“বিচারপতি লতিফুর রহমানের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার মাত্র তিন মাসে সব জঞ্জাল দূর করে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন উপহার দিয়েছিলেন”, বলেন তিনি।
Published : 25 Aug 2024, 09:54 PM
নির্বাচন প্রশ্নে অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে ‘অতি দ্রুত’ সংলাপের দাবি করার পর বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এবার বলেছেন, তারা সরকারকে সময় দিতে প্রস্তুত, তবে সেটি ‘অনির্দিষ্টকালের জন্য নয়’।
জাতির উদ্দেশে দ্বিতীয় ভাষণে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস সরকারের মেয়াদের বিষয়টি নিয়ে সুস্পষ্ট কোনো বক্তব্য না রাখার দিন রোববার সিলেটে এক আয়োজনে এই কথা বললেন দেড় যুগ ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকা দলটির নেতারা।
অবশ্য ড. ইউনূস ভাষণ দিয়েছেন সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায়, আর ফখরুল বক্তব্য রেখেছেন তার ঘণ্টা চারেক আগে।
গ্র্যান্ড সিলেট হোটেলে সাংবাদিকদের সঙ্গে জেলা ও মহানগর বিএনপি আয়োজিত মতবিনিময়ে বিএনপি মহাসচিব বলেন, “রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠান সংস্কার করে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারকে যৌক্তিক সময় সময় দিতে চাই, তবে এটি অনির্দিষ্টকালের জন্য নয়।
“বিচারপতি লতিফুর রহমানের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার মাত্র তিন মাসে সব জঞ্জাল দূর করে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন উপহার দিয়েছিলেন।”
২০০১ সালে প্রথমবারের মত বাংলাদেশের কোনো সরকারপ্রধান হিসেবে পাঁচ বছরের মেয়াদ পূর্ণ করে শেখ হাসিনা ক্ষমতা হস্তান্তর করেছিলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে। সংবিধান অনুযায়ী এই সরকারের নীতি নির্ধারণী সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা না থাকলেও সেই সরকার এই ধরনের বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নেয় এবং উচ্চ পদে অনেকগুলো রদবদল করে অক্টোবরে নির্বাচন দেয়।
সেই নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত জোট দুই তৃতীয়াংশের বেশি আসনে জিতে ক্ষমতায় আসে।
গত ৫ অগাস্ট ছাত্র-জনতার তুমুল আন্দোলনের মুখে টানা সাড়ে ১৫ বছরের শাসনের অবসান ঘটিয়ে শেখ হাসিনা ভারতে চলে যান। তিন দিন পর মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার শপথ নেয় সংবিধান মেনে চলার অঙ্গীকার করে।
সংবিধান অনুযায়ী সংসদ ভেঙে দেওয়ার ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন হতে হবে। কোনো দৈব দুর্বিপাকে সেটা করা না গেলে পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন হতে হবে।
তবে অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচন আয়োজনের সময়সীমা নিয়ে কিছু বলছে না। প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল পত্রিকায় কলাম লিখে সংবিধান স্থগিত বা রদ করার আহ্বান জানিয়েছেন।
গত ১২ অগাস্ট ড. ইউনূসের সঙ্গে মির্জা ফখরুলের নেতৃত্বে বিএনপির মতবিনিময়ে ভোটের সময়সীমা নিয়ে কোনো আলোচনা করেনি। সেদিন তিনি সাংবাদিকদেরকে বলেন, “একটা নির্দিষ্ট সময় লাগবে নির্বাচনের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করতে। আমরা তাদেরকে সেই সময়টি আমরা অবশ্যই দিয়েছি। আমরা তাদের সব বিষয়গুলোতে সমর্থন দিয়েছি।”
এর আগে ৫ অগাস্ট সরকার পতনের দিন বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে আলোচনা করে তিনি বলেছিলেন, রাষ্ট্রপতি ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচনের ঘোষণা দেবেন।
তবে শপথের দিন থেকেই অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টারা সরকারের মেয়াদ নিয়ে কোনো ইঙ্গিত না দিয়ে ‘সংস্কারের’ কথা বলে যাচ্ছেন।
জাতির উদ্দেশ্যে দ্বিতীয় ভাষণে ইউনূস নিজেও তার সরকারের মেয়াদ নিয়ে কোনো সুষ্পষ্ট বক্তব্য দেননি। তিনি বলেন, “একটা বিষয়ে সবাই জানতে আগ্রহী, কখন আমাদের সরকার বিদায় নেবে। এটার জবাব আপনাদের হাতে, কখন আপনারা আমাদেরকে বিদায় দেবেন।
“কখন নির্বাচন হবে সেটা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, আমাদের সিদ্ধান্ত নয়। দেশবাসীকে ঠিক করতে হবে আপনারা কখন আমাদের ছেড়ে দেবেন।”
তারা ছাত্রদের আহ্বানে এসেছেন জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “তারা আমাদের প্রাথমিক নিয়োগকর্তা। দেশের আপামর জনসাধারণ আমাদের নিয়োগ সমর্থন করেছে। আমরা ক্রমাগতভাবে সবাইকে বিষয়টি স্মরণ করিয়ে যাব যাতে হঠাৎ করে এই প্রশ্ন উত্থাপিত না হয় আমরা কখন যাব। তারা যখন বলবে আমরা চলে যাব। আমরা সংস্কারের অংশ হিসেবে নির্বাচন কমিশনকেও সংস্কার করব। কমিশনকে যে কোনো সময় আদর্শ নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত রাখব।”
শনিবার ঢাকায় এক আলোচনায় ফখরুল অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কারের উদ্যোগ নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলেন, আমি নির্বাচন কথাটার ওপর জোর দিতে চাই। এই যে সংস্কারের বিষয়টা এসেছে, সব সময় আসছে, সেই সংস্কারের জন্য নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সেটা কীভাবে আসবে? সেটা আসবে একটা নির্বাচিত পার্লামেন্টের মধ্য দিয়ে, তাদের মাধ্যমে সেটা আসতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।
“সুতরাং কয়েকজন ব্যক্তি একটা সংস্কার করে দিলেন এটা আমি বিশ্বাস করি না। আমি বিশ্বাস করি জনগণের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে তাদের মাধ্যমে সেই সংস্কার আসতে হবে।”
তবে ইউনূস তার সরকারের দীর্ঘ কর্মপরিকল্পনা প্রকাশ করে বলেছেন, তারা একটি ‘নতুন বাংলাদেশ’ গড়তে যান।
‘ষড়যন্ত্র চলছে’
ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতে বসে চক্রান্ত করছেন বলেও অভিযোগ করেন ফখরুল।
তিনি বলেন, ‘‘ড. মোহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন এই সরকার যখন দেশকে একটি স্থিতিশীলতার দিকে নিয়ে যাচ্ছে, দেশ যখন ঘুরে দাঁড়াচ্ছে, তখন ভারতে বসে শেখ হাসিনা দেশের বিরুদ্ধে ‘গভীর ষড়যন্ত্র’ করছেন। এটি সফল হবে না। অতীতের সকল জঞ্জালে পরিষ্কার করে সত্যিকারার্থে একটি গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়তে হবে।”
দেশের পূর্বাঞ্চলে নজিরবিহীন বন্যার জন্য ভারতকে দায়ী করে বিএনপি নেতা বলেন, “ভারত তাদের বাঁধ খুলে দেওয়ায় এই ভয়াবহ বন্যা দেখা দিয়েছে। তারা বাঁধ খুলে দেওয়ার আগে কোনো পূর্বাভাসও দেয়নি।“
উজানের পানির বেশিরভাগই ভারত থেকেই আসে জানিয়ে ফখরলে বলেন, “অভিন্ন নদীগুলোর পানিবণ্টনের কোনো সুরাহা আজও হয়নি।
“পানি আগ্রাসনকে তারা (ভারত) অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে। সিলেট থেকে এই পানি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ শুরু হয়েছিল। এম ইলিয়াস আলীর নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। যার ফলশ্রুতিতে তাকে গুম করা হয়েছে।”
‘গুম’ নিয়ে সরকারের অবস্থান অবস্থান পরিষ্কার করার আহ্বান জানান বিএনপি নেতা। তিনি বলেন, “২০১২ সাল থেকে আমরা এই সংগ্রাম করছি। সেই থেকে আমাদের প্রায় ৭০০ জন গুম করা হয়েছে, প্রায় ২ হাজার নেতাকর্মী শহীদ হয়েছেন। প্রায় ১ লক্ষ ৪৫ হাজার গায়েবি মামলা দায়ের করা হয়েছে; এসব মামলায় বিএনপির ৬০ লক্ষ নেতা-কর্মীকে আসামি করা হয়েছে।
“এম ইলিয়াস আলীসহ গুম হওয়া সবাইকে নিয়ে আমরা খুবই উদ্বিগ্ন, জাতিসংঘের একটি তদন্ত দলও এসেছে। আমরা এখনও আশাবাদী আমরা সঠিক তথ্য পাব। সরকারও সুনির্দিষ্টভাবে এখনও কিছু বলেনি। আমরা তাদের অবস্থান সম্পর্কে পরিষ্কার ভাবে জানতে চাই।”
মত বিনিময়ে সিলেট জেলা বিএনপির সভাপতি আব্দুল কাইয়ুম চৌধুরী ও মহানগর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মিফতাহ্ সিদ্দিকীও বক্তব্য রাখেন।
বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা তাহসিনা রুশদির লুনা, এনামুল হক চৌধুরী ও আরিফুল হক চৌধুরী, কেন্দ্রীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক ও সুনামগঞ্জ জেলা বিএনপির সভাপতি কলিম উদ্দিন আহমদ মিলন, জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য আবুল কাহের চৌধুরী শামীম, সিলেট জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক এমরান আহমদ চৌধুরী, মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ইমদাদ হোসেন চৌধুরীও এ সময় উপস্থিত ছিলেন।