ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আইনজীবীদের কর্মবিরতি অব্যাহতের ঘোষণা, ভোগান্তি

আগামী রোব, সোম ও মঙ্গলবার কর্মবিরতি পালন করবেন আইনজীবীরা।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 Jan 2023, 03:11 PM
Updated : 12 Jan 2023, 03:11 PM

দুই বিচারক ও নাজিরের অপসারণের দাবিতে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা আইনজীবী সমিতির আদালত বর্জন কর্মসূচি অব্যাহত রয়েছে। আরও তিন দিন আদালতে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন আইনজীবীরা।

এদিকে নিজেদের দাবি নিয়ে আইনজীবী সমিতির নেতারা আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের সঙ্গে ঢাকায় সাক্ষাৎ করেছেন; দিয়েছেন লিখিত অভিযোগ।  

বৃহস্পতিবার দুপুর আড়াইটায় জেলা আইনজীবী সমিতির বিশেষ সভায় কর্মবিরতি অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত হয় বলে জানিয়েছেন সভার সভাপতি বিলকিস সুলতানা খানম পপি।

তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “জেলা দায়রা জজ শারমিন নিগার, নারী ও শিশু নিযার্তন দমন ট্রাইব্যুনাল-১-এর বিচারক মোহাম্মদ ফারুক এবং জেলা জজ আদালতের নাজির মোমিনুল ইসলামের অপসারণ দাবিতে চলমান আন্দোলনের কর্মসূচি আরও তিন কার্যদিবস বাড়ানো হয়েছে। আগামী রোব, সোম ও মঙ্গলবার কর্মবিরতি পালন করবেন আইনজীবীরা।“

ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. মফিজুর রহমান বাবুল বলেন, “আইনজীবী সমিতির কর্মবিরতি আরও তিন দিন বাড়ানো হয়েছে। আগামী রোববারের মধ্যে যদি আমাদের দাবি মানা হয় তাহলে কর্মবিরতি তুলে নেওয়া হবে। তবে যতদিন আমাদের দাবি মানা না হবে ততদিন কর্মবিরতি চলতে থাকবে।”

আইনমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ

এই অবস্থার মধ্যেই মঙ্গলবার রাতে আইনজীবীদের একটি দল ঢাকার গুলশানে আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের বাসভবনে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।

এ সময় সেখানে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি মো. মমতাজ উদ্দিন, সাধারণ সম্পাদক আবদুন নূর, ঢাকা বার কাউন্সিলরের প্রতিনিধি সাঈদ আহমেদ, জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি তানবীর ভূঞা, সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমান বাবুল উপস্থিত ছিলেন।

মফিজুর রহমান বাবুল এ বিষয়ে বলেন, “মঙ্গলবার রাতে আমরা আইনমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেছি। আইনজীবীরা পুরো ঘটনা আইনমন্ত্রীর কাছে মৌখিক ও লিখিতভাবে তুলে ধরেছেন। দুই বিচারকের প্রত্যাহার এবং নাজির মমিমুলকে প্রত্যাহারপূর্বক শাস্তির দাবি করে আমরা লিখিত দিয়েছি।”

তিনি আরও বলেন, “আইনমন্ত্রী ব্যবস্থা নিবেন বলে আমাদেরকে আশ্বস্ত করেছেন। তিনি সমাধান করে দিলে আমরা দ্রুত কাজে যোগ দিতে পারব।”

বিচার প্রার্থীদের ভোগান্তি

এদিকে আদালতে বিচার কাজ না চলায় বিচার প্রার্থীদের ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে। বৃহস্পতিবার সকালে আদালত চত্বরে গিয়ে দেখা যায়, আইনজীবী সমিতির কার্যালয়ের সামনে আইনজীবীরা অবস্থান করছেন। বিচারকরা আদালতে এলে আইনজীবীরা এজলাসে না যাওয়ায় আদালতের বিচারিক কার্যক্রম বন্ধ আছে।

জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে আদালতে আসা সেবাগ্রহীতা ও বিচার প্রার্থীরা নিরাশ হয়ে বাড়ি ফিরে যাচ্ছেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা ও দায়রায় ১৭টি এবং মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালত ১২টি। ২৯ আদালতের বিচার কাজ বন্ধ রয়েছে। প্রতিদিন প্রতিটি কোর্টে ৫০টি মামলা ওঠে।

ঘটনাক্রম

১ ডিসেম্বর: এদিন ছিল শীতকালীন ছুটির আগে আদালতের শেষ কার্যদিবস। এ দিন বেলা সাড়ে ১১টার দিকে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-১-এর বিচারক মোহাম্মদ ফারুকের আদালতে তিনটি মামলা গ্রহণ করা হয়নি। জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও সম্পাদক বিচারককে মামলা নেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। তখন বিচারক তাদের নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য করেন বলে অভিযোগ করেন আইনজীবীরা।

২৬ ডিসেম্বর: এরপর আদালতে এক মাসের শীতকালীন ছুটি শুরু হয়ে যায়। ২৬ ডিসেম্বর জেলা আইনজীবী সমিতির কার্যকরী পরিষদের সভায় বিচারক মোহাম্মদ ফারুকের আদালত বর্জনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

১ জানুয়ারি: খোলার পর বিচারক মোহাম্মদ ফারুকের আদালত বর্জন করেন আইনজীবীরা। দুপুরে একজন আইনজীবী গিয়ে আদালত বর্জনের কর্মসূচির তথ্য জানিয়ে বিচারককে এজলাস থেকে নেমে যেতে বলেন। এ নিয়ে তাদের মধ্যে বাদানুবাদ হয়। পরে সেখানে আইনজীবী সমিতির নেতারাও যান। 

এ দিনের বাদানুবাদের ঘটনার ছড়িয়ে পড়া তিন মিনিট ১৩ সেকেন্ডের একটি ভিডিওতে দেখা যায়, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারক মোহাম্মদ ফারুক এজলাসে ছিলেন। তিনি মামলা পরিচালনা করছিলেন। এ সময় কয়েকজন আইনজীবী এজলাসের সামনে গিয়ে দাঁড়ান। তাদের মধ্যে জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি তানভীর ভূঁইয়া, সম্পাদক (প্রশাসন) আক্কাস আলী, আইনজীবী জুবায়ের ইসলাম ছিলেন। তখন এজলাস ঘিরে পুলিশ সদস্যরাও ছিলেন। 

একজন আইনজীবী আদালত বর্জনের কথা বলে বিচারককে এজলাস থেকে নেমে যেতে বলেন। কথাবার্তার একপর্যায়ে আইনজীবীরা উত্তেজিত হয়ে পড়েন। এ সময় তারা বিচারকের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ এবং উচ্চস্বরে গলাগালি করেন। 

এ সময় জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি তানভীর ভূঁইয়াকে চড়া গলায়, আঙ্গুল উঁচিয়ে, ধমকের সুরে বিচারককে উদ্দেশ করে ‘নাম, নাম’ বলতেও শোনা যায়। তানভীর ভূঁইয়া বিজয়নগর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান।  

তবে তানভীর ভূঁইয়া বিচারকের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণের অভিযোগ অস্বীকার করেন।

২ জানুয়ারি: ১ জানুয়ারির ঘটনার ভিডিওটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশ পায় ২ জানুয়ারি। তখন এ নিয়ে তোলপাড়া শুরু হয়। এদিন বিচারক ফারুক এই আইনজীবীদের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার ব্যবস্থা গ্রহণের আবেদন জানিয়ে চিঠি দেন সুপ্রিম কোর্টে। 

৩ জানুয়ারি: এদিন জেলা জজ শারমিন নিগারের কক্ষে সব বিচারক সভা করেন। এতে বিচারক কার্যক্রম দুপুর পৌনে ১২টার দিকে শুরু হয়। এর আগে সকাল সাড়ে ১০টার দিকে আইনজীবীরা জেলা জজ শারমিন নিগারের আদালত এলাকার সামনে জড়ো হয়ে হই-হুল্লোড় শুরু করেন।

৪ জানুয়ারি: বিচার বিভাগীয় কর্মচারী অ্যাসোসিয়েশন এ দিন আদালতের সব এজলাসের দরজা ও প্রধান ফটকে তালা দিয়ে কর্মবিরতি পালন শুরু করে। আর আগের ঘটনা ও কর্মচারীদের কর্মবিরতির প্রতিবাদে বিক্ষোভ করে দুই বিচারকের অপসারণ ও নাজিরের দৃষ্টান্তমূলক বিচারের দাবি জানান আইনজীবীরা।

৫ জানুয়ারি: আদালতের কর্মচারীরা ৫ জানুয়ারি সকালে কর্মবিরতি প্রত্যাহার করেন। এদিন থেকেই আইনজীবীরা তিন কার্যদিবস করে কর্মবিরতির পালন শুরু করেন।

বিচারক ফারুকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ৫ জানুয়ারি হাই কোর্ট ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা আইনজীবী সমিতির তিনজনকে সশরীরে আদালতে তলব করেন।

তিন আইনজীবী হলেন- ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি মো. তানভীর ভূঁইয়া, সমিতির সম্পাদক (প্রশাসন) মো. আক্কাস আলী এবং আইনজীবী জুবায়ের ইসলাম। তাদের ১৭ জানুয়ারি হাই কোর্টে তলব করা হয়েছে।

আদালত বর্জনের কর্মসূচির মধ্যে জেলা জজ শারমিন নিগারের নামে কুরুচিপূর্ণ স্লোগান দেওয়ার অভিযোগ ওঠে আইনজীবীদের বিরুদ্ধে। তাতে এই নারী বিচারকও সুপ্রিম কোর্টে চিঠি দিয়ে প্রতিকার চান।

৯ জানুয়ারি: আইনজীবীরা আদালত বর্জনের কর্মসূচি অব্যাহত রেখে নতুন করে আরও তিনদিনের কর্মবিরতি ঘোষণা করেন।

১০ জানুয়ারি: ব্রাহ্মণড়িয়ার আদালতের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বিচারপতি জে বি এম হাসান ও বিচারপতি রাজিক আল জলিলের হাই কোর্ট বেঞ্চ স্বপ্রণোদিত হয়ে ২১ আইনজীবীকে আদালতে তলব করে একটি আদেশ দেয়।

তাদের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার রুলও জারি করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নেওয়া হবে না, তার জবাব দিতে আগামী ২৩ জানুয়ারি ওই আইনজীবীদের হাজির হতে বলা হয়েছে।

২১ আইনজীবী হলেন- ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. মফিজুর রহমান বাবুল, মো. মিনহাজুল ইসলাম, এমদাদুল হক হাদি, নিজামুদ্দিন খান রানা, আনিছুর রহমান মঞ্জু, মো. জুম্মান চৌধুরী, রাশেদ মিয়া হাজারী, জাহের আলী, মো. আবদুল আজিজ খান, দেওয়ান ইফতেখার রেজা রাসেল, মো. ছদর উদ্দিন, মাহমুদুরু রহমান রনি, মো. মাহবুবুর রহমান, মো. আরিফুল হক মাসুদ, মীর মোহাম্মদ রাইসুল আহম্মেদ, মহিবুর রহমান, মো. জাকারিয়া আহমেদ, মো. মোবারক উল্লা, মো. ফারুক আহমেদ, সফিক আহমেদ ও ইকবাল হোসেন।

এদিন রাতে গুলশানে আইনমন্ত্রীর বাসভবনে আইনজীবীরা সাক্ষাৎ করেন।

১২ জানুয়ারি: জেলা আইনজীবী সমিতির সদস্যরা সভা করে আরও তিন দিনের কর্মবিরতি ঘোষণা করেন।

আরও পড়ুন:

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বিচারককে আইনজীবীর গালাগালের ভিডিও প্রকাশ্যে

বিচারকের সঙ্গে খারাপ আচরণের বিচার আদালত করবে: আইনমন্ত্রী

ব্রাহ্মণবাড়িয়া আদালতে ‘কর্মবিরতি ও বর্জনে’ বিচারকাজ বন্ধ, ভোগান্তি

বিচারকের সঙ্গে খারাপ আচরণ: দায়ীদের শাস্তি দাবি

Also Read: ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আরও ২১ আইনজীবীকে হাই কোর্টে তলব

Also Read: আরও ৩ দিন আদালত বর্জনে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আইনজীবীরা