নাটোরের চাঁচকৈড় বোর্ড স্কুলের একটি জরাজীর্ণ ঘরে ১৯৫৪ সালে যাত্রা শুরু করে ঐতিহ্যবাহী গুরুদাসপুর থানা শিক্ষা সংঘ পাবলিক লাইব্রেরি।
Published : 26 Jun 2024, 09:42 AM
অযত্ন-অবহেলা, অর্থনৈতিক সংকট আর পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে নাটোরের সবচেয়ে পুরোনো ‘গুরুদাসপুর থানা শিক্ষা সংঘ’; যা স্থানীয়ভাবে পাবলিক লাইব্রেরি হিসেবে পরিচিত। ধুলাবালি আর ময়লা জমে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে এ পাঠাগারের বহু দুর্লভ বইপত্র।
এলাকার একমাত্র পাঠাগারটি বন্ধ হতে দেখে হতাশ পাঠকরা।
অবসরে ক্যারাম ও দাবা খেলার সুযোগ থাকলেও অন্য কোনো কার্যক্রম নেই পাঠাগার পরিচালনা কমিটির। যদিও পাঠাগারটির অতীত ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে আশার কথা শুনিয়েছেন জেলা প্রশাসক।
বিলচলন শহীদ সামসুজ্জোহা সরকারি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ মো. আব্দুস সালাম বলেন, “১৯৭২ সালে রাজশাহী সমাজকল্যাণ বিভাগ থেকে প্রথম রেজিস্ট্রেশনপ্রাপ্ত হয় গুরুদাসপুর থানা শিক্ষা সংঘ। বর্তমানে আমাদের অবহেলা ও অদক্ষতার কারণে শিক্ষা সংঘ ধ্বংসের সম্মুখীন।”
এই প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন ও আধুনিকায়নে কাজ করলে নাটোর তথা চলনবিলবাসী এর সুফল ভোগ করবে বলে জানান তিনি।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, উপজেলার চাঁচকৈড় এলাকার ‘গুরুদাসপুর থানা শিক্ষা সংঘের’ তাকে তাকে সাজানো বইগুলোর গায়ে জমে থাকা ধুলা-ময়লাই বলে দিচ্ছে অনেকদিন কেউ খুলে দেখেননি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস, রাষ্ট্রীয় শাসন, ইতিহাস, দর্শন, বিশ্ব বিচিত্রা, প্রবন্ধ, ছড়া, গল্প ও কবিতার নানান বই যেন এখন উইপোঁকা আর ইঁদুরের প্রতিদিনের খাবার।
অথচ এই ‘শিক্ষা সংঘ’ই এক সময় জ্ঞানের আলো ছড়াত। খেলাধুলা, বিনোদন, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিভিন্ন জনকল্যাণমূলক কাজ পরিচালিত হত এখানে থেকেই।
আর এখন এই ঘরে ক্যারাম, দাবা খেলা আর টিভি দেখা ছাড়া নেই কোনো কার্যক্রমই। এই লাইব্রেরির পরিচালনা কমিটি থাকলেও দেখা মেলে না তাদের।
নাটোরের চাঁচকৈড় বোর্ড স্কুলের একটি জরাজীর্ণ ঘরে ১৯৫৪ সালে যাত্রা শুরু করে রাজশাহীর ঐতিহ্যবাহী ‘গুরুদাসপুর থানা শিক্ষা সংঘ’ বা পাবলিক লাইব্রেরি।
আলোর এ যাত্রার শুরুটা অধ্যাপক এম এ হামিদের হাতে হলেও পরে ছেফাতুল্লাহ তালুকদারের দানের দেড় বিঘা জমিতে নির্মিত হয় পাকা ভবন।
যার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন তৎকালীন রাজশাহীর জেলা প্রশাসক কাজী মোখলেছুর রহমান। ১৯৬৩ সালে পাঠাগারটি উন্মুক্ত হলেও দেশ স্বাধীনের পরে ১৯৭২ সালে রেজিস্ট্রেশন হয়।
এদিকে, শিক্ষা সংঘে যারা আসতেন, বই পড়তেন, বিভিন্ন সামাজিক উন্নয়নে অংশ নিতেন, তাদের কাছে এ শিক্ষালয় যেন এখন সোনালি অতীত।
অযত্ন-অবহেলায় প্রিয় প্রতিষ্ঠানটির ধ্বংস দেখে ঘুণ ধরছে তাদের রঙিন স্মৃতিতে। মুখে হতাশার ছাপ নিয়ে জ্ঞানের এই বাতিঘর রক্ষার দাবি পাঠকদের মুখে।
শিক্ষা সংঘ পাঠাগারের নিয়মিত পাঠক নাজিম উদ্দিন সরকারি স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষক মো. সরোয়ার্দি ইসলাম বলেন, “গুরুদাসপুর থানা শিক্ষা সংঘ প্রাণবন্ত, সুন্দর ও ভালো ছিল। এই প্রতিষ্ঠান আজকে মৃতপ্রায়। কালের সাক্ষী হিসেবে রাজনৈতিক, প্রশাসনিক এবং সরকারের সার্বিক প্রচেষ্টায় যেন এটি আবারও উজ্জীবিত হয়, সুন্দর হয়- এটাই আমাদের এলাকার মানুষের প্রাণের ও মনের দাবি।”
চাঁচকৈড় এলাকার আরেক বাসিন্দা সাদ্দাম হোসেন বলেন, “আমরা আগে শিক্ষা সংঘে আসতাম বই পড়তে। অনেকেই আসতো বই পড়তে। এখন দাবা আর কেরাম খেলা ছাড়া আর কোনো ব্যবস্থা নেই।
“আমরাও আসি এখন কেরাম খেলতে। নতুন প্রজন্মের কিশোর-তরুণেরা পড়ার সুযোগ পেলে খুব ভালো হবে। আমরা সংশ্লিষ্ট সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করি যেন শিক্ষা সংঘ আবার প্রাণ ফিরে পায়।”
শিক্ষা সংঘের আশপাশের বাসিন্দা জানান, এই শিক্ষা সংঘে এখন শুধু প্রতিদিন ক্যারাম ও দাবা খেলে অবসর সময় কাটাতে আসেন এলাকাবাসী। এক সময়ের পড়ালেখার সুন্দর পরিবেশ আবারও ফিরে আসবে এমন প্রত্যাশা করেন তারা।
আঁধার কেটে আবারও আলো ফুটবে এই শিক্ষা সংঘে। যে আলো ছড়িয়ে যাবে মানুষের চিন্তা-দর্শন-কর্মে, সুন্দর হবে জীবন- এমনটাই প্রত্যাশা করছেন নাটোরের বইপ্রেমীরা।
ক্রীড়াঙ্গনের মানুষ হিসেবে ভালোবাসা থেকে এখানে কাজ করে যাচ্ছেন বলে জানান পাঠাগারের তত্ত্বাবধায়ক মো. শিপন আহমেদ।
তিনি বলেন, “বিনা পারিশ্রমিকে আমি তিন বছর যাবৎ কাজ করে যাচ্ছি। যতদিন বেঁচে আছি আমি কাজ করে যাব।”
অর্থনৈতিক সংকটে শুধু বিনোদন ছাড়া পাঠাগারের অন্যান্য কার্যক্রমের সুন্দর ব্যবস্থাপনা কঠিন হয়ে পড়েছে বলে দাবি লাইব্রেরির পরিচালনা কমিটির।
শিক্ষা সংঘের সাধারণ সম্পাদক বাবুল হোসেন বলেন, “২০২২ সালে যোগদান করার পরে আমার ব্যক্তিগত তহবিল থেকে আমি শিক্ষা সংঘকে একটু সংস্কার করার চেষ্টা করি। আগে তো কেরাম, দাবা কিছুই ছিল না। এখন খেলাধুলার সুযোগটা হয়েছে। পাঠাগারে কোনো ফান্ড নেই। উপরের কর্তৃপক্ষ যদি ফান্ড দেয় আমি পাঠাগারটার ডেভেলপ করতে চাই।”
যদিও শিক্ষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিকাশের এই পাঠাগার রক্ষা ও উন্নয়নে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান জেলা প্রশাসক আবু নাছের ভুঞাঁ।
তিনি বলেন, “গুরুদাসপুর থানা শিক্ষা সংঘের ব্যাপারে আমরা সার্বিক তথ্য অনুসন্ধান করে এই প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নে বিষয় পর্যালোচনা করে যে যে পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার, আমরা করব।”