পুরো সুফল পেতে অপেক্ষা করতে হবে অন্তত ৯ মাস।
Published : 09 Oct 2022, 11:14 PM
নারায়ণগঞ্জ সদর ও বন্দর উপজেলার মধ্যে নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগে সোমবার চালু হচ্ছে তৃতীয় শীতলক্ষ্যা সেতু।
এ দিন দুপুর ১২টায় ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে সেতুটি উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এটি নাম পেয়েছে বীর মুক্তিযোদ্ধা এ কে এম নাসিম ওসমান সেতু।
সেতুটি চালুর মধ্য দিয়ে দক্ষিণবঙ্গের সঙ্গে চট্টগ্রাম ও সিলেটের দূরত্ব অন্তত ২০ কিলোমিটার কমবে বলে জানিয়েছেন সড়ক ও জনপথ অফিসের নির্বাহী প্রকৌশলী শাহানা ফেরদৌস। তিনি বলেন, এখন থেকে ওই দুই পথের যাত্রীদের ঢাকা হয়ে চলাচল করতে হবে না। সেই কারণে অন্তত দুই ঘণ্টা সময় সাশ্রয় হবে যাত্রীদের।
ঢাকাকে পাশ কাটানোর ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, “দক্ষিণের যাত্রীরা পদ্মা সেতু দিয়ে মুন্সীগঞ্জ হয়ে শীতলক্ষ্যা সেতু দিয়ে মদনপুর হয়ে চট্টগ্রাম কিংবা সিলেট যেতে পারবেন।”
রোববার দুপুরে সেতুটি পরিদর্শনকালে নারায়ণগঞ্জের জেলা প্রশাসক মঞ্জুরুল হাফিজও বলেন, “এই সেতু চালুর মধ্য দিয়ে পদ্মা সেতুর সাথে সংযোগ হচ্ছে নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জের।
“যারা খুলনা, যশোর, মাগুরা, ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া এলাকার মানুষ তারা পদ্মা সেতু হয়ে ঢাকা শহরে প্রবেশ না করেই সরাসরি কিন্তু চট্টগ্রাম যেতে পারবে। সেক্ষেত্রে একটা বড় দূরত্ব কমে যাবে।”
ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে বা অন্যান্য ক্ষেত্রে বড় ধরনের ব্যয় কমে যাবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, “এই ছোট জেলায় ৮০ লাখের বেশি মানুষ বাস করে এবং অধিকাংশ শ্রমজীবী মানুষ এই অংশে বসবাস করেন। তারা এক মিনিটে ওই পাড়ে যেতে পারবেন। নৌকার জন্য তাদের অপেক্ষা যে করতে হতো বা খরচ হতো, সেটা আর করতে হবে না।”
উদ্বোধনের পর সাধারণ মানুষকে হাঁটাহাঁটির জন্য সেতুতে চড়তে দেওয়ার পরিকল্পনা আছে জানিয়ে মঞ্জুরুল হাফিজ বলেন, “এপার ওপার হাঁটতে কেমন লাগে, সেইটা একটা বিষয় তো রয়েছেই। রাত ১২টার পর থেকে সেতু দিয়ে গাড়ি-ঘোড়া চলাচল শুরুর পরিকল্পনা আছে।”
সেতু পরিদর্শনে গিয়ে সড়ক ও জনপদ বিভাগের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী ও সেতুর প্রকল্প পরিচালক শোয়েব আহমেদ জানান, সোয়া কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এই সেতুর দুই পাশে প্রায় দেড় কিলোমিটার অ্যাপ্রোচ সড়ক থাকছে। সেতুটা ছয় লেন বিশিষ্ট। চার লেন দিয়ে চলবে দ্রুতগতির যানবাহন, বাকি দুই লেনে চলবে ধীর গতির যানবাহন।
সেতু দিয়ে হেঁটে পারাপারের সুযোগও থাকছে বলে জানান তিনি।
শীতলক্ষ্যা সেতু চালু হলে পঞ্চবটি বিসিক শিল্প এলাকা, পঞ্চবটি মোড়, চাষাঢ়া মোড়, সাইনবোর্ড, নারায়ণগঞ্জের চট্টগ্রাম সড়ক বা ঢাকার পোস্তগোলা ও শনির আখড়া রুটে যানবাহনকে তীব্র যানজটের সম্মুখীন হতে হবে না বলে জানান শোয়েব আহমেদ।
“যানবাহনগুলো রাজধানীর পাশাপাশি নারায়ণগঞ্জ শহরকে বাইপাস করতে পারবে। এতে রাজধানী ও নারায়ণগঞ্জ শহরের ওপর চাপও কমবে।”
যদিও বহুল কাঙ্ক্ষিত এই সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়ার পর অপেক্ষা করতে হলো দীর্ঘ ১২ বছর। প্রকল্পটি ২০১০ সালে একনেকে অনুমোদন পেলেও ২০১৮ সালের ২৮ জানুয়ারি নির্মাণকাজ শুরু হয়।
প্রকল্প পরিচালক বলেন, সেতু নির্মাণে ৬০৮.৫৬ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। এর মধ্যে ২৬৩.৩৬ কোটি টাকা এসেছে বাংলাদেশ সরকারের তহবিল থেকে এবং ৩৪৫.২০ কোটি টাকা সৌদি ফান্ড ফর ডেভেলপমেন্ট (এসএফডি) থেকে এসেছে।
ওয়াকওয়েসহ সেতুটিতে ৩৮টি স্প্যান রয়েছে, পাঁচটি নদীতে এবং ৩৩টি পূর্ব ও পশ্চিম প্রান্তে। হাঁটার পথসহ সেতুটির প্রস্থ ২২.১৫ মিটার।
সেতু পরিদর্শনকালে অন্যান্যের মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর উপ-প্রেস সচিব হাসান জাহিদ তুষার, সহকারী প্রেস সচিব এম এম ইমরুল কায়েস উপস্থিত ছিলেন।
দিন বদলের অপেক্ষায় মানুষ
কথা হয় সদর ও বন্দরের কয়েকজন বাসিন্দার সাথে। তারা বলছেন, শীতলক্ষ্যা নদীটি জেলা সদরের সাথে বন্দর ও সোনারগাঁ উপজেলাকে আলাদা করে রেখেছে। এ দুটি উপজেলার সঙ্গে জেলা সদরের সরাসরি যোগাযোগ ব্যবস্থা না থাকায় কাঁচপুর (শীতলক্ষ্যা সেতু-১) হয়ে দীর্ঘ ৩০ কিলোমিটার পথ ঘুরতে হয়। বন্দর উপজেলার মদনপুর থেকে মদনগঞ্জ পর্যন্ত অন্তত তেরোটি খেয়াঘাট রয়েছে। তৃতীয় শীতলক্ষ্যা সেতু নদীপথের ভোগান্তি থেকে মুক্তি দেবে।
নারায়ণগঞ্জ বন্দর উপজেলার ধামগড় ইউপির শিমু আক্তারের শ্বশুড়বাড়ি সদর উপজেলার কাশীপুর ইউনিয়নে। শারীরিক প্রতিবন্ধী ছেলেকে নিয়ে প্রায় সময়ই বাবার বাড়ি থেকে শ্বশুরবাড়ি যাতায়াত করতে হয় শিমুর। তিনি বলেন, “আমার ছেলে হাঁটতে পারে না। তাকে নৌকায় তুলতে আর নৌকা থেকে নামাতে অনেক কষ্ট হয়। ব্রিজটা চালু হয়ে গেলে গাড়ি দিয়েই যাতায়াত করা যাবে। নদীপথের ভোগান্তি পোহাতে হবে না।”
বন্দর উপজেলার ফরাজীকান্দা এলাকার বাসিন্দা মোহাম্মদ লুৎফর বলেন, “আগে এখানে সেতু ছিল না, নদী পার হতে হতো নৌকায়। দুর্ঘটনায় অনেকের জীবন গেছে। আমরা এই সেতু পেয়ে খুশি।”
স্থানীয় আরেকজন রফিকুল ইসলাম বলেন, “আগে নৌকায় নদী পার হতে অনেক সময় লেগে যেতো। এ জন্য দূরত্ব অনুযায়ী গুনতে হতো টাকাও। এ ছাড়া সড়ক পথে সড়কে গেলে প্রায় ৩০ কিলোমিটার ঘুরতে হতো। এখন নারায়ণগঞ্জ ও মুন্সীগঞ্জের মানুষ শীতলক্ষ্যার এই সেতু দিয়ে অল্প সময়ে যাতায়াত করতে পারবে।”
পুরো সুফল পেতে আরও অপেক্ষা
সেতু খুলে দেওয়া হলেও সহসাই পুরো সুফল মিলবে না বলে জানাচ্ছেন পরিবহন শ্রমিকরা। তারা বলছেন, সেতুর পূর্বপাড় মদনগঞ্জ থেকে মদনপুরের ১১ কিলোমিটারের সড়কটি খুবই সংকীর্ণ। এই পথে সবসময়ই যানজট লেগে থাকে। সেতুটি চালু হলে যানবাহনের চাপ বাড়বে, তাতে সড়কে যানজট আরও বাড়বে।
মদনগঞ্জ-মদনপুরে রুটের অটোরিকশা চালক জয়নাল আবেদীন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এমনেই এই রাস্তায় যানজট লাইগা থাকে। ব্রিজ উদ্বোধন করলে দুনিয়ার গাড়ি আইবো এই রাস্তায়। রাস্তার কাজ তো চলতেছে ধীরগতিতে। রাস্তা না হইলে ব্রিজের সুবিধা লোকজন পাইবো না। উল্টা যানজট বাড়বো।”
জেলা সড়ক ও জনপথ অফিসের নির্বাহী প্রকৌশলী শাহানা ফেরদৌস বলেন, “মদনগঞ্জ থেকে মদনপুর পর্যন্ত ১১ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের ১৮ ফুট প্রস্থের রাস্তার প্রশস্ততা আরও ৬ ফুট বাড়ানোর কাজ চলছে। এটি একটি স্বল্পমেয়াদী পরিকল্পনা। আমরা দীর্ঘমেয়াদী হিসেবে ছয় লেনের রাস্তা করার পরিকল্পনা করেছি।
“যেহেতু ওইটা করতে সময় লাগবে, সে কারণে সেতু চালুর পর যানবাহনের যে চাপ বাড়বে তা সামাল দিতে রাস্তার প্রশস্ততা ৬ ফুট বাড়ানোর জন্য কাজ করছি। এই কাজ আগামী জুনের মধ্যে শেষ হবে।”
সেতুর পূর্বপাড়ে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে উপস্থিত থাকবেন বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী (বীর প্রতীক), নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভী, প্রয়াত নাসিম ওসমানের দুই ভাই নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য এ কে এম শামীম ওসমান এবং নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের সংসদ সদস্য এ কে এম সেলিম ওসমান।