চার জেলায় বিস্তৃত ছায়ার হাওরের বেশিরভাগ পড়েছে সুনামগঞ্জের শাল্লায়; সেখানে প্রায় ৮ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো চাষ হয়েছে।
Published : 05 Feb 2024, 09:24 AM
সুনামগঞ্জে ছায়ার হাওরের দিরাই-শাল্লা পুরনো সড়ক কেটে দুটি সেতু নির্মাণ করা হচ্ছে। সেতুর পাশে যে বিকল্প রাস্তা করা হয়েছে সেটি কম উচ্চতার। সামান্য পানির চাপেই সেটি ধসে হাওরে পানি প্রবেশ করে ফসল ভাসিয়ে নেবে বলে আশঙ্কা করছেন কৃষকরা।
শাল্লা উপজেলার সুখলাইন গ্রামের কৃষক অপু চন্দ্র দাস ও বিধান চৌধুরী বলেন, তাদের গ্রামের পাশ দিয়ে ফসলরক্ষা বাঁধের যে রাস্তাটি গেছে তার একপাশে দাঁড়াইন নদী আর অপরপাশে ছায়ার হাওর।
সুখলাইন গ্রামের পাশে ২৭ মিটারের একটি সেতু নির্মাণ করছে সড়ক বিভাগ। এই সেতু থেকে ১০০ মিটার দূরেই দাঁড়াইন নদী।
একই সড়কের বাহাড়া ইউনিয়নের নোয়াগাঁও গিরিধর উচ্চ বিদ্যালয়ের পশ্চিম দিকে আরেকটি সেতুর নির্মাণ কাজ চলছে।
দুটি জায়গাতেই ফসলরক্ষা বাঁধের মাটি কেটে এসব সেতু নির্মাণ করা হচ্ছে। এর পাশে যে বিকল্প চলাচলের রাস্তা রাখা হয়েছে সেগুলো ফসলরক্ষা বাঁধ থেকে প্রায় দুই ফুট নীচু এবং কাঁচা ও নরম।
হাওরে ফসলরক্ষা বাঁধের অন্যান্য জায়গায় সংস্কারের জন্য প্রকল্প নেওয়া হলেও; এ দুটি স্থানে বাঁধ রক্ষার কোনো প্রকল্প নেওয়া হয়নি। ফলে এ দুটি জায়গা ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। দুই নির্মাণাধীন সেতুর জন্য মাটি তুলে ফেলায় খালের মতো হয়ে গেছে সড়কটি।
বর্ষায় ফসল উঠার আগে আগাম পানির ঢল এলে যে কোনো সময় এ জায়গা দুটি ধসে হাওরে প্রবেশ করবে বলে আশঙ্কা রয়েছে কৃষকদের। তারা বলছেন, বৃষ্টিপাত ও পাহাড়ি ঢল শুরু হলে সুরমা ও কুশিয়ারা হয়ে কয়েকটি শাখা নদীর মাধ্যমে দাঁড়াইন নদীর পানি ছায়ার হাওরে প্রবেশ করতে পারে।
তাদের দাবি, এখনও সময় আছে, এ দুটি জায়গায় দ্রুত সময়ের মধ্যে সংস্কার করা হোক।
কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, চার জেলা নিয়ে বিস্তৃত ছায়ার হাওরে প্রায় ৮ হাজার হেক্টর আবাদি জমি রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ৫ হাজার হেক্টর সুনামগঞ্জের শাল্লায় ও দেড় হাজার হেক্টর দিরাইয়ে, ৯০০ হেক্টর নেত্রকোণার খালিয়াজুড়িতে, দেড়শ হেক্টর কিশোরগঞ্জের ইটনা ও মিঠামইনে এবং কিছু হবিগঞ্জের আজমিরিগঞ্জে রয়েছে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে এই হাওরটির ফসলরক্ষায় পানি উন্নয়ন বোর্ড ৬৪টি পিআইসি (প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি) গঠন করে কাজ শুরু করেছে। তবে সেতু নির্মাণের স্থানে তিন মাস ধরে কাজ হলেও সেখানে কোনো প্রকল্প নেওয়া হয়নি।
সুনামগঞ্জ সড়ক ও সেতু বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, দিরাই উপজেলার শাল্লা সেতু থেকে ১৯ কিলোমিটার দিরাই-শাল্লা পুরনো আঞ্চলিক কাজ শুরু হয়েছে। ৬২৮ কোটি ৫৪ লাখ টাকা ব্যয়ে আঞ্চলিক সড়কে কাজ চলছে কয়েক ধরে।
সম্প্রতি পানি উন্নয়ন বোর্ড ও উপজেলা কাবিটা কমিটির উদ্যোগে পিআইসি (প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি) করে ফসলরক্ষা বাঁধের কাজ শুরু করেছে। এই সড়কে কয়েকটি ফসলরক্ষা বাঁধ ও ক্লোজারে (বড় ভাঙা) বরাবরের মতো এবারও প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে।
কিন্তু সড়ক বিভাগ যেখানে মাটি তুলে সেতু নির্মাণ করছে সেখানে কোনো প্রকল্প নেওয়া হয়নি। উপজেলা কাবিটা ও মনিটরিং কমিটি চিঠি লিখে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে উদ্বেগের বিষয়টি জানিয়েছে।
শাল্লা উপজেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের সেকশন অফিসারের কার্যালয় থেকে জানা গেছে, ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে উপজেলায় হাওরের ফসলরক্ষা বাঁধ নির্মাণে ১৩১টি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। ৮৪ দশমিক ২৮৩ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণ, সংস্কারে ব্যয় হবে প্রায় ২৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে ছায়ার হাওরেই ৬৫টি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে।
উপজেলার বাহাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বিশ্বজিৎ চৌধুরী নান্টু বলেন, এবার হাওরের ফসলরক্ষা বাঁধের উচ্চতা (ওয়াটার লেভেল) ছয় ফুট ধরা হয়েছে। সড়ক বিভাগ দুটি স্থানে সড়ক কেটে যে সেতু বানাচ্ছে সেখানে ডাইভারশন দিয়েছে চার ফুট। যা ওয়াটার লেভেলের দুই ফুট নিচে।
“কাটা অংশ সম্পূর্ণ অরক্ষিত। এখানে কোনো প্রকল্প না নেওয়ায় পানি ডুকে হাওর তলিয়ে যাবে। কেউ বিষয়টি নজরে আনল না। অবিলম্বে এখানে প্রকল্প দিয়ে চার জেলার কৃষকের ফসলরক্ষার ব্যবস্থা নেওয়া হোক।”
শাল্লা উপজেলা হাওর বাঁচাও আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক জয়ন্ত সেন বলেন, “সরকারের কোটি কোটি টাকা ব্যয় হচ্ছে বাঁধ মেরামতে। আবার আঞ্চলিক সড়ক নির্মাণ করতে গিয়ে কাটা হলো পুরনো সড়ক। যেটি হাওরের বাঁধ হিসেবে ফসল সুরক্ষা দিত। এখন সেতু নির্মাণের জন্য মাটি কেটে ফেলায় হাওর অরক্ষিত থাকছে। এখানে ফসলরক্ষার জন্য ছায়া-বাঁধ জরুরি। না হলে কৃষকের সর্বনাশ হয়ে যাবে।”
তিনি বলেন, “দিন-দুপুরে কয়েক মাস ধরে কাজ হলেও দুটি প্রতিষ্ঠানের কেউ বিষয়টি নজরে আনল না। হাওরের কৃষকরা এ ঘটনায় খুবই উদ্বিগ্ন।”
শাল্লা উপজেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের সেকশন অফিসার রিপন আলী বলেন, “পুরনো সড়ক কেটে সড়ক বিভাগ দুটি সেতু করছে। নির্মাণের সুবিধার্থে তারা নীচের মাটি সম্পূর্ণ কেটে ফেলেছে। সামান্য ডাইভারশন দিলেও তা আমাদের বাঁধের তুলনায় নীচু।
“তাই আমরা বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে লিখিতভাবে অবগত করেছি। আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ সড়ক বিভাগের সঙ্গে কথা বলে এ বিষয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নেবেন বলে আশা করছি।”
সুনামগঞ্জ সড়ক বিভাগের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, “আমরা পুরনো সড়ক কেটে সেতু নির্মাণ করছি। মানুষের চলাচলের জন্য ডাইভার্সনও করে দেওয়া হয়েছে। আমরা কয়েক মাস আগ থেকে কাজ করছি।
“পানি উন্নয়ন বোর্ড বা অন্য কেউ কোনো কিছু বলেনি। তবে আমাদের ডাইভার্সনে তাদের কাজ করার সুযোগ আছে। অবশ্যই হাওরের ফসলরক্ষায় আমাদের সবার প্রচেষ্টা দরকার।”
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক বিমল চন্দ্র সোম বলেন, “চারটি জেলা নিয়ে বিস্তৃত ছায়ার হাওরটির বেশিরভাগ জমিই সুনামগঞ্জের শাল্লা ও দিরাই উপজেলায়। এই হাওরটি একটি গুরুত্বপূর্ণ হাওর।
“পানি উন্নয়ন বোর্ড ফসল সুরক্ষার কাজ করে। তারা এবারও অনেকগুলো প্রকল্প নিয়েছে। কোথাও সমস্যা থাকলে এখনও সমাধানের সুযোগ আছে। সবার আগে ফসলের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।”