আদালতে ফেরার ইঙ্গিত ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আইনজীবীদের

বদলি না হওয়া পর্যন্ত দুই বিচারকের আদালত বর্জন অব্যাহত থাকবে বলেও জানান আইনজীবী সমিতির সভাপতি।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 13 Jan 2023, 03:28 PM
Updated : 13 Jan 2023, 03:28 PM

দুই বিচারক ও নাজিরের অপসারণ চেয়ে চলমান আদালত বর্জন কর্মসূচি প্রত্যাহারের ইঙ্গিত দিয়েছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা আইনজীবী সমিতির নেতারা। 

বৃহস্পতিবার রাতে ঢাকায় আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের সঙ্গে বৈঠকের পর শুক্রবার এ ইঙ্গিত দেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি তানভীর ভূইয়া। 

কর্মবিরতির আন্দোলন এবং আইনজীবী সমিতির ২৪ জনকে ঢাকায় হাই কোর্টে তলবের মধ্যে মঙ্গলবার রাতে প্রথম ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা আইনজীবী সমিতির নেতারা ঢাকার গুলশানে আইনমন্ত্রীর সঙ্গে প্রথম সাক্ষাত করে তাদের দাবি-দাওয়ার ব্যাপারে অবহিত করেন। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নেতাদের উপস্থিতিতে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আইনজীবীরা তাদের দাবি তুলে ধরে লিখিতও দেন। 

এরপর বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ৯টায় ফের আইনমন্ত্রী বাসভবনে বৈঠকে বসেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা আইনজীবী সমিতির নেতারা। রাত ১১টা পর্যন্ত চলা এ বৈঠকে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি মমতাজ উদ্দিন ফকির এবং সাধারণ সম্পাদক আব্দুন নূর দুলালও উপস্থিত ছিলেন বলে জানা গেছে। 

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বিকালে আইনজীবী সমিতির সভাপতি তানভীর ভুইয়া দাবি করেন, তাদের তিনটি দাবি মেনে নেওয়া হয়েছে। 

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এর পরিপ্রেক্ষিতে আগামী রোববার থেকে আইনজীবীরা আদালতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আগামীকাল শনিবার বিকালে সব আইনজীবীদের উপস্থিতিতে সমিতির সাধারণ সভা হবে; সেইখানেই কর্মসূচি প্রত্যাহার করার ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে ঘোষণা দেওয়া হবে।” 

তবে জেলা ও দায়রা জজ শারমিন নিগার এবং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারক মোহাম্মদ ফারুকের বদলির আগ পর্যন্ত এই দুই আদালত বর্জন অব্যাহত থাকবে বলেও জানান আইনজীবী সমিতির সভাপতি তানভীর ভুইয়া। 

এ ছাড়া নাজিরকে দ্রুত সময়ের মধ্যে বদলি দাবিও তাদের থাকবে বলে জানান তিনি। 

ব্রাহ্মণবাড়িয়া আদালতের ঘটনাক্রম

১ ডিসেম্বর: এদিন ছিল শীতকালীন ছুটির আগে আদালতের শেষ কার্যদিবস। এ দিন বেলা সাড়ে ১১টার দিকে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-১-এর বিচারক মোহাম্মদ ফারুকের আদালতে তিনটি মামলা গ্রহণ করা হয়নি। জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও সম্পাদক বিচারককে মামলা নেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। তখন বিচারক তাদের নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য করেন বলে অভিযোগ করেন আইনজীবীরা।

২৬ ডিসেম্বর: এরপর আদালতে এক মাসের শীতকালীন ছুটি শুরু হয়ে যায়। ২৬ ডিসেম্বর জেলা আইনজীবী সমিতির কার্যকরী পরিষদের সভায় বিচারক মোহাম্মদ ফারুকের আদালত বর্জনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

১ জানুয়ারি: খোলার পর বিচারক মোহাম্মদ ফারুকের আদালত বর্জন করেন আইনজীবীরা। দুপুরে একজন আইনজীবী গিয়ে আদালত বর্জনের কর্মসূচির তথ্য জানিয়ে বিচারককে এজলাস থেকে নেমে যেতে বলেন। এ নিয়ে তাদের মধ্যে বাদানুবাদ হয়। পরে সেখানে আইনজীবী সমিতির নেতারাও যান। 

এ দিনের বাদানুবাদের ঘটনার ছড়িয়ে পড়া তিন মিনিট ১৩ সেকেন্ডের একটি ভিডিওতে দেখা যায়, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারক মোহাম্মদ ফারুক এজলাসে ছিলেন। তিনি মামলা পরিচালনা করছিলেন। এ সময় কয়েকজন আইনজীবী এজলাসের সামনে গিয়ে দাঁড়ান। তাদের মধ্যে জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি তানভীর ভূঁইয়া, সম্পাদক (প্রশাসন) আক্কাস আলী, আইনজীবী জুবায়ের ইসলাম ছিলেন। তখন এজলাস ঘিরে পুলিশ সদস্যরাও ছিলেন। 

একজন আইনজীবী আদালত বর্জনের কথা বলে বিচারককে এজলাস থেকে নেমে যেতে বলেন। কথাবার্তার একপর্যায়ে আইনজীবীরা উত্তেজিত হয়ে পড়েন। এ সময় তারা বিচারকের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ এবং উচ্চস্বরে গলাগালি করেন। 

এ সময় জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি তানভীর ভূঁইয়াকে চড়া গলায়, আঙ্গুল উঁচিয়ে, ধমকের সুরে বিচারককে উদ্দেশ করে ‘নাম, নাম’ বলতেও শোনা যায়। তানভীর ভূঁইয়া বিজয়নগর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান। 

তবে তানভীর ভূঁইয়া বিচারকের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণের অভিযোগ অস্বীকার করেন।

২ জানুয়ারি: ১ জানুয়ারির ঘটনার ভিডিওটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশ পায় ২ জানুয়ারি। তখন এ নিয়ে তোলপাড়া শুরু হয়। এদিন বিচারক ফারুক এই আইনজীবীদের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার ব্যবস্থা গ্রহণের আবেদন জানিয়ে চিঠি দেন সুপ্রিম কোর্টে। 

৩ জানুয়ারি: এদিন জেলা জজ শারমিন নিগারের কক্ষে সব বিচারক সভা করেন। এতে বিচারক কার্যক্রম দুপুর পৌনে ১২টার দিকে শুরু হয়। এর আগে সকাল সাড়ে ১০টার দিকে আইনজীবীরা জেলা জজ শারমিন নিগারের আদালত এলাকার সামনে জড়ো হয়ে হই-হুল্লোড় শুরু করেন।

৪ জানুয়ারি: বিচার বিভাগীয় কর্মচারী অ্যাসোসিয়েশন এ দিন আদালতের সব এজলাসের দরজা ও প্রধান ফটকে তালা দিয়ে কর্মবিরতি পালন শুরু করে। আর আগের ঘটনা ও কর্মচারীদের কর্মবিরতির প্রতিবাদে বিক্ষোভ করে দুই বিচারকের অপসারণ ও নাজিরের দৃষ্টান্তমূলক বিচারের দাবি জানান আইনজীবীরা।

৫ জানুয়ারি: আদালতের কর্মচারীরা ৫ জানুয়ারি সকালে কর্মবিরতি প্রত্যাহার করেন। এদিন থেকেই আইনজীবীরা তিন কার্যদিবস করে কর্মবিরতির পালন শুরু করেন।

বিচারক ফারুকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ৫ জানুয়ারি হাই কোর্ট ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা আইনজীবী সমিতির তিনজনকে সশরীরে আদালতে তলব করেন।

তিন আইনজীবী হলেন- ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি মো. তানভীর ভূঁইয়া, সমিতির সম্পাদক (প্রশাসন) মো. আক্কাস আলী এবং আইনজীবী জুবায়ের ইসলাম। তাদের ১৭ জানুয়ারি হাই কোর্টে তলব করা হয়েছে।

আদালত বর্জনের কর্মসূচির মধ্যে জেলা জজ শারমিন নিগারের নামে কুরুচিপূর্ণ স্লোগান দেওয়ার অভিযোগ ওঠে আইনজীবীদের বিরুদ্ধে। তাতে এই নারী বিচারকও সুপ্রিম কোর্টে চিঠি দিয়ে প্রতিকার চান।

৯ জানুয়ারি: আইনজীবীরা আদালত বর্জনের কর্মসূচি অব্যাহত রেখে নতুন করে আরও তিনদিনের কর্মবিরতি ঘোষণা করেন।

১০ জানুয়ারি: ব্রাহ্মণড়িয়ার আদালতের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বিচারপতি জে বি এম হাসান ও বিচারপতি রাজিক আল জলিলের হাই কোর্ট বেঞ্চ স্বপ্রণোদিত হয়ে ২১ আইনজীবীকে আদালতে তলব করে একটি আদেশ দেয়।

তাদের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার রুলও জারি করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নেওয়া হবে না, তার জবাব দিতে আগামী ২৩ জানুয়ারি ওই আইনজীবীদের হাজির হতে বলা হয়েছে।

২১ আইনজীবী হলেন- ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. মফিজুর রহমান বাবুল, মো. মিনহাজুল ইসলাম, এমদাদুল হক হাদি, নিজামুদ্দিন খান রানা, আনিছুর রহমান মঞ্জু, মো. জুম্মান চৌধুরী, রাশেদ মিয়া হাজারী, জাহের আলী, মো. আবদুল আজিজ খান, দেওয়ান ইফতেখার রেজা রাসেল, মো. ছদর উদ্দিন, মাহমুদুরু রহমান রনি, মো. মাহবুবুর রহমান, মো. আরিফুল হক মাসুদ, মীর মোহাম্মদ রাইসুল আহম্মেদ, মহিবুর রহমান, মো. জাকারিয়া আহমেদ, মো. মোবারক উল্লা, মো. ফারুক আহমেদ, সফিক আহমেদ ও ইকবাল হোসেন।

এদিন রাতে গুলশানে আইনমন্ত্রীর বাসভবনে আইনজীবীরা সাক্ষাৎ করেন।

১২ জানুয়ারি: জেলা আইনজীবী সমিতির সদস্যরা সভা করে আরও তিন দিনের কর্মবিরতি ঘোষণা করেন।

১৩ জানুয়ারি: রাজধানীর গুলশানে আইনমন্ত্রীর বাসভবনে আবার ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা আইনজীবী সমিতির নেতারা সাক্ষাৎ করেন। 

আরও পড়ুন:

Also Read: ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আইনজীবীদের কর্মবিরতি অব্যাহতের ঘোষণা, ভোগান্তি

Also Read: ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বিচারককে আইনজীবীর গালাগালের ভিডিও প্রকাশ্যে

Also Read: বিচারকের সঙ্গে খারাপ আচরণের বিচার আদালত করবে: আইনমন্ত্রী

Also Read: ব্রাহ্মণবাড়িয়া আদালতে ‘কর্মবিরতি ও বর্জনে’ বিচারকাজ বন্ধ, ভোগান্তি

Also Read: বিচারকের সঙ্গে খারাপ আচরণ: দায়ীদের শাস্তি দাবি

Also Read: ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আরও ২১ আইনজীবীকে হাই কোর্টে তলব

Also Read: আরও ৩ দিন আদালত বর্জনে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আইনজীবীরা