Published : 27 Jul 2023, 10:39 AM
উত্তরের দুই জেলা জয়পুরহাট ও কুড়িগ্রামে গরুর লাম্পি স্কিন রোগ ছড়িয়ে পড়েছে। চিকিৎসা দিতে না পেরে দুঃশ্চিন্তায় পড়েছেন এই জনপদের খামারি ও গরু পালনকারীরা।
কয়েক মাস ধরে লাম্পি স্কিন রোগে দুই জেলায় বেশ কিছু গরুর মৃত্যু হয়েছে। তবে জেলা প্রাণি সম্পদ বিভাগের কাছে আক্রান্ত কিংবা মৃত গরুর সুনির্দিষ্ট কোনো হিসাব নেই।
কুড়িগ্রামের চিলমারী উপজেলার পাত্রখাতা, রাজারহাট উপজেলার ডাংরার বাজার, পারা মৌলা, জয়পুরহাট সদর উপজেলার গতন শহর, পাঁচবিবি উপজেলার আটাপাড়া গ্রাম, খাসবাট্টা গ্রাম, পাটাবুকা গ্রাম, কালাই উপজেলার মোসলেমগঞ্জ, আক্কেলপর উপজেলার জাফরপুর গ্রাম, ক্ষেতলাল উপজেলার বটতলী এলাকার কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে গবাদিপশুর এ রোগ ছড়িয়ে পড়ার তথ্য মিলেছে।
আমদানি করা পশুর মাধ্যমে প্রায় এক দশক আগে দেশে প্রথম রোগটি শনাক্ত হয়; তবে গত পাঁচ বছরে এর প্রাদুর্ভাব বেড়েছে বলে জানান প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা।
এ রোগে আক্রান্ত পশুর মধ্যে ২০ শতাংশ মারা যায়; বাকি ৮০ শতাংশ ভালো হয়ে গেলেও রোগটির নির্দিষ্ট কোনো ভ্যাকসিন বা চিকিৎসা নেই। গরুকে মূলত জলবসন্তের টিকাই দেওয়া হয়।
সুস্থ গরুকে এ রোগ থেকে বাঁচাতে খামার পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার বিষয়ে খামারিদের পরামর্শ দিচ্ছেন চিকিৎসকরা। তবে এ রোগে মানুষের আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা নেই।
গরু পালনকারীরা জানাচ্ছেন, গরুর শরীর প্রথমে গরম হয়ে জ্বর উঠে যায়। তারপর শরীরের কয়েক জায়গায় ছোট ছোট গুটি উঠতে শুরু করে; যা একপর্যায়ে ধীরে ধীরে সারা শরীরেই ছড়িয়ে পড়ে।
মাথা, ঘাড় ও পায়ে গুটি বেশি দেখা দেয়। এ সময় গরুর মুখ দিয়ে লালা পড়া শুরু হয় এবং গরুর খাবারে অনীহা দেখা দেয়, গরু দুর্বল হয়ে পড়ে।
এ রোগের জন্য সচেতনতা জরুরি মন্তব্য করে কুড়িগ্রামের জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মোশাররফ হোসেন বলেন, “গত এপ্রিল মাস থেকে জেলায় গরুর লাম্পি স্কিন রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। ইতোমধ্যে নাগেশ্বরী, ভূরুঙ্গামারী থেকে ২৩টি নমুনা সংগ্রহ করে বাংলাদেশ লাইফ স্টক রির্সাচ ইনস্টিটিউশনে পাঠানো হয়েছে।”
“একটা মরি গেইছে, বাকিগুলাক নিয়ে দুঃশ্চিন্তায় আছোং”
কুড়িগ্রামের চিলমারী উপজেলার রমনা মডেল ইউনিয়নের পাত্রখাতা গ্রামের রওশন আরা বেগম বাড়িতে সাতটি গরু পালছিলেন। কিছুদিন আগে লাম্পি স্কিন রোগের তার একটি গরু মারা যায়; আরও তিনটি আক্রান্ত হয়েছে। এখন এসব গরু নিয়ে দুঃশ্চিন্তায় দিন কাটছে তার।
রওশন আরা জানান, গরুগুলোকে নিজের সন্তানের মতই বড় করছিলেন তিনি। আক্রান্ত গরুগুলোর পুরো শরীর ফুলে গেছে। একটি গরুর পায়ের গোস্ত খসে পড়ছে। সরকারি কোনো পশু চিকিৎসকের দেখা না পেয়ে তিনি ‘গাছনা ওষুধ’ ব্যবহার করেছেন।
একই পরিস্থিতি রাজারহাট উপজেলার বিদ্যানন্দ ইউনিয়নের ডাংরার বাজার এলাকার আব্দুর রহমানের। বসতভিটার ৫০ শতক ছাড়া কোনো কৃষি জমি নেই তার। বাড়িতেই ছোট পরিসরে সাতটি বিদেশি গরুর খামার গড়েছেন।
আব্দুর রহমান বলেন, “অনেক আশা করি খামার দিছিলং। ১৫ দিন আগোত ৯০ হাজার টেকা দামী একটা গরু মরি গেইছে। আরও একটা গরুর সেই রোগ হইছে। বাকিগুলাক নিয়ে খুব দুঃশ্চিন্তায় আছোং। এদন হইলে হামরা ফতুর হয়া যামো।”
প্রাণিসম্পদ বিভাগের চিকিৎসকদের নাগাল না পেয়ে বাধ্য হয়ে পল্লী পশু চিকিৎসকদের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে বলে তার অভিযোগ।
একই এলাকার জোদ্দার আলী কোরবানির ঈদ সামনে রেখে একটি গরু পালছিলেন। কিন্তু ঈদের এক সপ্তাহ আগে প্রায় লাখ টাকা দামের গরুটি মারা যায়।
হতাশ কণ্ঠে তিনি বলেন, “ধার-দেনা করি খরচপাতি করি গরুটেক সগাই মিলি বড় করছিলং। হঠাৎ রোগ ধরিল। ওষুধপাতি দিয়া ডাক্তার ডাকি খুর চেষ্টা করলং। কিন্তু গরুটেক বাঁচপের পাইলং না। মেলা টেকা খরচ হয়া গেইল।”
এ ইউনিয়নের পারা মৌলায় গ্রামের বাসিন্দা নুরনাহার বেগম জানান, এ গ্রামের অনেকের গরু মারা গেছে লাম্পি স্কিন রোগে।
তিনি বলেন, “গ্রামের ফকরুল, শমসের চাচা, শাহিনা চাচী, বাবু, শরিফুল, বিপ্লব ভাই এবং শমির দাদার একটা করি গরু রোগ হয়া মারা গেইছে। গত কয়েখ মাসে হমারা তিস্তা নদীর ১৮-২০টা গরু ভাসি যাইতে দেখছি।”
একই এলাকার মনোয়ারা বেগম জানান, গ্রামের মানুষ এই রোগকে করোনা, জ্বর, আগুন ফোসকা, ডেঙ্গু বা বসন্ত রোগ বলে চেনে।
“পশু ডাক্তার চিকিৎসা দিবার আসলেও গরুত হাত দেয় না। ইনজেকশন দিলে গরু হামরা ধরি ওমরা ইনজেকশন দেয়। ওষুধ লিখে দেয়া হামরা এনে খাওয়াই। সরকারি ডাক্তারের কোনো হদিস নাই।”
বিদ্যানন্দ ইউপি চেয়ারম্যান তাইজুল ইসলাম বলেন, “বন্যার ক্ষতির পাশাপাশি অনেকের গরুর লাম্পি স্কিন রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছে। এতে করে দরিদ্র এই পরিবারগুলো কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলা করছে।”
সরকারিভাবে মাইকিং করে এলাকায় সচেতনতা বাড়ানো হচ্ছে বলে জানান তিনি।
জয়পুরহাটের পাঁচবিবি উপজেলার খাসবাট্টা গ্রামের মিঠু মিয়া বলেন, ‘সন্ধ্যায় গরু বাছুরকে খাওয়ানোর পরে রাতে গোয়ালে রাখার পর সকালে দেখি বাছুরটি খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে কাঁপতে শুরু করেছে। শরীর ফুলে গুটি গুটি হয়েছে।”
মিঠুর ভাষ্য, বাছুরটি নিয়ে তিনি অনেক চিকিৎসকের কাছেই গেছেন। কিন্তু লাভ হয়নি। শরীরের চামড়া পচে খসে পড়ে ১০-১২ দিনের পর মারা গেছে।
আক্কেলপর উপজেলার জাফরপুর গ্রামের আবু তালেব ও ক্ষেতলাল উপজেলার বটতলী এলাকার মোকাররম বললেন, এ রোগ নিরাময়ে এখনি উদ্যোগ না নিলে বড় ধরনের ক্ষতি হবে কৃষকদের।
কালাই উপজেলার মোসলেমগঞ্জ এলাকার ফারুখ হোসেন জানান, চিকিৎসকের কাছে গেলে তারা ভ্যাকসিন দেওয়ার পরামর্শ দেন। কিন্তু সরকারি ভ্যাকসিন পাওয়া যাচ্ছে না। বাজার থেকে ১ হাজার ৬০০ টাকার দামের ভ্যাকসিন ২ হাজার ৩০০ টাকায় কিনতে বাধ্য হচ্ছেন।
যা বলছেন চিকিৎসক
জয়পুরহাট ডেইরি অ্যান্ড ক্যাটল ফার্মাস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সাদমান আলিফ মিম রায়হান জয় বলেন, অধিকাংশ গবাদি পশু পালনকারী অসচেতন। গবাদি পশু পালনকারীদের সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য প্রাণিসম্পদ বিভাগকে ভূমিকা রাখতে হবে।
প্রতিষেধক না পাওয়া পর্যন্ত আক্রান্ত গরুকে বেশি পরিমাণে স্যালাইন, জ্বর হলে প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধ, খাবার সোডা খাওয়ানোর পরামর্শ দিচ্ছেন কুড়িগ্রামের জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মোশাররফ হোসেন।
এ ছাড়া আক্রান্ত গরুকে আলাদা করে মশারি দিয়ে ঢেকে রাখাসহ অন্য গরুকে মশার হাত থেকে রক্ষায় ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলছেন তিনি।
আক্রান্ত কিংবা মারা যাওয়ার প্রকৃত তথ্য না থাকার বিষয়ে তিনি বলেন, “যেসব গরু আমাদের প্রাণিসম্পদ অফিসে চিকিৎসা নিতে আসে সেগুলোর হিসাব আমরা দিতে পারি। কিন্তু বাইরেরগুলো আমাদের নজরদারিতে থাকে না ফলে সেই তথ্য আমাদের জানা থাকে না।”
জয়পুরহাট জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মাহফুজার রহমান জানান, লাম্পি স্কিন রোগ মূলত তিন ধরনের হয়। ক্যাপ্রি পক্স, এলএসডি ও গোট পক্স।
“জেলায় কৃষক ও খামারিদের আমরা প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছি। প্রতিটি উপজেলায় ভ্যাটেরিনারি সার্জনের নেতৃত্বে টিম সার্বক্ষণিকভাবে কৃষক ও খামারিদের পরামর্শ দিচ্ছেন।”
প্রতিদিন গোয়াল ঘরে নেপথলিনের ব্যবহার, গোয়াল ঘর ধোয়া, গরুকে গোসল করানো, গরমে বৈদ্যুতিক পাখার ব্যবস্থা করা, আক্রান্ত গরুকে সুস্থ গরু থেকে আলাদা করে রাখা এবং গোয়াল ঘরে মশারি খাটানোর পরামর্শ দেন এই প্রাণি সম্পদ কর্মকর্তা।