Published : 14 Oct 2023, 09:11 AM
দুই বছর আগে শারদীয় দুর্গোৎসব চলাকালে কুমিল্লার কয়েকটি মন্দিরে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় ১২টি মামলার কোনোটির বিচার শেষ হয়নি। গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে একজন ছাড়া বাকি সব আসামিই জামিনে রয়েছেন।
পুলিশ বলছে, প্রতিটি মামলার অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে; বিচারকাজ চলছে। অপরদিকে দ্রুত দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়ে পূজা উদযাপন পরিষদের নেতারা বলছেন, বিচারহীনতা নতুন অপরাধ করতে অপরাধীদের উৎসাহিত করে।
২০২১ সালের ১৩ অক্টোবর ভোরে কুমিল্লা নগরীর নানুয়াদিঘির পাড়ে দর্পণ সংঘের অস্থায়ী পূজামণ্ডপে হনুমানের মূর্তির কোলে কোরআন শরিফ দেখে এলাকায় উত্তেজনা ছড়ায়।
একে কেন্দ্র করে ওইদিন নগরীর চারটি মন্দির ও সাতটি পূজামণ্ডপে হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। এ ছাড়া সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে। নগরীর ঠাকুরপাড়া এলাকায় রক্ষাকালী মন্দির, কাপড়িয়াপট্টি শ্রীশ্রী চান্দমনি রক্ষাকালী মন্দির, মনোহরপুর এলাকার রাজ রাজেশ্বরী কালীবাড়ি মন্দিরের বেশি সহিংসতা হয়েছিল সেদিন।
রাজেশ্বরী কালীবাড়ি মন্দিরে সহিংসতার সময় ইটের আঘাতে আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় দিলীপ কুমার দাস নামে একজন মারা যান। এ অবস্থায় চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, চাঁদপুর, কক্সবাজার, ফেনী, রংপুরসহ বিভিন্ন অঞ্চলে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে।
এ ঘটনায় মোট ১২টি মামলা হয় কুমিল্লা কোতোয়ালিসহ বিভিন্ন থানায়। এর মধ্যে ছয়টি মামলার তদন্তের দায়িত্ব পায় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ-সিআইডি; পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন-পিবিআই চারটি এবং কোতোয়ালি মডেল থানা দুটি মামলার তদন্ত করে।
মণ্ডপে কোরআন শরিফ রাখার মামলায় কুমিল্লা নগরীর ১৭ নম্বর ওয়ার্ডের দ্বিতীয় মুরাদপুর-লস্করপুকুর এলাকার বাসিন্দা ইকবাল হোসেনকে প্রধান আসামি করা হয়।
সিআইডির কুমিল্লা কার্যালয় জানায়, পূজামণ্ডপে কোরআন শরিফ রাখার ঘটনায় হোতা ইকবাল হোসেন ছাড়াও ওই মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছিলেন মণ্ডপে কোরআন দেখে জরুরি সরকারি সেবা ৯৯৯ খবর দেওয়া নগরীর মৌলভীপাড়ার ইকরাম হোসেন ওরফে রেজাউল হক, পাশের দারোগাবাড়ির মাজারের সহকারী খাদেম নগরীর উত্তর চর্থা এলাকার বাসিন্দা আশিকুর রহমান ফয়সাল, তার সঙ্গী মো. হুমায়ূন কবির এবং কুমিল্লা সিটির সাবেক মেয়র মনিরুল হক সাক্কুর ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবে পরিচিত মহিউদ্দিন আহমেদ বাবু।
এ মামলায় আদালতে দেওয়া অভিযোগপত্রে ইকবালসহ এই পাঁচজনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। তবে ইকবাল ছাড়া বাকি আসামিরা জামিনে আছেন।
ইকবালের মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির কুমিল্লার পরিদর্শক মো. নুরুল হাকিম বলেন, মূল মামলাটিতে ইকবালসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে চলতি বছরের মার্চ মাসে।
নুরুল হাকিম বলেন, “এ মামলায় আদালতে মোট দুটি অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে মণ্ডপে পবিত্র কোরআন রাখার ঘটনায় একটি; অন্যটি সন্ত্রাস দমন আইনে। প্রতিটি মামলাই এখন আদালতে বিচারাধীন।”
সিআইডির তদন্ত শেষে আদালতে দেওয়া ছয়টি মামলার অভিযোগপত্রে মোট ১০৯ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে।
কুমিল্লার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) খন্দকার আশফাকুজ্জামান বলেন, “কুমিল্লার পূজামণ্ডপে কোরআন শরিফ রাখা ও সহিংসতার ঘটনায় জেলার বিভিন্ন থানায় মোট ১২টি মামলা হয়।
“এসব মামলার মধ্যে জেলা পুলিশ ও পিবিআই যেগুলোর তদন্ত করেছে- তার সবগুলোর অভিযোগপত্র আদালতে দাখিল করা হয়েছে। সিআইডি সবগুলো মামলার অভিযোগপত্র দিলে কুমিল্লায় এখন আর কোনো মামলা তদন্তাধীন নেই। বর্তমানে সবগুলো মামলা বিচারাধীন পর্যায়ে রয়েছে।”
কুমিল্লার ইতিহাসবিদ ও গবেষক আহসানুল কবীর বলেন, “কুমিল্লা ঐতিহ্যগতভাবেই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির নগরী। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময়ও কুমিল্লায় কোনো মন্দির বা মণ্ডপে হামলার ঘটনা ঘটেনি। ২০২১ সালের ওই ঘটনাটি কুমিল্লার ইতিহাসের সঙ্গে একেবারেই বেমানান। আর ওই ঘটনাটিকে দিয়ে কুমিল্লার সম্প্রীতির বন্ধন ভেঙে ফেলারও সুযোগ নেই।
“কুমিল্লায় মুসলমানদের সঙ্গে হিন্দুসহ অন্যান্য ধর্মের মানুষের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বন্ধনের বয়সও প্রায় আড়াইশ বছরের পুরনো। কুমিল্লার শত শত বছরের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এই বন্ধন অতীতের মতই ভবিষ্যতেও অটুট থাকবে বলে আমি বিশ্বাস করি।
আহসানুল কবীর বলেন, “এজন্য ২০২১ সালের ওই ঘটনায় হওয়া প্রতিটি মামলার সঠিক বিচার হতে হবে। তাহলেই ভবিষ্যতে এমন ঘটনা আর ঘটবে না।”
বাংলাদেশ পূজা উদ্যাপন পরিষদের কুমিল্লা মহানগর কমিটির সাধারণ সম্পাদক অচিন্ত্য দাশ টিটু বলেন, “বিচারহীনতা নতুন নতুন অপরাধ সৃষ্টি করতে অপরাধীদের উৎসাহিত করে। আমার বিশ্বাস, সঠিক বিচার হলে দেশে এমন ঘটনা অনেকাংশেই কমে যাবে। তাই প্রতিটি মামলার সঠিক বিচারের দাবি জানাচ্ছি এবং বিচার প্রক্রিয়া শেষ করতে হবে দ্রুত সময়ের মধ্যে।
তিনি আরও বলেন, “ঘটনার দুই বছর হলেও এখনও একটি মামলার বিচার কাজ শেষ হয়নি। আমরা এখন প্রতিটি ঘটনার সুষ্ঠু বিচারের অপেক্ষায় আছি। আর প্রত্যাশা থাকবে আদালতে দোষিদের উপযুক্ত শাস্তি হবে।”
তিনি আরও বলেন, “শারদীয় দুর্গোৎসব আসন্ন। শঙ্কা আর আতঙ্ক থাকলেও গত বছর শেষ পর্যন্ত কুমিল্লার প্রতিটি পূজামণ্ডপে জাঁকজমকপূর্ণ উৎসব হয়েছে। এবারও উৎসবে মেতে উঠতে চান তারা। এজন্য সব প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে।”
আরও পড়ুন:
কুমিল্লায় মণ্ডপ থেকে খোয়া যাওয়া ‘হনুমানের গদা’টি উদ্ধার
কুমিল্লার ঘটনায় দলের কেউ থাকলে তাকেও ছাড় নয়: ধর্মপ্রতিমন্ত্রী