রানা প্লাজা ধস: ‘মৃত্যুর যন্ত্রণা নিয়ে বেঁচে আছি’

ওই ভবনে থাকা কয়েকটি পোশাক কারখানার ৫ হাজারের মতো শ্রমিক তার নিচে চাপা পড়েন।

সেলিম আহমেদসাভার প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 April 2023, 02:42 PM
Updated : 24 April 2023, 02:42 PM

দরিদ্র পরিবারের নারী বরিশালের শীলা বেগম। একটু ভালভাবে বাঁচার আশায় একমাত্র মেয়ে নীপাকে বোনের বাসায় এসে সাভারে এসে চাকরি শুরু করেন। যোগ দেন রানা প্লাজার ছয় তলার ইথার টেক্স কারখানায় অপারেটর পদে।

দুই বছর ভালই চলছিল। সংসারে স্বাচ্ছন্দ এসেছিল, কিছুটা সুখ। কিন্তু ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সব শেষ হয়ে যায় রানা প্লাজা ধসের সঙ্গে সঙ্গে। 

ধসেপড়া ভবনের বিমের নীচে চাপা পড়েন শীলা। প্রায় ১৮ ঘণ্টা পর উদ্ধারকর্মীরা তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করেন। প্রথমদিকে সরকারিভাবে কিছু টাকা পেলেও সেই টাকায় তার চিকিৎসাও ঠিকমতো করতে পারছেন না। অভাবে সন্তানের লেখাপড়াও বন্ধের পথে। কোনোরকম দুমুঠো খেয়ে বেঁচে আছেন তিনি।

সাভারে বসবাস করা শীলা বেগম বলেন, “মেরুদণ্ডে সমস্যা, হাতে সমস্যার পর এখন পেটে টিউমার হয়েছে। সর্বক্ষণ রক্তক্ষরণ হচ্ছে। দ্রুত অপারেশন করা দরকার। কিন্তু টাকার অভাবে করতে পারছি না। 

দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, “মৃত্যুর যন্ত্রণা নিয়ে বেঁচে আছি।”

শীলা বেগমের মতো অনেকেই এখনও রানা প্লাজা ধসের দুঃসহ স্মৃতি বয়ে বেড়াচ্ছেন। দীর্ঘ চিকিৎসার পর তারা শারীরিকভাবে কিছুটা সুস্থ হলেও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। অনেকে স্বাভাবিক জীবনে ফেরার সংগ্রাম করে যাচ্ছেন।

তবে অঙ্গহানি হওয়া শ্রমিকরা ভাল নেই। কেউবা মানসিক রোগীতে পরিণত হয়েছেন। অনেকেই ভিক্ষা বৃত্তি করে চালাচ্ছেন জীবন-সংসার।

২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সাভার বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন ১০ তলা রানা প্লাজা ভবন ধসে পড়ে। ওই ভবনে থাকা কয়েকটি পোশাক কারখানার ৫ হাজারের মতো শ্রমিক তার নিচে চাপা পড়েন।

কয়েকদিনের উদ্ধার তৎপরতায় ১ হাজার ১৩৬ জনের লাশ তুলে আনা হয়। ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে ২ হাজার ৪৩৮ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়। তার মধ্যে প্রায় দুই হাজার শ্রমিক আহত ও পঙ্গু হন।

রানা প্লাজার তৃতীয় তলার নিউ ওয়েভ বাটনস কারখানার অপারেটর পদে চাকরি করতেন আজিরন বেগম। কারখানা ধসে নীচে চাপা পড়েন তিনি। তার স্বামী ও মেয়ে ধংসস্তুপের নীচ থেকে খোঁজে বের করে সাভার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করে।

আজিরন বেগম বলেন, “সরকারি হাসপাতালে ১০ দিন ভর্তি থাকার পর সুস্থ না হওয়ায় সাভার সিআরপি হাসপাতালে রেফার্ড করে সেখানে দেড় বছর চিকিৎসাধীন ছিলাম। পুরো শরীর মাথা থেকে পা পর্যন্ত ব্যাথা, এখনও ঠিকমতো চলাফেরা করতে পারি না।

সরকারের কাছে সুচিকিৎসা ও ক্ষতিপূরণ দাবি করেন আজিরন।

মানিকগঞ্জ জেলার সিংগাইর নিলুফার ইয়াসমিন। স্বামী-সংসার নিয়ে ২০০৭ সালে সাভারে এসে রানা প্লাজার পঞ্চম তলায় ফেনটম অ্যাপারেলস কারখানায় সুইং অপারেটর হিসেবে কাজে যোগ করেন। রানা প্লাজা ধসের সময় বিমের নীচে চাপা পরে পঙ্গু হয়ে যান।

নিলুফা আক্ষেপ করে বলেন, “পায়ে পচন ধরেছে, ঠিকমত হাঁটতে পারি না। ডান পায়ে পচন ধরেছে, ডাক্তার বলেছে, কেটে ফেলতে হবে। টাকার অভারে উন্নত চিকিৎসা করাতে না পেরে পা কেটে ফেলা ছাড়া কোনো উপায় নেই।”

হালিমা বেগম স্বামী-সন্তান নিয়ে বসবাস করতেন ধামরাই থানার ফুটনগর এলাকায়। স্বামী মারা গেলে কাজের তাগিদে সাভার এসে রানা প্লাজার অষ্টম তলার নিউ স্টাইল লিমিটেড লাইন কারখানার আউটপুট অপারেটর হিসেবে কাজে যোগদান করেন।

রানা প্লাজা ধসের পর ধংসস্তুপের নীচ থেকে উদ্ধারকারীরা হালিমাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করে। জ্ঞান ফেরার পর হালিমা দেখেন হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছেন। দুর্ঘটনায় হালিমা মেরুদণ্ডে আঘাত পান এবং ডান পা একেবারে থেতলে গেছে।

হালিমা আক্ষেপ করে বলেন, “আমরা মরে গেলেও দেখার কেউ নাই। চারবার অপারেশন করিয়েও পা ঠিক হয়নি, হাঁটু থেকে কোমর পর্যন্ত রড় ভরে দেওয়া হয়। অনেকদিন আগেই ইনফেকশন দেখা দেওয়ায় ডাক্তার পরামর্শ দিয়েছিলেন আরও একবার অপারেশন করতে হবে। অপারেশন করবো কোথা থেকে? খেয়েপরে বাঁচতে তো পারছি না।“

দুর্ঘটনায় আহত হাওয়া বেগম কোমরে আঘাত পেয়ে দীর্ঘদিন বিছানায় পড়ে ছিলেন। সংসার না চলায় অসুস্থ থাকা অবস্থায় বিভিন্ন কারখানায় ঘুরে চাকরি না পেয়ে অবশেষে গৃহপরিচালিকার কাজ নেন। অসুস্থ শরীর নিয়ে সেটাও করতে পারেননি। কোনো উপায় না পেয়ে এখন মানুষের কাছে হাত পাতেন। দুই মেয়ে, দুই ছেলে ও অসুস্থ স্বামী নিয়ে সংসার চালাচ্ছেন তিনি।

ঘটনার দশক পূর্ণ হওয়ায় রোববার সন্ধ্যায় ও সোমবার সকালে রানা প্লাজার সামনে অস্থায়ী বেদিতে ফুল দিয়ে নিহতের স্মরণ করেছে বিভিন্ন শ্রমিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন।

এ ছাড়া আহত শ্রমিক ও হতাহতদের পরিবারের সদস্যরাও বেদিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানায়।

এ সময় স্মৃতিচারণা করেন আহত শ্রমিক ও স্বজনরা।

তারা আক্ষেপ করে বলেন, রানা প্লাজার ধসের বর্ষপূর্তি এলে কিছু সাংবাদিকরা আসেন। কিন্তু যাদের জন্য আজ আমাদের এ অবস্থা তারা কেউ আমাদের খোঁজ-খবর নেন না।

সাভার রানা প্লাজা সারভাইবার্স অ্যাসোসিয়েশন অফ বাংলাদেশের সভাপতি মাহমুদুল হাসান হৃদয় বলেন, “রানা প্লাজার শ্রমিকরা এখন চিকিৎসার অভাবে ধুঁকে ধুঁকে মানবেতর জীবনযাপন করছেন।”

হৃদয় আরও বলেন, “বিনা চিকিৎসায় মারা যাওয়া অনেকের লাশ দাফন করার সামর্থ না থাকায় ১০ টাকা ২০ টাকা করে চাঁদা তুলে লাশ দাফন করা হয়েছে।”

রানা প্লাজা সার্ভাইভারস অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন বলেন, “রানা প্লাজার পাশের ভবনে একটি বেসরকারি অফিসে সেল্স ম্যানেজার হিসেবে কর্মরত ছিলাম। রানা প্লাজা ভেঙ্গে পরে পাশের ভবনের উপর। নিচতলার অফিসে আটকা পরি আমরাও, উদ্ধারকরা হয় সেই দিনই। কিন্তু আমার অপারেশনের মাধ্যেমে একটি হাত কেটে ফেলতে হয়।”

“আমি কী পেলাম? আমাকে দেওয়া হলো না চাকরি বা ক্ষতিপূরণ। অথচ আমি একজন মাস্টার্স পাস করা ছেলে।”