ভারী বৃষ্টির কারণে গত সোমবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে বান্দরবান।
Published : 11 Aug 2023, 11:23 PM
গত এক সপ্তাহ ধরে ভারী বৃষ্টির কারণে বান্দারবানের রুমা-থানচি সড়কে ব্যাপক ধসের ঘটনা ঘটেছে। এতে এ পথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন আছে। একই কারণে বান্দরবান-রোয়াংছড়ি সড়কের যান চলাচলও বন্ধ আছে।
সড়কে ধস ছাড়াও রুমা-থানচির পথে পথে পড়ে আছে পাহাড় ধসের স্তূপ। এ ছাড়া বিদ্যুতের খুঁটি উপড়ে এলোমেলোভাবে সড়কে পড়ে থাকতে দেখা গেছে। পড়েছে বড় বড় পাথর খণ্ডও।
কাদামাটি পথ মাড়িয়ে কোনো রকমে হাঁটা-চলা করছেন স্থানীয়রা।
ভারী বৃষ্টির কারণে গত সোমবার থেকে ঢাক-চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, রাঙ্গামটি ও অন্য উপজেলার সাথে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে বান্দরবান।
রোববার মধ্যরাত থেকে চলে যায় বিদ্যুৎ। সাথে মোবাইল নেটওয়ার্ক ও ইন্টারনেট সেবাও বিঘ্নিত হয়ে পড়ে।
ভারী বৃষ্টিতে শহরের কোথাও কোথাও বুক সমান পানি থাকায় কোথায় কী ঘটেছে জানা যায়নি এতদিন।
তবে পানি যত সরছে, বিভিন্ন এলাকার ক্ষয়-ক্ষতি চিহ্ন তত স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
শুক্রবার সকালে গিয়ে দেখা যায়, শহর থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে রুমা-থানচি সড়কে মিলনছড়ি এলাকায় চারটি পয়েন্টে পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটেছে। সড়কের মাঝখানে পড়ে আছে ধসের স্তূপ, পাথর ও কাদামাটি। সেগুলো সরিয়ে কোনো রকমে হাঁটা-চলা করতে দেখা যায় স্থানীয়দের। কোনোমতে চলাচল করতে পারছে মোটরসাইকেল।
চিম্বকু পাহাড়ের বিভিন্ন জায়গাতেও রয়েছে অসংখ্য ছোট-বড় পাহাড় ধস।
বান্দরবান জেলা শহর থেকে চিম্বুক পাহাড় হয়ে ১৮ কিলোমিটার পর্যন্ত গেলে ওয়াইজংশন নামে একটি এলাকা। সেখান থেকে ভাগ হয়ে একপাশে দিয়ে চলে গেছে রুমা সড়ক, আরেক পাশ দিয়ে গেছে থানচি সড়কটি।
ওয়াইজংশ এলাকা থেকে রুমা সড়কে গিয়ে দেখা গেছে, ওয়াইজংশ থেকে অল্প দূরত্বে দুটি জায়গায় সড়কের উপর পাহাড় ধসে পড়ে। স্থানীয় লোকজন ধসে পড়া অংশ ঝুঁকি নিয়ে পায়ে হেঁটে পার হচ্ছেন। এরপর আরেকটি অংশে পুরোপুরি ধসে যায়। সেখান থেকেই বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় রুমা সড়কটি।
জেলা শহর থেকে থানচি সড়কের ৩০ কিলোমিটার পর্যন্ত মোটরসাইকেলে যাওয়া যায়। সেখান থেকে আর সামনে এগুনোর সুযোগ নেই। এই ৩০ কিলোমিটারের মাথায় পাতুই ম্রো পাড়ায় সড়কের একটি অংশ পুরোপুরি ধসে পড়েছে। কয়েকশ ফুট নিচে পাহাড়ের খাদে চলে যায় ধসে পড়া অংশটি। ফলে উভয় দিক থেকে ১০০ মিটারজুড়ে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। সেখানেও বিদ্যুতের খুঁটি ও তার এলোমেলো পড়ে রয়েছে। মোটরসাইকেলে যাওয়ার সময় অনেকেই আটকে পড়ছেন এই ধসে পড়া অংশে।
পাশের টংকাবতি ইউনিয়নের রঞ্জুপাড়ার বাসিন্দা কিংওয়াই ম্রো বলেন, “মোটরসাইকেলে করে ছোট বোনকে গ্যালেঙ্গা এলাকায় দিতে যাচ্ছিলাম। এসে দেখি পুরো রাস্তাটাই ধসে গেছে। এখন বাধ্য হয়েই ফিরে যেতে হচ্ছে। মেরামত না করা পর্যন্ত এদিকে আর যাওয়া যাবে না।”
রাস্তা দেখতে আসা টংকাবতি ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান প্লুকান ম্রো বলেন, “ধসে পড়া সড়কের পশ্চিম অংশে টংকাবতি ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডে পাতুই পাড়া পড়েছে। পূর্ব অংশ পড়েছে রুমা গালেঙ্গ্যা ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের পুড়োবাংলা ম্রো পাড়া। স্থানীয় পাড়াবাসীরা আপাতত ধসে পড়া সড়কের পেছনে একটি পাহাড় পার হয়ে চলাচল করছেন। তবে পাহাড়টি পার হতে পনের-বিশ মিনিট সময় লাগে।”
চিম্বুক পাহাড়ের বাগানপাড়ার বাসিন্দা মেনরাও ম্রো বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বৃষ্টির মধ্যেও গত রোববার এম্পুপাড়া থেকে নিজের বাগানপাড়ায় ফিরছিলাম। তখনও এই রাস্তা ভালো ছিল। পরের দিন সোমবার দুপুরে যখন আবার এম্পু পাড়ায় ফিরি তখন এই রাস্তাটাই নাই হয়ে গেছে। সড়কে বিশাল অংশ ধসে গিয়ে পাহাড়ের নিচে চলে যায়। বৃষ্টি হলে মাটির নরম অংশ আরও ধসে যেতে পারে।”
স্থানীয়রা জানান, ৩০ কিলোমিটার এলাকার পরে থানচি সদর পর্যন্ত বিভিন্ন জায়গায় সড়ক ধসে গেছে। কোথাও সড়কের উপর পাহাড় ধসে পড়েছে। বিশেষ করে নীলগিরি, নীলদিগন্ত এবং বলিপাড়ার দিকে আরও পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটেছে।
তবে রুমা ও থানচির বাসিন্দাদের কথা বিবেচনা করে বিকল্প হিসেবে নৌপথে ইঞ্জিনচালিত নৌকার ব্যবস্থা করা হয়েছে বলে জানান শহরের ক্যচিংঘাটা এলাকার নৌঘাটের লাইনম্যান মো. মামুন।
শুক্রবার বিকালে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সড়ক যোগাযোগ বন্ধ থাকায় বান্দরবান থেকে সাঙ্গু নদীপথে রুমা-থানচি যেতে পারবে। শহরের ক্যচিং ঘাটা এলাকা থেকে সড়ক ভালো না হওয়া পর্যন্ত নৌকা চলাচল করবে। রুমা পর্যন্ত এক নৌকায় ছয়জন করে যাত্রী নেওয়া হবে। ভাড়া পড়বে জনপ্রতি ৭০০ টাকা। কিন্তু থানচি পর্যন্ত ভাড়া এখনও ঠিক করা হয়নি।”
এদিকে শুক্রবার সকাল থেকে রুমা-থানচি সড়কে ধসে পড়া মাটি সরানো ও মেরামত শুরু করেছে ৩৪ ইঞ্জিনিয়ারিং কন্সট্রাকশন ব্রিগেডের আওতায় সেনাবাহিনীর ২০ ইসিবি (নির্মাণ প্রকৌশল ব্যাটালিয়ন)।
সেনাবাহিনীর ২০ ইসিবি ওয়ারেন্ট অফিসার রাহুল হাসান পার্থ সাংবাদিকদের বলেন, “বান্দরবান থেকে রুমা-থানচি সড়কটি যত দ্রুত সম্ভব চলাচলের উপযোগী করা হচ্ছে। তবে পাহাড় ধসে সড়কের উপর বিদ্যুতের তার পড়ে থাকায় কাজ করতে অসুবিধা হচ্ছে। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। ঠিক কতদিনের মধ্যে যান চলাচলের উপযোগী করা হবে বলা যাচ্ছে না।”
জেলা প্রশাসনের সংবাদ সম্মেলন
গত এক সপ্তাহের টানা বৃষ্টিতে বন্যায় ও পাহাড় ধসে ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে শুক্রবার বিকালে এক সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক শাহ মোজাহিদ উদ্দিন।
নিহতরা হলেন: বান্দরবান সদর উপজেলার টংকাবতি মুসলিম সিকদার পাড়া এলাকার মো. ইউনুস (৪৭), বাইট্যাপাড়া বাসিন্দা তরচ্যং ম্রো (৩২), বান্দরবান সদর ইউপির দাঁতভাঙ্গা পাড়ার ছায়ারাণী তঞ্চঙ্গ্যা (৪৫), বান্দরবান পৌরসভার গোদার পাড় এলাকার সন্ধ্যা বালা শীল (৫২), বর্ষা শীল বুলু (১৭), লামা ফাঁসিয়াখালী এলাকার করিমা আক্তার (৩৬), লামার রূপসি পাড়ার মংবাসিং মারমা (২৮), আলীকদমে জামতলী ১৫ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্প ঠাকুর পাড়া এলাকার মো. মুছা (২২) ও আব্দুল আমিন (১৮) এবং নাইক্ষ্যংছড়ি সোনাইছড়ি এলাকার পংছা মারমা (৬৫)।
নিহতদের অধিকাংশ পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসকারী জানিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে বসবাসকারীদের নিরাপদ আশ্রয়ে থাকার কথা বলেন জেলা প্রশাসক।
সংবাদ সম্মেলনে জেলা প্রশাসক আরও জানান, সম্প্রতি স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন জেলার অধিকাংশ জনগণ। সর্বশেষ পাওয়া তথ্যে ১০ জন নিহত ছাড়াও ১৫ হাজার ৮০০ পরিবারের প্রায় ৬০ হাজার লোক বহুলাংশে, ৩ হাজার ৫৭৮টি পরিবারের প্রায় ১৫ হাজার লোক আংশিক এবং ৮ হাজার ২৫৩ হেক্টর ফসলি জমির চরম ক্ষতি হয়েছে।
এছাড়া গত বুধবার সন্ধ্যায় বান্দরবান পৌরসভার মধ্যমপাড়া আহম্মদ্যার কলোনি এলাকার সাঙ্গু নদীর তীর এলাকায় নদীর ভাঙনে ১টি দোতলা ও ৭টি কাঁচা ঘর নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে বলে জানান জেলা প্রশাসক।