দৃষ্টিহীন মেহেদীর স্বপ্নপূরণে দারিদ্র্যও বাধা

ঢাকা বোর্ড থেকে এসএসসি পরীক্ষায় প্রাপ্ত নম্বরের হিসাবে মেহেদী নবম স্থানে রয়েছেন বলে জানান।

আহসান হাবীব নীলু, কুড়িগ্রাম প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 10 Feb 2023, 03:36 AM
Updated : 10 Feb 2023, 03:36 AM

দুই চোখের দৃষ্টি না থাকলেও মাধ্যমিকে তাক লাগানো ফল করেছেন কুড়িগ্রামের মেহেদি হাসান।

বর্তমানে ঢাকা কলেজে উচ্চ মাধ্যমিকে মানবিক বিভাগে পড়াশোনা করছেন। তার স্বপ্ন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন নিয়ে লেখাপড়া শেষ করে বিদেশ থেকে উচ্চশিক্ষা নেওয়া। ব্যরিস্টার হওয়ার স্বপ্ন দেখেন তিনি।

কিন্তু তার এই স্বপ্নপূরণে প্রধান প্রতিবন্ধকতা হলো দারিদ্র্য।

মেহেদী হাসান জানান, ঢাকা বোর্ড থেকে এসএসসি পরীক্ষায় প্রাপ্ত নম্বরের হিসাবে তিনি নবম স্থানে রয়েছেন।

তার এক বোনও প্রতিবন্ধী। এই বোনের প্রতিবন্ধী ভাতায় চলে তাদের অনটনের সংসার। অসুস্থ ট্রাকচালক বাবা এখন গাড়ি চালাতে পারেন না।

পরিবারে চরম দারিদ্র্র্য থাকলেও প্রবল আত্মসম্মান বোধের কারণে তিনি প্রতিবন্ধী ভাতা গ্রহণ করেন না।

কুড়িগ্রাম সদরের ভোগডাঙ্গা ইউনিয়নের কাজিপাড়ার বাসিন্দা ট্রাকচালক আক্কাছ আলী-মল্লিকা বেগম দম্পতির ছেলে মেহেদি হাসান।

দরিদ্র এই পরিবারে ছয় সন্তানের মধ্যে মেহেদি হাসান সব ছোট। ভাই-বোনদের মধ্যে তিন বোনের বিয়ে হয়েছে; এক বোন জন্ম থেকে প্রতিবন্ধী।

বয়সের ভার আর শারীরিক নানা সমস্যার কারণে এখন ট্রাক চালাতে পারেন না আক্কাছ আলী। আবাদ উপযোগী কোনো জমিজমা নেই; রয়েছে শুধু ছয় শতক বাড়িভিটে।

মেহেদির বড় বোন ইভি খাতুন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, মেহেদি জন্মান্ধ না। তার ৭/৮ বছর বয়সে ডান চোখে সমস্যা দেখা দেয়। পরে উলিপুর উপজেলার মরিয়ম চক্ষু হাসপাতালে দেখানো হয়। সেখানের চিকিৎসকরা সিরাজগঞ্জ চক্ষু হাসপাতালে নেওয়ার পরামর্শ দেন। সেখানে গেলে চিকিৎসকরা অপারেশন করেন; কিন্তু বছর ঘুরতে না ঘুরতে মেহেদির বাম চোখে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে। দুচোখে আস্তে আস্তে সংক্রমণ হয়ে ২০১২ সালে অন্ধ হয়ে যান মেহেদি।

ইভি খাতুন আরও জানান, ঢাকা চক্ষু হাসপাতালের চিকিৎসকরা মেহেদীকে ভারতের চেন্নাই নিয়ে যেতে বলেছেন। সেখানে প্রায় ২৫ লাখ টাকার মতো খরচ করে চিকিৎসা করা গেলে মেহেদি দেখতে পাবেন বলে চিকিৎসকদের ধারণা।  

মেহেদি হাসান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ২০২১ সালে তিনি ঢাকার খিলখেত এলাকার জানে আলম সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে জিপিএ-৫ পেয়ে এসএসসি পাশ করেন। এসএসসিতে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তিসহ ঢাকা বোর্ডে ৯ম স্থান লাভ করেন। এখন উচ্চমাধ্যমিকে পড়ছেন ঢাকা কলেজে। থাকেন আন্তর্জাতিক ছাত্রাবাসের ৩২১ নম্বর কক্ষে। চলতি বছর এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নেবেন। মিরপুর দৃষ্টি প্রতিবন্ধী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে জিপিএ-৪.৫৮ এবং জেএসসিতে সব বিষয়ে এ প্লাস পেয়েছিলেন তিনি।

অসাধারণ মেধাবী এই শিক্ষার্থী অর্থাভাবে আর যথাযথ অডিও বই না পাওয়ায় এইচএসসি পরীক্ষায় ভালো করার ব্যাপারে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন।

পরীক্ষার সময় সূচি ঘোষণা হলেও তার কলেজের মেহেদির মতো আরও ৫ জন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন বই হাতে আসেনি বলে মেহেদী জানান। শ্রেণিকক্ষেও পড়তে হয় বিড়ম্বনায়। শিক্ষকরা পাঠদানের সময় ব্ল্যাক বোর্ডে লিখে দিলেও সেগুলো খাতায় তোলা হয় না শ্রুতি লেখকের অভাবে। প্রাইভেট শিক্ষকের কাছে পড়তে পারছেন না।

মেহেদী বলেন, সরকারি এবং দাতা সংস্থার মাধ্যমে যে বইগুলো ভিউ ফাউন্ডেশন এবং ইফশা সংগঠনের মাধ্যমে দেওয়া হয় সেগুলো পুরাতন। নতুন বই দেওয়ার নিয়ম থাকলেও সংগঠন দুটি সেগুলো মানছে না।

প্রায় ৪ মাস আগে প্রতিবন্ধী ভাতার ব্যবস্থা হলেও আত্মসম্মান বোধ থেকে সেই ভাতা নেন না জানিয়ে মেহেদি বলেন, তবে তিনি শিক্ষা ভাতার জন্য আবেদন করেছেন আজিমপুর সমাজসেবা অফিসে।

মেহেদির বাবা আক্কাছ আলী বলেন, “বাড়ি ভিটেটুকু ছাড়া আমার আর কোনো সম্পদ নেই। ছেলে পড়াশোনা করছে ঢাকাতে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বাজারে মেয়ের প্রতিবন্ধী ভাতা দিয়ে কোনোমতে খেয়ে না খেয়ে দিন পার করতে হচ্ছে।

“চিকিৎসকরা বলেছেন মেহেদিকে ভালো করা যাবে চেন্নাইতে নিয়ে গেলে। এজন্য ২২-২৫ লাখ টাকা খরচ হবে। যেখানে নুন আনতে পানতা ফুরায় সেখানে কীভাবে ছেলের চিকিৎসার স্বপ্ন দেখি।”

মা মল্লিকা বেগম কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, সংসারে দুটি প্রতিবন্ধী সন্তান আছে। এর মধ্যে মেহেদি ভালোই ছিল ৭/৮ বছর বয়স পর্যন্ত। কিন্তু একটি চোখে সমস্যা হওয়ার পর ‘ভুল’ চিকিৎসায় ছেলেটার দুই চোখ অন্ধ। চিকিৎসক বলছে মেহেদিকে ভালো করা যাবে টাকা-পয়সা খরচ করলে। সরকার বা সমাজের বিত্তবানরা যদি একটু এগিয়ে আসে তাহলে আল্লাহ চাইলে মেহেদি আবারও দেখতে পাবে।

ঢাকা কলেজের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক নাসরিন আক্তার বলেন, মেহেদি হাসান জন্মান্ধ নয়। চিকিৎসাজনিত কারণে অল্প বয়সে তাকে অন্ধত্ব বরণ করতে হয়েছে। মেধাবী শিক্ষার্থী হলেও শ্রুতিলেখক এবং বই সংকটের কারণে তার পড়াশোনা বিঘ্নিত হচ্ছে। এছাড়াও মেহেদির পরিবারে অর্থনৈতিক অস্বচ্ছলতার কারণে ঠিকমতো মেহেদি প্রাইভেট পড়া ও শ্রুতি লেখকের টাকা দিতে পারে না। ফলে আসন্ন এইচএসসি পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করা নিয়ে সংশয়ে রয়েছে মেহেদি হাসান।