছে ১০৪টি, মহাসড়ক সংলগ্ন বৈধ ইজারা দেওয়া হাট-বাজার ২২টি, গার্মেন্টস ও শিল্পকারখানা ৭০টি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ৯২টি, হাসপাতাল-ক্লিনিক ১৯টি, বাস স্ট্যান্ড ৭১টি এবং ফুটওভার ব্রিজ ৩৪টি। 

ব্যস্ততম মহাসড়ক ও আঞ্চলিক সড়ক দিয়ে মোটরসাইকেলসহ ছোট যাবাহনে কম দুরত্বে যাতায়াতে শিক্ষার্থী, শ্রমিক, রোগী পরিবহন, পথচারী চলাচল এবং সিএনজি অটোরিকশায় গ্যাস নিতে মহাসড়কে আসা – প্রভৃতি কারণে এসব প্রাণহানি ঘটছে। 

গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ফুটওভার ব্রিজ থাকলেও তা ব্যবহারের প্রবণতা কম। এসব কারণেই অধিকাংশ দুর্ঘটনা ঘটছে। কিছু দুর্ঘটনা ঘটেছে অদক্ষ চালক, ফিটনেসবিহীন যানবাহন চলাচল ও রাস্তায় যত্রতত্র যাত্রী ওঠা-নামার জন্য। এ ছাড়া রয়েছে যত্রতত্র ইউটার্ন আর ফিডার রোডের মাথার দুর্ঘটনা। 

হাইওয়ে পুলিশের কুমিল্লা অঞ্চলের প্রধান কার্যালয় থেকে আরও জানা গেছে, ২০২২ সালে কুমিল্লা জেলায় ১৪২ দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ১৫১ জন। আর ২০২১ সালে ১৮১ দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ১৮৬ জন। ২০২১ সালে কুমিল্লায় ১৭ সিএনজি অটোরিকশা দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ২৬ জন এবং ২০২২ সালে ১১ দুর্ঘটনায় নিহত হন ১৪ জন। গত বছর ৭০টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ৭৮ জন। 

তবে ফুটওভার ব্রিজ নিয়ে যাত্রীদের ভিন্নমতও রয়েছে।

আবদুল্লাহ আল সুমন নামে কুমিল্লা সদরের এক বাসিন্দা বলেন, “যাতায়াতের সময় প্রায় দেখি অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ফুটওভার ব্রিজ নেই। ব্যস্ততম অনেক এলাকায় ফুটওভার ব্রিজ না থাকায় ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা পারাপারে ঘটছে দুর্ঘটনা। আবার অনেক স্থানে দেখা গেছে খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয় কিন্তু সেখানে ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণ করা হয়েছে।” 

সম্প্রতি ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার বাবুর্চি বাজারসহ কয়েকটি স্থানে গিয়ে দেখা গেছে, ইউটার্নে রিফ্লেক্টিভ স্টিকার নেই। এতে রাতের বেলায় এসব স্থানে দুর্ঘটনা বেশি ঘটছে। এসব ইউটার্নে দুর্ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় স্থানীয়রা লাল নিশান টানিয়ে দিয়েছেন।

এ প্রসঙ্গে সড়ক ও জনপথ (সওজ) এর কুমিল্লার নির্বাহী প্রকৌশলী সুনীত চাকমা বলেন, “মহাসড়কের বিভিন্ন স্থানে ইউটার্নগুলোতে রিফ্লেক্টিভ স্টিকার ভেঙে যাওয়ায় লোকজন সেগুলো নিয়ে গেছে। বর্তমানে মহাসড়কের বিভিন্ন অংশে মেরামতের কাজ চলছে। কাজ শেষ হলে শিগগিরই নতুন সাইন স্থাপন করা হবে। আমরা এসব বিষয়ে নজর রাখছি।” 

মাঠ পর্যায়ে কর্মরত অন্তত ৫ জন হাইওয়ে পুলিশের সদস্য জানান, নিত্য প্রয়োজনে মহাসড়কের আশপাশ এলাকার মানুষদের কম দূরত্বের চলাচলে একমাত্র উপায় সিএনজি ও ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা, মোটরসাইকেলসহ কিছু ছোট যানবাহন। আলাদা লেন না থাকায় দ্রুত গতির যাবাহনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এগুলোকে চলাচল করতে গিয়ে প্রায়ই দুর্ঘটনার কবলে পড়তে হয়। সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে হলে এসব যানের জন্য আলাদা লেন তৈরির বিষয়টি সংশ্লিষ্টদের এখন থেকেই ভাবতে হবে। 

কুমিল্লা বাস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. তাজুল ইসলাম বলেন, সড়ক-মহাসড়কে ছোট যানবাহন চলাচল নিষিদ্ধ কিংবা এদের জন্য আলাদা লেন করার দাবি দীর্ঘদিনের। জাতীয়ভাবে এসব সমস্যাগুলো সরকারের নজরে আনা হলেও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। এছাড়া বিপদজনক ইউটার্ন ও সংযোগ সড়কড়গুলো থেকে হঠাৎ করে ছোট যানগুলো সামনে চলে আসায় দুর্ঘটনা বেশি ঘটছে।

বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে হাইওয়ে পুলিশের কুমিল্লা অঞ্চলের সুপারিনটেনডেন্ট মুহাম্মদ রহমত উল্লাহ বলেন, মহাসড়কে দ্রুতগতির বাস, ট্রাক, কভার্ডভ্যান ও প্রাইভেটকারের সঙ্গে একই লেনে চলে মোটরসাইকেলসহ কম গতির যানবাহন। এর মূল কারণ হচ্ছে মহাসড়ক সংলগ্ন বসবাসকারীদের কম দূরত্বে যাতায়াতে এসব ছোট যানবাহনই ব্যবহার করতে হয়। 

“তাই ছোট যানবাহনের জন্য আলাদা লেন তৈরি করা হলে দুর্ঘটনা অনেকাংশেই কমিয়ে আনা সম্ভব।” 

তিনি আরও বলেন, “অনেক সময় দেখা যায় ফিডার রোড থেকে একটা ছোট গাড়ি হঠাৎ বড় গাড়ির সামনে চলে এসে এবং এতে দুর্ঘটনা ঘটে। আমরা মহাসড়কে দুর্ঘটনা প্রতিরোধে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছি। ফিডার রোডগুলোর মাথায় সচেতনতামূলক সাইবোর্ড টানানোসহ মানুষকে সতর্ক করতে লিফলেট বিতরণ করেছি।” 

এই কার্যক্রম অব্যাহত থাকার পাশাপাশি চালকদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার কাজও চলমান রয়েছে; শুধু গত বছরই ১৫ হাজার চালককে ট্রাফিক বিষয়ের উপর প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে বলে তিনি জানান। 

পুলিশ সুপার মুহাম্মদ রহমত উল্লাহ বলেন, “মহাসড়কে দুর্ঘটনার হার কমাতে আমরা অধিক গতির যানবাহনের বিরুদ্ধে মামলা দিচ্ছি নিয়মিত। গেল বছরে চার হাজারের অধিক যানবাহনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়াসহ ১৭ হাজার যানবাহনের চালককে সতর্ক করা হয়েছে।” 

তিনি জানান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ চালক-হেলপারদের মাঝে সচেনতামূলক লিফলেট বিতরণ করা হয়েছে প্রায় ৪ লাখ। গত বছর নিয়ম অমান্য করায় ১৪ হাজার ৪৩০টি সিএনজি চালিত অটোরিকশাসহ অন্যান্য নিষিদ্ধ যানবাহন আটক করা হয়েছে।