পালাগান, গীত, বাউলসহ লোকায়ত সংগীতের বিভিন্ন ধারার পরিবেশনা মুগ্ধতা ছড়ায় দর্শক-শ্রোতাদের মাঝে।
Published : 13 Apr 2024, 09:44 PM
নেত্রকোণার কেন্দুয়া উপজেলার নিভৃত গ্রামে চলছে ‘খনার মেলা’। এই মেলায় গ্রামীণ সংস্কৃতি ও কৃষিতে খনার বচনের তাৎপর্য তুলে ধরে চলছে নানা পরিবেশনা।
উপজেলার আঙ্গারোয়ায় শনিবার চৈত্র সংক্রান্তির ভোরের হাওয়ায় সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে মেলার উদ্বোধন করা হয়। এরপরই মঙ্গলঘর পরিসর আয়োজিত এ মেলায় গানে গানে খনার বচন তুলে ধরা হয়।
পাশাপাশি গ্রামীণ সংস্কৃতির পালাগান, গীত, বাউলসহ লোকায়ত সংগীতের বিভিন্ন ধারার পরিবেশনা মুগ্ধতা ছড়ায় দর্শক-শ্রোতাদের মাঝে।
এ ছাড়া মেলা প্রাঙ্গণে চলছে কৃষির নানা উপকরণের প্রদর্শনী; রয়েছে কৃষকদের মধ্যে দেশীয় বীজের বিনিময় অনুষ্ঠান। পরিবেশের কথা বিবেচনা করে মেলা প্রাঙ্গণে প্লাস্টিক সামগ্রী নিষিদ্ধ করেছেন আয়োজকরা।
রাতভর লোকগান পরিবেশনার মধ্য দিয়ে নববর্ষের সূর্যোদয়ে ভোরের হাওয়ায় শেষ হবে এই মেলা।
খনার বচন লোকসাহিত্যের এক অন্যতম ধারা। জনজীবনের দৈনন্দিন কার্যকলাপ, আচার-অনুষ্ঠান, কৃষি সংস্কৃতি, সমাজের সংস্কার ও বিশ্বাস নিয়ে খনা বচন রচনা করেছেন। এসব বচনের মধ্য দিয়ে লোকায়ত বাংলার স্বরূপ প্রকাশিত হয়েছে।
চট্টগ্রাম থেকে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে খনার মেলা দেখতে এসেছেন কবি ও সংস্কৃতিকর্মী আসমা
বিথি। তিনি বলছিলেন, “খনার মেলা কোথাও দেখিনি। ব্যতিক্রম বলেই চলে এসেছি। আমাদের যে নিজস্ব গান আছে, পুঁথি আছে সেজন্যেই এতদূর থেকে আসা। এটা এক অন্যরকম অনুভূতি।”
নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ থেকে আসা কবি শাহেদ কায়েস বলেন, “সকাল থেকে যে খনার মেলা চলছে তা আমার মাঝে অসাধারণ এক অনুভূতি তৈরি করেছে। খনার মেলা ধারণাটাই নতুন। বাংলাদেশ, ভারতের পশ্চিমবঙ্গেরও কোথাও এর আগে হয়নি।
“খনার বচনের সঙ্গে কৃষি সংস্কৃতির এবং প্রাণ-প্রকৃতির একটা সম্পর্ক আছে। আমরা আজ যে জলবায়ু পরিবর্তনের কথা বলছি, খনা তা হাজার বছর আগেই বলে গেছেন। প্রকৃতি ঘনিষ্ট যে জীবন আমাদের, তা খনার বচনে রয়েছে।
“প্রতিবাদী চরিত্র ছিল খনার। তিনি সমাজের নানা অসঙ্গিত নিয়ে কথা বলেছেন প্রবাদ-প্রবচনের মাধ্যমে। তার কথা হৃদয়ঙ্গম করে প্রকৃতিতে ফিরে আসা দরকার আমাদের”, বলেন শাহেদ কায়েস।
কবি শ্মশান ঠাকুর বলেন, “খনার মেলার ধারণাটি আকর্ষণীয়। খনার বচনের বিষয়টাকে বাংলার ঐতিহ্য হিসেবে আমরা সামনে আনিনি কখনও। খনার মেলা একটি প্রতীক। তিনি কোনো রাজনৈতিক বা ধার্মিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন না। আর্থ-সামাজিক যে সত্যগুলো মানুষের জীবনের সঙ্গে, খাবারের সঙ্গে, আবহাওয়ার সঙ্গে জড়িত সেই সত্যগুলো খনা বলতেন। সেই সময়ের ধর্ম, রাজনীতি তার বিরুদ্ধে ছিল, বর্তমান সময়টাও সেইরকম।”
মেলায় আসা কৃষকরা বলছেন, তারা খনার বচনে কৃষির অনেক নতুন বিষয় জানতে পেরেছেন। খনার বচর প্রকৃতি সম্পর্কে কৃষককে অনেক ধারণা দিতে পারে।
আঙ্গারোয়া গ্রামের কৃষক জমির উদ্দিন বলেন, “আসলে খনার বচন বলতে যে কী বোঝায় তা আমার জানা ছিল না। মেলার মাধ্যমে খনার বচনের অনেক কিছুই জানতে পারছি আমরা।
“‘কৃষি পণ্য, ব্যবসা আধা, চাকরি করে গাধা’- এই যে খনার একটি বচন তাতে কৃষিকে যে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে এই উপলব্ধি আমরা শিখতে পারছি। খনার অনেক বচন জানা ছিল না। এখান থেকে জানতে পারছি”, বলেন কৃষক জমির।
সংস্কৃতিকর্মী আবুল কালাম আজাদ বলেন, “বাঙালির হাজার বছরের জ্ঞান বিশেষ করে কৃষিতে, তা খনার বচন থেকে নেওয়া। কৃষি সংস্কৃতির জ্ঞানের পরিবাহক তিনি। তাই কৃষি ও কৃষকের স্বার্থে খনাকে সামনে নিয়ে আসছি আমরা।”
খনার মেলা আয়োজনের অন্যতম সংগঠক দেবব্রত দাস বিপ্লব বলেন, “এই দেশ মাটি বৃক্ষ প্রকৃতির, বিশেষ করে মানুষের কৃষি জীবনের দীর্ঘজীবন পঞ্জিকা, রীতিনীতি বোধকে যেন আরও আষ্টেপৃষ্টে টের পাচ্ছি খনার মেলাকে ঘিরে কাজ করবার মাঝ দিয়ে।
“'খনা আছে জনে জনে, খনা আছে জীবনে জীবনে'--- খনার মেলাকে ঘিরে আমাদের এই উপলদ্ধি এই ডাক দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ুক, ছড়িয়ে পড়বে বলেই দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি।"
মঙ্গলঘর পরিসরের প্রধান সমন্বয়ক বদরুন নূর চৌধুরী লিপন বলেন, “খনা আমাদের এ জীবনের যাত্রাপথে মিলেমিশে আছে। মঙ্গলঘর আর খনা অবিচ্ছেদ্য। শিল্পী কফিল আহমেদ খনার মেলার কথা তুলে আমাদেরকে এবার আরও উসকে দিয়েছেন। আমি অভিভূত যে খনার মেলা করতে যেয়ে এলাকাবাসীসহ বলতে গেলে সারাদেশের সংস্কৃতিপ্রাণ মানুষের কাছ থেকে যে সাড়াটুকু পেয়েছি, তা সব সময়েই জীবনের প্রেরণা হয়ে থাকবে।”
তিনি বলেন, “এই খনার মেলার উদ্বোধন হয়েছে ভোরের হাওয়ায়। কোনো ব্যক্তি মানুষের উদ্বোধন দিয়ে আমরা শুরু করিনি। এই গোটা বিশ্ব চরাচরই খনার মেলার উদ্বোধক। খনার মেলা যেমন এবারেই প্রথম হচ্ছে তেমনি ভোরের হাওয়ায় কোনো মেলার উদ্বোধন এই প্রথম হচ্ছে বলে মনে হয়।
“এবার আমরা চেষ্টা করেছি, আগামী বছর আরও গুছিয়ে সুন্দরভাবে খনার মেলা উদযাপন করব বলে আশা করি।”