নিরাপদ সড়কের আশায় আরেকটি নিরাপদ সড়ক দিবস পালন হবে শনিবার। এর দিন কয়েক আগেও ঢাকাকে যুক্ত করা ৩ মহাসড়কে ছিল অটোরিকশার অবাধ চলাচল।
Published : 22 Oct 2022, 01:53 AM
ঢাকা মহানগরীর সীমানা পেরিয়ে চট্টগ্রাম ও সিলেট যাবার মহাসড়কে একটু পরপরই দেখা মেলে সিএনজি অটোরিকশার; এ দুই রাস্তার প্রবেশমুখে এক ঘণ্টায় শতাধিক তিন চাকার এই বাহন চোখে পড়েছে বুধবার।
কম বেশি একই চিত্র রাজধানীর অদূরের এশিয়ান হাইওয়েতেও (ঢাকা বাইপাস)। সম্প্রতি এই তিন মহাসড়ক ঘুরে ও প্রবেশমুখে অবস্থান করে তিন চাকার যানগুলোর অবাধ চলাচল দেখা গেছে; এমনকি উল্টোপথেও চলছে বেপরোয়া গতিতে।
শুধু তাই নয়, হাইওয়ে পুলিশের উপস্থিতির মধ্যেই ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কাঁচপুর সেতু দিয়ে উল্টো পথে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা ও ভ্যান চালানোকে চালকরা যেন নিয়মই বানিয়ে ফেলেছে।
এ তিন পথের মধ্যে সবচেয়ে ব্যস্ত ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কেই সবচেয়ে বেশি তিন চাকার যান চলাচল করে। গতি কিংবা চলাচলে কোনো কিছুর পরোয়া নেই এসব সিএনজি অটোরিকশার চালকদের। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিয়মিত টহলের মধ্যেই হরদম যাত্রী টানছে এসব বাহন; বেপরোয়া গতি মাঝমধ্যেই ডেকে আনছে বড় বিপদ, দুর্ঘটনায় ঘটছে প্রাণহানি।
নিয়মিত একের পর এক দুর্ঘটনার আর নিয়ম নেই জেনেও মহাসড়কের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ তিন চাকার এ বাহনের চালকরা দিনে রাতের প্রায় বড় অংশজুড়ে অনেকটা নির্বিকারভাবেই যাত্রী পরিবহন করছেন। মহাসড়কের পথে চলতে এজন্য ‘বিশেষ ব্যবস্থা’ করতে হয়েছে তাদের।
ঢাকার সীমানা ছাড়ালেই চট্টগ্রাম ও সিলেটমুখী মহাসড়কের উল্লেখযোগ্য অংশ পড়েছে নারায়ণগঞ্জ জেলায়।
চলতি মাসে তিন দিনের ব্যবধানে এ জেলার কাঁচপুর সেতুর কাছে এবং রূপগঞ্জে বাস ও মাইক্রোবাসের সঙ্গে অটোরিকশার সংঘর্ষে প্রাণ হারিয়েছেন সাতজন।
একের পর এক এমন দুর্ঘটনার পরও মহাসড়কে বাধ মানছে না তিন চাকার এ বাহন। আইনকে পাশ কাটিয়ে হরদম ছুটছে গন্তব্যে।
এই তিন মহাসড়কে চলাচলকারী সিএনজি চালকরা বলছেন, মহাসড়কে এ ধরনের যান চলাচলে নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি তারা জানেন। তবে এসব পথে গাড়ি চাললে আয়-রোজগার ভালো হয়। যে কারণে ঝুঁকি আর ধর পাকড়ের ভয়ের মধ্যেই পুলিশকে ‘মাসিক চাঁদা’ দিয়ে মহাসড়কে গাড়ি তোলেন তারা।
তবে স্থানীয় হাইওয়ে পুলিশ মাসোহারার বন্দোবস্তের সুবিধা নেওয়ার বিষয়টি মানতে নারাজ।
তাদের ভাষ্য, নিয়মিত মামলা দিয়েও মহসড়কে তিন চাকার এসব বাহনের চলাচল থামান যাচ্ছে না।
কাঁচপুর হাইওয়ে থানার ওসি নবীর হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পুলিশ কোনো প্রকার সুবিধা নেয় না। এইটা ভুল কথা। আমরা প্রতিনিয়ত সড়ক নিরাপদ রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছি।”
এছাড়া মহাসড়ক সংলগ্ন স্থানীয় এলাকাগুলোর বাসিন্দাদের যাতায়াতের জন্য মহাসড়কগুলোর পাশে বিকল্প রাস্তা তৈরির পরামর্শও এসেছে ওই এলাকায় দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যদের কাছ থেকে।
‘হুট করে সিএনজি আইয়া পড়লে সামলানো কঠিন’
নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের ১০ মাসে নারায়ণগঞ্জ জেলায় দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ৩৬ জন। এর মধ্যে এই তিন মহাসড়কে ঝরে গেছে ২৩ জনের প্রাণ। এদের মধ্যে ১০ জনের মৃত্যুই হয় তিন চাকার বাহনের সঙ্গে অন্য গাড়ির সংঘর্ষে।
গত ১ আগস্ট নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে হাইওয়ে পুলিশের ‘রিকুইজিশন করা’ মাইক্রোবাসের ধাক্কায় অটোরিকশা খাদে পড়ে চালক ও চার স্কুল শিক্ষার্থী গুরুতর আহত হয়। এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয়ে মাইক্রোবাসটি ভাঙচুর করে আগুন ধরিয়ে দেয় স্থানীয়রা।
গত ৯ অক্টোবর সিদ্ধিরগঞ্জে কাঁচপুর সেতুর পশ্চিম পাশের ঢালে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে মাইক্রোবাসের সঙ্গে উল্টো পথ ধরে আসা অটোরিকশার সংঘর্ষে অটোরিকশার চালকসহ পাঁচজন নিহত হন।
এর তিন দিন পরেই ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে রূপগঞ্জের আধুরিয়ায় বাসের ধাক্কায় সিএনজিচালিত অটোরিকশা খাদে পড়ে এক কলেজছাত্রসহ দুইজনের প্রাণ যায়। তবে এসব দুর্ঘটনা হতাহতের পরও টনক নড়েনি, একদিনও মহাসড়কে বন্ধ থাকেনি তিন চাকার বাহনগুলোর চলাচল।
কাঁচপুর সেতু এলাকার অটোরিকশা চালক মো. বাবুর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এইদিকে কয়েকদিন আগে একটা অ্যাক্সিডেন্ট হইছে। এখন পুলিশ একটু ঝামেলা করে। আবার যারা মান্থলি (মাসিক চাঁদা) করে রাখছে তাদের কিছু বলে না।”
গত ১৭ বছর ধরে কাঁচপুরের আশেপাশে প্যাডেলের রিকশা চালাচ্ছেন মিজানুর রহমান। যাত্রীর চাহিদা থাকলে তিনিও মাঝে মাঝে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে ওঠেন।
তিনি বলেন, “এইখানে যেসব অটোরিকশা চলে তারার পুলিশরে মান্থলি দিয়াই চালায়। ট্যাকা পাইয়া পুলিশও কিছু কয় না। তয় যহন কুনো ঘটনা ঘটে তহন গাড়ি আটকায়, টুকটাক মামলা দেয়। এগুলি সব দেখানোর লাইগা।”
ব্যস্ত মহাসড়কে এসব ধীরগতির তিন চাকার যান নিয়ে ঝুঁকির কথা জানালেন ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের বাসচালক সিদ্দিকুর রহমান।
“হাইওয়ের স্পিডই আলাদা। হুট করে সামনে রিকশা-সিএনজি আইয়া পড়লে সামলানো খুব কঠিন। তখনই অ্যাক্সিডেন্ট হয়। আর তখন দোষ পড়ে বড় গাড়ির ড্রাইভারের উপরে। বড় গাড়ির ড্রাইভারদের যে দোষ যে নাই তা না। কিন্তু অনেক সময় বাস-ট্রাক ড্রাইভারদের কিছু করার থাকে না,” বলেন তিনি।
দুর্ঘটনা বেড়ে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে ২০১৫ সালের অগাস্টে দেশের ২২টি মহাসড়কে তিনচাকার ও অযান্ত্রিক যানবাহন চলাচল নিষিদ্ধ ঘোষণা করে সরকার।
সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের নিজে সেসময় দেশের বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে মহাসড়ক থেকে তিন চাকার বাহনের উচ্ছেদ অভিযানে অংশ নেন। কিন্তু মহাসড়কে এসব বাহনের চলাচল থামেনি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বড় কোনো দুর্ঘটনার পর একটু হৈচৈ হয়, এরপর আবার সব আগের মত হয়ে যায়।
তিন মহাসড়কের চিত্র
ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-সিলেট ও এশিয়ান হাইওয়ের ঢাকা সংলগ্ন বড় অংশের যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলার দায়িত্ব পড়েছে কাঁচপুর হাইওয়ে থানার উপরে। এ থানার অধীনে ভুলতা ও শিমরাইলে পৃথক দুটি পুলিশ ক্যাম্পও রয়েছে।
বুধবার দুপুর একটা থেকে এক ঘণ্টা করে ঢাকা-চট্টগ্রাম ও ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে অবস্থান করে শতাধিক তিন চাকার যান চলাচল করতে দেখা গেছে। এরমধ্যে বেশি ছোট এসব বাহন ছুটতে দেখা গেছে অতিব্যস্ত ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে।
সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, নারায়ণগঞ্জের সাইনবোর্ড থেকে শিমরাইল মোড় এবং শিমরাইল থেকে কাঁচপুর সেতুর অপর প্রান্ত পর্যন্ত অধিকাংশ অটোরিকশাকে উল্টো পথে যাত্রী পরিবহন করতে দেখা যায়।
এদিন দুপুরের দিকে কাঁচপুর সেতুর পূর্বপাশের ঢালে কয়েকটি অটোরিকশা যাত্রীর জন্য অপেক্ষমান ছিল। সড়কের ঠিক উল্টো পাশেই কাঁচপুর হাইওয়ে থানা।
এর কিছু সময় পর কাঁচপুর সেতুর পশ্চিম পাশে শিমরাইল অংশে হাইওয়ে থানার একটি রেকার গাড়ি দাঁড়িয়ে ছিল; ভেতরে একজন পুলিশ সদস্যও বসে ছিলেন। এর পাশ দিয়েই উল্টো পথে বেশ কয়েকটি ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল করছিল।
ওই রাস্তায় রিকশায় চেপে উল্টো পথে ইউনিফর্ম পরে যাচ্ছিলেন এক শিক্ষার্থী। ঝুঁকি নিয়ে উল্টো পথে কেন যাচ্ছেন প্রশ্নে গিয়াসউদ্দিন মডেল কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির ওই ছাত্র বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, রূপগঞ্জ উপজেলার মিয়াবাড়ি এলাকায় তার বাসা। কলেজে যাওয়ার জন্য নিয়মিত মহাসড়কে চলাচলকারী অটোরিকশাতেই যাতায়াত করেন তিনি। কখনও পুলিশ তাদের আটকায় না।
এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হওয়ার পরপরই হাইওয়ে থানার এক পুলিশ সদস্য এসে ওই ছাত্রকে রিকশা থেকে নামিয়ে দিয়ে বিকল্প উপায়ে যেতে বলেন।
কী বলছে হাইওয়ে পুলিশ
কাঁচপুর হাইওয়ে থানার শিমরাইল ক্যাম্পের ইনচার্জ পরিদর্শক মো. শরফুদ্দিন দাবি করেন পুলিশ নিয়মিত দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে।
“নিয়মিত তিন চাকার গাড়ি আটকে মামলা দেওয়ার পরও মহাসড়কে এ যান চলাচল থামান যাচ্ছে না। সড়কে পুলিশ দাঁড়িয়ে থাকলেও সড়ক বিভাজক ঘেঁষে গাড়ি চালায় তারা। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক এতটাই ব্যস্ত যে সিগন্যাল দিয়ে থামাতে গেলে দুর্ঘটনার শঙ্কা থাকে। তারপরও পুলিশ নিয়মিত তাদের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে,” বলেন তিনি।
এছাড়া মহাসড়কে যানবাহন নিয়ন্ত্রণে জনবল সংকটের কথাও জানান পুলিশের এই কর্মকর্তা।
কাঁচপুর হাইওয়ে থানার ওসি নবীর হোসেন বলেন, “মহাসড়কের দুই পাশেই ইন্ডাস্ট্রিয়াল এলাকা (শিল্প এলাকা)। কর্মজীবী মানুষের জন্য আসলে মহাসড়কের বিকল্প সার্ভিস রুটেরও প্রয়োজন আছে।
“আমরা নিয়মিত অভিযান চালাই, মামলা দেই। তারপরও হাইওয়েতে থ্রি-হুইলার চলে। এটাকে থামানোর চেষ্টা আমরা করছি।”
তবে পুলিশের মাসোহারা নেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেন নবীর হোসেন। তার দাবি প্রতিনিয়ত সড়ক নিরাপদ করতেই কাজ করছেন না।