কুমিল্লার নিমসার বাজারের ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের মাঝখানের জায়গাও দখল করে রেখেছেন প্রভাবশালীরা।
Published : 12 Dec 2022, 02:07 PM
দেশের অর্থনীতির ‘লাইফলাইন’ খ্যাত ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে অবস্থতি কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার নিমসার বাজার। শাকসবজির পাইকারি বাজার হিসেবে সারাদেশেই এর খ্যাতি রয়েছে। প্রশাসনের নাকের ডগায় সেই বাজারের সড়ক ও জনপথ বিভাগের অধিগ্রহণ করা জায়গা অবৈধভাবে দখলে নিয়ে স্থানীয় প্রভাবশালীরা ‘জমিদারি’ চালাচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
ভৌগলিক কারণেই গুরুত্বপূর্ণ নিমসার বাজারের ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের মাঝখানের জায়গাটিও দখল হয়ে গেছে; গড়ে তোলা হয়েছে অর্ধশত টিনের আড়ত। ক্রেতা-বিক্রেতার কেনাবেচাতে বাজারটি সারাক্ষণই জমজমাট থাকে। লেনদেন হয় কোটি কোটি টাকার পণ্যের।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মোটা অঙ্কের টাকা অগ্রিম নিয়ে সেসব দোকান ঘর ভাড়া দিচ্ছেন প্রভাবশালীরা। অবৈধভাবে গড়ে উঠা এসব দোকানের বেশিরভাই ব্যবহার হচ্ছে সবজিসহ কাঁচামালের আড়ত হিসেবে। এসব অবৈধ দখলদারদের ‘দোকান ঘরের মালিক’ বা ‘জমিদার’ বলেও ডাকেন ভাড়াটিয়ারা।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগের কুমিল্লার নির্বাহী প্রকৌশলী সুনীতি চাকমা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের নিমসার বাজার ও আশপাশের অংশে যেসব অবৈধ স্থাপনা আছে সেগুলো উচ্ছেদ করার জন্য স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে। আমরা উপজেলা প্রশাসনসহ যত দ্রুত সম্ভব আমাদের সব সম্পত্তি থেকে অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করব। এক্ষেত্রে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।”
বুড়িচং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) হালিমা খাতুন বলেন, “নিমসার বাজারে সওজের সম্পত্তিতে বেশকিছু অবৈধ স্থাপনা গড়ে উঠেছে। তারা আমাদেরকে বিষয়টি জানিয়েছে।“
“এরই মধ্যে উপজেলা সহকারী কমিশনারকে (ভূমি) দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনার জন্য। আশা করছি, শিগগিরই সব অবৈধ দখলদারকে উচ্ছেদ করার কার্যক্রম শুরু হবে।”
সম্প্রতি নিমসার বাজারে গিয়ে দেখা যায়, নিমসার উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে থেকে চট্টগ্রামের দিকে অন্তত ৩০০ মিটার জায়গাজুড়ে মহাসড়কের দুইমুখী লেনের মাঝখানের ওই জায়গাটি দখল করে নির্মাণ করা হয়েছে অর্ধশতাধিক আড়ত ও দোকান ঘর। সেখানে রয়েছে খাবারের কয়েকটি হোটেলও। বিভিন্ন ধরনের সবজির পাশাপাশি সেখানকার আড়ত ও দোকানে বিক্রি হচ্ছে বিভিন্ন প্রকারের ফল ও কাঁচামাল।
দিনের বেলাতেও এসব দোকানের মালামাল ওঠা-নামা করানো হচ্ছে মহাসড়কের মধ্যে গাড়ি রেখে। এতে যানচলাচল ব্যাহত হচ্ছে। এ কারণে প্রায়ই নিমসার বাজারে যানজট লেগে থাকে। বিশেষ করে ঈদসহ উৎসবের সময়গুলোতে যানবাহনের চাপ বেশি থাকলে বাজারটি পার হতে বেশ সময় লাগে বলে জানান ব্যবসায়ীরা।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে হাইওয়ে পুলিশ, কুমিল্লা অঞ্চলের পুলিশ সুপার মুহাম্মদ রহমত উল্লাহ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “নিমসার বাজারে এসব স্থাপনার কারণে অনেক সময় দেখা যায়, সড়কের মধ্যে গাড়ি রেখে মালামাল লোড-আনলোড করা হচ্ছে। এসব কারণে অনেক সময় যানচলাচল করতে হয় ধীরগতিতে।
“তবে আমরা এসব বিষয়ে সতর্ক রয়েছি। বাজারের ব্যবসায়ীদের বলেছি, মহাসড়কের মধ্যে তারা যেন কোনো গাড়ি না রাখেন। কেউ নিয়ম অমান্য করলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
ব্যবসায়ীরা জানান, ২০১৬ সালে চালু হয় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের চার লেন। ২০১৯ সালের ১৯ ডিসেম্বর উপজেলা প্রশাসনের সহায়তায় বাজারটিতে অভিযান চালিয়ে শতাধিক অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করেছিল সওজ বিভাগ। কিন্তু সেই অভিযানের সুফল সাধারণ মানুষ এক মাসও ভোগ করতে পারেননি। এর আগেই সেখানে নতুন করে তোলা হয় দোকান ঘর।
তারা জানান, বাজারটিতে প্রতিদিন দুই শতাধিক আড়তে পাইকারি মালামাল বিক্রি হয়। এর বাইরেও খুচরা বিক্রির জন্য চার শতাধিক শাকসবজির দোকান বসে। আড়তগুলোতে প্রতিদিন পাঁচ থেকে ১০ লাখ টাকার শাকসবজি ও তরকারি পাইকারি বিক্রি হয়। প্রভাবশালীরা এসব অবৈধ দোকান তুলে মাসে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিলেও নজরদারির অভাবে সরকার কোনো রাজস্ব পাচ্ছে না।
বাজারের বাসিন্দাদের অভিযোগ, নিমসার বাজারের দখলদার সিন্ডিকেটের সবাই প্রভাবশালী। এজন্য সেখানে উচ্ছেদ অভিযান হয় না। কেউ কথা বলতেও সাহস পায় না। দখলদাররা সব কিছু ‘ম্যানেজ’ করেই দোকান ভাড়া তুলছেন। মাঝে মাঝে অভিযান হলেও সেটা হয় লোক দেখানো।
মহাসড়কের দুই লেনের মাঝখানে গড়ে ওঠা দোকানগুলোর একটিতে রয়েছে ‘কফি হাউস অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট’ নামের খাবার দোকান। কত টাকা ভাড়ায় দোকানটি চলছে এ নিয়ে সরাসরি হোটেলে কর্মরত কেউই কথা বলতে রাজি হননি।
তবে নাম প্রকাশ না শর্তে ওই হোটের এক কর্মচারী জানান, দুই লাখ টাকা অগ্রিম দিয়ে এবং মাসিক ১০ হাজার টাকা ভাড়ায় দোকানটি ভাড়া নিয়েছেন স্থানীয় আবদুল বাতেন। সব দোকানই এভাবে ভাড়া নেওয়া।
সেখানকার আরেকটি দোকানে আলু আর পেঁয়াজের আড়ত রয়েছে। ওই আড়তের মালিকও একই কথা বলেছেন।
ব্যবসায়ীদের মধ্যে উচ্ছেদ আতঙ্ক আছে কি-না, জানতে চাইলে কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, আজকে উচ্ছেদ হলে কালকেই নতুন ঘর তুলবে ‘জমিদাররা’। এ নিয়ে তারা চিন্তাও করেন না।
অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে, দলখদার সিন্ডিকেটের অন্যতম বুড়িচং উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মো. গোলাম ফারুকের নাম।তিনি ছাড়াও পাশের পরিহল পাড়া এলাকার রুহুল আমিন, আলমগীর হোসেনসহ অন্তত ২০ জন এসব দোকান দখলে রেখে ভাড়া দিচ্ছেন।
এসব অবৈধ স্থাপনা নির্মাণের বিষয়টি স্বীকার করলেও ভিন্ন যুক্তি দিয়েছেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মো. গোলাম ফারুক।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ১৯৬৩ সালে সওজের জন্য এসব জায়গা অধিগ্রহণ করা হয়। এসব সম্পত্তি ছিলো তাদের এবং যারা দোকান তুলেছেন সেসব ব্যক্তিদের পূর্বপুরুষদের। অধিগ্রহণের কয়েক বছর পর থেকেই সেখানে এভাবেই দোকান তোলা হচ্ছে। পুরো বাজারে টিনেরচালা যতগুলো দোকান আছে, তার সবগুলোই সওজের সম্পত্তির ওপর নির্মিত হয়েছে।
সওজের সম্পত্তিতে কীভাবে দোকান তুলে ভাড়া দেওয়া হয়- জানতে চাইলে উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান বলেন, “আমরা দোকান নির্মাণ করি না। মূলত যারা ব্যবসায়ী, তারাই এসে বলেন- দোকান তুলবে। পরে আমরা বলি, সরকার প্রয়োজনে যেকোনো সময় ভেঙে ফেলবে; তারা এসব মেনেই দোকান তুলে আমাদেরকে ভাড়া দেয়। বলতে পারেন, পরিত্যক্ত জমিতে অনেকটা চাষাবাদ করে খাওয়ার মতো ব্যাপার আরকী!”
গোলাম ফারুকের ভাষ্য, “দোকানগুলো নির্মিত না হলে অনেক মানুষই পথে বসতো। তারা নিজেদের পরিবারকে বাঁচাতে ব্যবসা করছেন। আর বিষয়টি অবৈধ হলেও মানবিক কারণে তারা এই সুযোগটি দিয়েছেন।”
“সওজ কর্তৃপক্ষ চাইলে তাদের প্রয়োজনে যেকোনো সময় উচ্ছেদ করে তাদের সম্পত্তি বুঝে নিতে পারে। তবে জমি বুঝে নেওয়ার পর ফের পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকলে আবারও আগের মতো দোকান গড়ে উঠবে।”