“তাকে একজন মানবিক মানুষ হিসেবে গড়ে তুলেছিলাম। আমার সেই মেয়েটাকেই তারা পৃথিবী থেকে বিদায় করে দিলো।”
Published : 03 Jun 2024, 03:53 PM
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী ফাইরোজ সাদাত অবন্তিকার আত্মহত্যার প্ররোচনার মামলার বিচার নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন তার মা তাহমিনা বেগম শবনম।
একই সঙ্গে মামলায় পুলিশের তদন্ত ও বিশ্ববিদ্যালয়ের গঠিত তদন্ত কমিটির কার্যক্রম নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন তিনি। অবন্তিকার মামলাটি যথাযথ ধারায় রেকর্ড হয়নি বলে সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন তাহমিনার আইনজীবী।
সোমবার সকাল ১০টায় কুমিল্লা নগরীর বাগিচাগাঁও এলাকায় সংবাদ সম্মেলনে এই শঙ্কা ও ক্ষোভের কথা জানান অবন্তিকার মা তাহমিনা শবনম।
তিনি বলেন, “অবন্তিকার আত্মহত্যার প্ররোচনার মামলার দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর কাজী দ্বীন ইসলাম জামিনে এসে মামলাকে প্রভাবিত করছেন।
“পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের তদন্ত কমিটির সাতদিনের মধ্যে প্রতিবেদন দেওয়ার কথা থাকলেও আড়াই মাসেও দেয়নি। এ অবস্থায় বিচার নিয়ে শঙ্কায় আছি।”
সংবাদ সম্মেলনে কান্নাজড়িত কন্ঠে তাহমিনা বলেন, “মেয়েকে এই পর্যন্ত আনতে গত ২৪ বছর ধরে আমার অনেক কষ্ট হয়েছে। কারণ অবন্তিকার বাবা গত দশ বছর আগ থেকেই অসুস্থ ছিলেন। অসুস্থ স্বামীকে দেখভাল করে আমি মেয়ের দিকেও খেয়াল রেখেছি। যার কারণে মেয়ে প্রতিটি ফলাফল ভালো করেছে।
“মৃত্যুর পর কিছুদিন আগে অবন্তিকার অষ্টম সেমিস্টারের ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে। এতো চাপের মধ্যেও মেয়েটা সিজিপিএ ৪.০০ এর মধ্যে ৩.৬৫ পেয়ে তার ব্যাচে তৃতীয় হয়েছে। আমি তাকে একজন মানবিক মানুষ হিসেবে গড়ে তুলেছিলাম। আমার সেই মেয়েটাকেই তারা পৃথিবী থেকে বিদায় করে দিলো।”
“যেদিন মেয়ের মৃত্যুর পেছনে জড়িতদের বিচার পাবো, সেদিন আমার আত্মা কিছুটা ঠান্ডা হবে।” বলেন তাহমিনা।
মামলার তদন্ত কর্মকতাসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন অবন্তিকার আত্মহত্যা মামলার বিষয়ে ‘উদাসীন’ বলেও অভিযোগ করেছেন অবন্তিকার মা। বলেন, “আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে এ ঘটনার বিচার প্রার্থনা করছি।”
সংবাদ সম্মেলনে অবন্তিকার আত্মহত্যা মামলার বাদীপক্ষের আইনজীবী মাসুদ সালাউদ্দিন বলেন, “আইনের যথাযথ ধারায় মামলাটি রেকর্ড হয়নি। মামলাটি এখন ‘ডিপ ফ্রিজে’ আছে। আমরা চাই মামলাটি যথাযথ গুরুত্বসহকারে তদন্ত করা হোক। আসামিদের ভালোভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হোক।”
মামলার অন্যতম আসামি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলাম জামিনে এসে মামলা ‘প্রভাবিত’ করার চেষ্টা করছেন বলে এ সময় অভিযোগ তোলেন মাসুদ।
মাসুদ বলেন, “তার বিষয়ে দৃষ্টি রাখার জন্য তদন্ত কর্মকর্তার প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।”
গত ১৫ মার্চ রাত ১০টার দিকে কুমিল্লা সরকারি কলেজের সাবেক শিক্ষক প্রয়াত অধ্যাপক জামাল উদ্দিনের মেয়ে অবন্তিকা কুমিল্লা নগরীর বাগিচাগাঁও ‘পিসি পার্ক স্মরণিকা’ নামের ১০ তলা ভবনের দ্বিতীয় তলার বাসায় গলায় রশি বেঁধে ফ্যানে ঝুলে আত্মহত্যা করেন।
মৃত্যুর ১০ মিনিট আগে নিজের ফেইসবুকে এক পোস্টে তিনি এ ঘটনার জন্য সহপাঠী আম্মানকে দায়ী করেছেন। একইসঙ্গে সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলামকেও এ ঘটনার জন্য দায়ী করেন।
ফেইসবুক পোস্টে অবন্তিকা লেখেন, “আমি যদি কখনও সুইসাইড করে মারা যাই তবে আমার মৃত্যুর জন্য একমাত্র দায়ী থাকবে আমার ক্লাসমেট আম্মান সিদ্দিকী, আর তার সহকারী হিসেবে তার সাথে ভালো সম্পর্ক থাকার কারণে তাকে সাপোর্টকারী জগন্নাথের সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলাম।”
অবন্তিকার মৃত্যুর খবর ক্যাম্পাসে আসার পর তার সহপাঠীসহ শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভে ফেটে পড়েন। পরদিন সকালে আম্মানকে বহিষ্কার ও দ্বীন ইসলামকে সহকারী প্রক্টরের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়ার কথা জানায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। পাশাপাশি ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক হিসেবে সাময়িক বরখাস্ত হন দ্বীন।
এদিন বেলা ৩টার দিকে ক্যাম্পাসের শান্ত চত্বর থেকে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের করেন শিক্ষার্থীরা। সেটি ক্যাম্পাস প্রদক্ষিণ করে ভিক্টোরিয়া পার্ক এলাকা ঘুরে ফের শান্ত চত্বরে এসে সমাবেশে রূপ নেয়। পরে সেখান থেকে ওই দুইজনকে গ্রেপ্তারে ২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দেওয়া হয়েছিল।
অবন্তিকার মা তাহমিনা বেগম শবনম ১৬ মার্চ রাতে কুমিল্লা কোতোয়ালি মডেল থানায় আত্মহত্যার প্ররোচনার অভিযোগে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলাম ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৩ তম ব্যাচের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী আম্মান সিদ্দিকীকে আসামি করে মামলা করেন।
ওই মামলায় গ্রেপ্তার দুই আসামির মধ্যে বর্তমানে কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগারে রয়েছেন আম্মান সিদ্দিকী। কিছুদিন আগে উচ্চ আদালতের নির্দেশে জামিনে মুক্ত হয়েছেন সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলাম।
অবন্তিকার মৃত্যুর ঘটনার পরদিন ১৬ মার্চ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক জাকির হোসেনকে আহ্বায়ক করে পাঁচ সদস্যের বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
কমিটিকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়। কিন্তু আড়াই মাস পার হলেও এখনো তদন্ত শেষ করতে পারেনি দলটি।