রোয়াংছড়ি, রুমা, থানচি ও আলীকদম উপজেলায় স্থানীয় ও বিদেশি পর্যটকের ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা ছিল প্রশাসনের পক্ষ থেকে।
Published : 13 Feb 2024, 10:08 AM
সারাদেশের ভ্রমণ পিপাসুদের আগ্রহের কেন্দ্রে পাহাড় থাকলেও ‘অভ্যন্তরীণ সংঘাতের কারণে’ গেল বছরটা ভাল যায়নি বান্দরবানের পর্যটন ব্যবসায়ীদের। এ বছর শুরুটা ভাল হয়েছে; ব্যবসায়ীদের প্রত্যাশা তারা ঘুরে দাঁড়াতে পারবেন।
পার্বত্য এই জেলা ভৌগোলিক সৌন্দর্য ও জাতিগত বৈচিত্র্যে ভরপুর। এখানকার ১১টি নৃগোষ্ঠীর মানুষ সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে বৈচিত্র্যময় জীবনধারা নিয়ে বসবাস করেন। এসবের পাশাপাশি এখানকার পাহাড় মানুষকে মন্ত্রমুগ্ধের মত টানে। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে পর্যটকরা বারবার এখানে আসেন মানসিক প্রশান্তির খোঁজে।
ব্যবসায়ীরা বলছিলেন, বছরে দুটি ঈদ, বিশেষ ছুটি কিংবা পাহাড়ের উৎসব ঘিরে পর্যটনের ব্যবসা জমজমাট থাকত। এমন দিনও গেছে; আবাসিক হোটেল-মোটেলে থাকার জায়গায় না পেয়ে রাস্তায় কিংবা মাঠে তাঁবু গেড়ে থাকতে হয়েছে পর্যটকদের। কিন্তু ২০২২ সালের মাঝামাঝি থেকে সেই পরিচিত দৃশ্য আর দেখা যাচ্ছে না।
এর কারণ হিসেবে তারা বলছিলেন, ২০২২ সালের অক্টোবর থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (যা স্থানীয়দের কাছে ‘বম পার্টি’ নামে পরিচিত) ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংঘাতের জেরে চার উপজেলা দফায় দফায় নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়ে। বিশেষ করে রোয়াংছড়ি, রুমা, থানচি ও আলীকদম উপজেলায় স্থানীয় ও বিদেশি পর্যটকের ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা ছিল প্রশাসনের পক্ষ থেকে।
এই পরিস্থিতির মধ্যেও কিছু পর্যটক শহরে এসে ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ পেত। শহরের অদূরে নীলাচল, মেঘলা ও শৈলপ্রপাত এবং বান্দরবান-থানচি সড়কে চিম্বুক ও নীলগিরি এলাকা থেকে নিরাপদে ঘুরে যেতে পারতেন পর্যটকরা। গত বছর অগাস্টে ভয়াবহ বন্যায় এর ছেদ পড়ে।
স্মরণকালের বন্যায় কয়েক দিন কার্যত বিচ্ছিন্ন ছিল বান্দরবান। সরাসরি সড়ক যোগাযোগ ও মোবাইল নেটওয়ার্ক পুরোদমেই বন্ধ ছিল। অন্যদিকে একমাস ধরে রুমা ও থানচি উপজেলার সরাসরি সড়ক যোগাযোগও বিচ্ছিন্ন ছিল।
এই সময়টায় স্থানীয়দেরও যাতায়াত করতে হত সাঙ্গু নদী পথে। প্রায় দুই সপ্তাহ বিদ্যুৎ ছিল না। প্রায় দেড় মাস পর বন্যার পরবর্তী পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে এলেও এর প্রভাব থেকে যায় পর্যটনের ক্ষেত্রে। অগাস্ট থেকে নভেম্বর পর্যন্ত এক ধরনের পর্যটকশূন্য ছিল গোটা জেলা।
এরপর যোগ হয় জাতীয় নির্বাচনের আগে লাগাতার হরতাল-অবরোধের মত অনিশ্চয়তার পরিস্থিতি। এসব কারণে আবাসিক হোটেল-মোটেল, রিসোর্ট, পর্যটকবাহী পরিবহন ও রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ীদের আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়তে হয়।
বান্দরবান আবাসিক হোটেল-মোটেল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সিরাজুল ইসলাম বলেন, “এক বছরের বেশি সময় চার উপজেলায় ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞার মধ্যে ছিল। এই সময়ে পর্যটকরা অন্যদিকে ঘুরে গেছে। পর্যায়ক্রমে সব ধরনের নিষেধাজ্ঞা উঠে গেলেও এসব খবর এখনও সবার কাছে পৌঁছায়নি। যার কারণে নিষেধাজ্ঞা না থাকলেও আমাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী পর্যটকরা এখনও আসছেন না।
“ডিসেম্বর মাসে পর্যটকরা বেশি আসে। কিন্তু এবার রাজনৈতিক পরিস্থিতির অনিশ্চয়তা আর প্রচণ্ড শীতে সেটা মার খেয়েছে। এখন তো বাচ্চাদের স্কুলই খুলে গেছে। স্বাভাবিকভাবে সবাই যে যার মত করে ব্যস্ততার জীবনে ফিরে গেছে।”
সিরাজুল ইসলাম বলেন, “আশা করছি, ফেব্রুয়ারি মাসটা ভাল যাবে। অগ্রিম বুকিং আছে।”
পর্যটন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতে, বছরব্যাপাী বিভিন্ন রকম ভ্রমণপিপাসুদের পদচারণায় মুখর থাকে বান্দরবান। এক ধরনের ভ্রমণপ্রিয় মানুষ রয়েছেন; যারা একেবারে বর্ষাকাল হলে বেড়াতে আসেন। তাদের কাছে পাহাড়ে বর্ষার প্রকৃতিরূপ অন্যরকম অনুভূতি এনে দেয়। শীতকালে আসে ট্রেকিং করা অভিযানপ্রিয় পর্যটকের দল। তারা ঝিরি-ঝরনা পেরিয়ে বিভিন্ন পাহাড়ে গিয়ে ভ্রমণ করে আসেন। আর কিছু কিছু অভিভাবক আছেন বছর শেষের দিকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের সুযোগ ছেলেমেয়েদের নিয়ে পারিবারিক ভ্রমণে বেড়াতে আসেন।
এ মাসের শুরুতে এক ছুটির দিনের সকালে বান্দরবান শহর থেকে প্রায় ৫২ কিলোমিটার দূরে জীবননগর পাহাড় পর্যন্ত গিয়ে দেখা যায়, চিম্বুক ও নীলগিরি পর্যটন কেন্দ্রের বেশ পর্যটক রয়েছেন। তবে পর্যটকদের একটা অংশ সরাসরি চলে যাচ্ছেন থানচির দিকে।
বান্দরবান-থানচি সড়কের পাশে চিম্বুক পর্যটন স্পটে টিকিট বিক্রেতা মো. হুমায়ুন কবীর বলছিলেন, ছুটির দিন বলে প্রায় এক হাজার ২০০ মত পর্যটক আসতে পারে। অন্যান্য দিনে সেটি দেড়শ থেকে ২০০ এর মত হয়।
পর্যটকের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে জানিয়ে নীলাচল পর্যটন কেন্দ্রের টিকিট কাউন্টারের তত্ত্বাবধায়ক আদিব বড়ুয়া বলেন, সেদিন হাজার তিনেকের মত টিকিট বিক্রি হয়েছে। এটা ছিল বছরে সর্বোচ্চ। অন্যান্য ছুটির দিনে ১৭০০-১৮০০টির মত টিকিট বিক্রি হয়।
মেঘলা পর্যটন কেন্দ্রের কাউন্টারে টিকিট বিক্রেতা সুকুমার তঞ্চঙ্গ্যা বলেন, এ বছরের সবচেয়ে বেশি টিকেট বিক্রি করেছেন। সেদিন ২৪০০ মত টিকেট বিক্রি হয়েছে। এর আগের ছুটির দিনে হাজার খানেকের মত টিকিট বিক্রি হত।
বান্দরবান শহরের হিলটন হোটেল এলাকা থেকে ছাড়ে সব ধরনের পর্যটকবাহী গাড়ি। এসব গাড়ির মধ্যে রয়েছে চাঁন্দের গাড়ি, ফাইভ ডোর, বি-৭০ ও ল্যান্ড ক্রুজার। যেকোনো উপজেলা এবং পর্যটন কেন্দ্রের জন্য সেখান থেকে নির্ধারিত ভাড়ায় পাওয়া যায় এসব গাড়ি। তবে অনেক পর্যটক রুমা ও থানচিতে রিজার্ভ ভাড়া না করে লোকাল বাসেও চলে যান।
এ মাস থেকে পর্যটকের সংখ্যা বাড়ছে জানিয়ে পর্যটকবাহী গাড়ির লাইন ম্যানেজার বাহাদুর মিঞা বলেন, সব মিলিয়ে ৪০০ এর ওপর পর্যটকবাহী গাড়ি রয়েছে। তার মধ্যে ছুটির দিনে চিম্বুক, নীলগিরি, নীলাচল ও মেঘলায় ভাড়ায় যায় ৩০০ মত চাঁদের গাড়ি। অন্যান্য গাড়ি যায় ৬০টির মত।
অথচ দেড় বছর ধরে সাপ্তাহিক ছুটির দিন শুক্রবার ও শনিবার ৬০টির বেশি গাড়ি ভাড়া পাওয়া যেত না।
এদিকে ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে বুকিং পাওয়ার কথা জানিয়েছেন হোটেল ব্যবস্থাপকরাও।
মেঘলায় অবস্থিত পর্যটন মোটেলের ব্যবস্থাপক মো. সোয়েব জানান, গত কয়েক মাস প্রত্যাশা অনুযায়ী পর্যটক না থাকলেও স্থানীয় ও এনজিওদের বিভিন্ন কর্মসূচি ছিল। সে কারণে মোটামুটি অতিথি ছিল।
“অনুষ্ঠানকে ঘিরে সবসময় বুকিং পেতাম। তবে তারা পর্যটক না। তবে এবার ফেব্রুয়ারি মাসে পর্যটকদের কাছ থেকে ভালই অগ্রিম বুকিং পেয়েছি। এ মাসটায় শতভাগ বুকিং রয়েছে।”
হিল ভিউ হোটেলের ব্যবস্থাপক আব্দুর রহিম বলেন, “ফেব্রুয়ারির বুকিং ভাল। আশা করা যাচ্ছে, মার্চে রমজানের শুরুর আগ পর্যন্ত ভাল পর্যটক থাকবে। তারপরও আবহাওয়া এবং দেশের পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করবে। রমজান মাসে কোনো পর্যটক থাকে না। এরপর হয়ত ঈদের জন্য আশা করতে পারি।”
মিলনছড়ি রিসোর্টের ব্যবস্থাপক রয়াল বম বলেন, স্থানীয় একটা ইস্যু ও বন্যার পরিস্থিতি মিলে ২০২৩ সালের পর্যটন ব্যবসাটা খুব খারাপভাবে গেছে। সে সময় কয়েকজন কর্মচার্রীকেও বাদ দিতে হয়েছিল। ইদানীং আবারও পর্যটক আসা শুরু করেছে।
তিনি বলেন, একসময় এই রিসোর্টে বিদেশি পর্যটকরাও ভালভাবে আসতেন। গত বছর বিদেশি পর্যটক উল্লেখ করার মত ছিল না। বিদেশিরা বেড়াতে এলে তাদের সবচেয়ে আগ্রহ থাকে এখানকার পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর জীবনধারা নিয়ে। গ্রামে গিয়ে তাদের সংস্কৃতি-জীবনধারা কাছে গিয়ে দেখতে চান তারা।
“ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞার কারণে সে সুযোগ তাদের হয়নি। শুধু শহর এলাকা এবং চিম্বুক, নীলগিরি পর্যন্ত ঘুরে বেড়ানোর অনুমতি থাকে। এ জন্য বিদেশিরা একদম আসে না বললেই চলে।’’
পর্যটকদের একটা অংশ ঘুরে বেড়ানোর পাশাপাশি বৈচিত্র্য এবং ভিন্ন স্বাদের স্থানীয় খাবার খেতে আসে বলে শহরে মধ্যমপাড়া লবিয়ত কিচেন এর স্বত্বাধিকারী উচপ্রু মারমা লাভলু জানান।
তিনি বলেন, “একসময় ব্যাম্বু চিকেন ও মুরগি লাকসুর (চাটনি) প্রতিদিন অর্ডার পেতাম। এখন ছুটির দিন ছাড়া অর্ডার আসে না। ভিন্ন স্বাদের খাবার খাওয়া এবং ট্রেকিং করার পর্যটকরা এলে আর শহরে থাকেন না। তারা সেই রুমা বগালেক, কেওক্রাডং এবং থানচির তিন্দু, বড়পাথর, রেমাক্রি, নাফাকুমের দিকে চলে যায়। যার কারণে পর্যটককেন্দ্রিক খাবার ব্যবসাও সেভাবে আর হয় না।”
বান্দরবান আবাসিক হোটেল-মোটলে মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সিরাজুল ইসলাম জানান, শহর এলাকায় বিভিন্ন মানের ৭০টি হোটেল-মোটেল-রিসোর্ট রয়েছে। এতে ৬ হাজার লোকের ধারণক্ষমতা আছে।
“আশা করি, পর্যটকরা যদি আগের মত আসে ছাড় দিয়ে হলেও আগের ক্ষতি কিছুটা পুষিয়ে নিতে পারবে।”
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে বান্দরবান রিজিয়ন ট্যুরিস্ট পুলিশ সুপার মঞ্জুর মোরশেদ বলেন, ট্যুরিস্ট পুলিশের পক্ষ থেকে পর্যটকদের ভ্রমণ সংক্রান্ত ব্যাপারে পরামর্শ ও সহযোগিতা দেওয়া হচ্ছে। বিভিন্ন সড়কের পাশে এবং হোটেল-মোটেলগুলোতে ট্যুরিস্ট পুলিশের নম্বর দেওয়া থাকে। তারা নিরাপত্তা ও ভ্রমণ সংক্রান্ত যেকোনো তথ্য ফোন করে সহযোগিতা নিতে পারে।
ট্যুরিস্ট পুলিশের যেহেতু লোকবল সংকট রয়েছে; সে কারণে উপজেলা পর্যায়ে থানার সঙ্গে সমন্বয় করে পর্যটকদের সেবা দেওয়া হচ্ছে বলে জানান পুলিশ সুপার।