ভারপ্রাপ্ত ইউএনও বলেন, প্রাথমিকভাবে ১০টি অস্ত্র খোয়া গেছে বলে জানতে পেরেছি।
Published : 03 Apr 2024, 01:30 AM
পাহাড়ের সশস্ত্র সংগঠন কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট-কেএনএফ সদস্যরা বান্দরবানের রুমা উপজেলা সদরে সোনালী ব্যাংকে হামলা চালিয়ে টাকা-অস্ত্র লুট এবং ব্যবস্থাপককে অপহরণ করেছে বলে প্রাথমিকভাবে জানতে পেরেছে প্রশাসন।
শতাধিক সশস্ত্র ব্যক্তি মঙ্গলবার রাত ৯টার দিকে উপজেলা সদরে ব্যাংকটির শাখায় একযোগে এই হামলা চালায়। এ সময় ব্যাংকের কর্মকর্তা, নিরাপত্তা রক্ষীসহ অন্তত ২০ জনকে মারধর করা হয়। অপহরণ করা হয় এ শাখার ব্যবস্থাপক নেজাম উদ্দিনকে।
আহত ব্যক্তিদের বরাত দিয়ে রুমা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) মোহাম্মদ দিদারুল আলম রাত ১২টায় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আহতরা সবাই আমাদের বলেছেন, কেএনএফ সদস্যরা এই হামলা চালিয়েছেন এবং তাদের মারধরের পর টাকা ও অস্ত্র লুট করে নিয়ে গেছেন।"
প্রাথমিকভাবে ১০টি অস্ত্র খোয়া যাওয়ার তথ্য দিয়ে তিনি বলেন, “এখনও ভল্টটি খুলে দেখা হয়নি, ফলে কী পরিমাণ টাকা খোয়া গেছে তা এখনি বলা যাচ্ছে না। ভল্ট খুলে দেখতে হবে। আর ম্যানেজারকে তো নিয়ে গেছে।”
কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট-কেএনএফ; যারা পাহাড়ে ‘বম পার্টি’ নামে পরিচিত তাদের প্রায় ১০০ সদস্য এই হামলায় অংশ নিয়েছে বলে প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাতে বলেছেন রুমা সদর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সৈ বং মারমা।
তিনি বলেন, “এ সময় ব্যাংকের কর্মীরা নামাজ পড়ছিলেন। ঠিক তখনি হামলার ঘটনা ঘটে। এ সময় ম্যানেজারকে অপহরণের পাশাপাশি নিরাপত্তার কাজে ব্যবহৃত বেশ কিছু অস্ত্র ও মোবাইল সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা নিয়ে গেছে।”
ঘটনার পর পরই স্থানীয় সাংবাদিকরা ঘটনাস্থলে ছুটে যান। তারা সেখানকার ব্যাংক কর্মকর্তা, আহত নিরাপত্তারক্ষী ও আশপাশের লোকজনের সঙ্গে কথা বলেন। কিন্তু সেখানে সবাইকে আতঙ্কগ্রস্ত দেখতে পেয়েছেন সংবাদকর্মীরা। তারা এ বিষয় নিয়ে কথা বলতেও ভয় পাচ্ছিলেন।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা সেখানে গিয়ে জায়গাটি ঘিরে রেখেছেন। ব্যাংকের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের কয়েকজনকেও দেখা গেছে।
ব্যাংক কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপের বরাতে কয়েকজন সাংবাদিক জানাচ্ছিলেন, ঈদ, বৈসাবিকে ঘিরে পাহাড়ে সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তাদের বেতন ও বোনাস দেওয়ার জন্য মঙ্গলবার সকালেই ২ কোটি টাকার মতো রুমা শাখায় এসেছে। হামলাকারীরা চলে যাওয়ার পর জানা গেছে, এই টাকার অধিকাংশই খোয়া গেছে। তবে সেই টাকার পরিমাণ কত তা জানা যায়নি।
রুমা থানার ওসি মোহাম্মদ শাহজাহান ঘটনাস্থল থেকে বলছিলেন, “কারা এই হামলা করেছে এ ব্যাপারে আমরা যাচাই-বাছাই করছি। আর কত টাকা নিয়ে গেছে সে ব্যাপারে ভল্ট পরীক্ষা করে দেখতে হবে। ব্যাংকের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা আসছেন। তারপর ভল্টে ঢুকে সেটা দেখা হবে।”
সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আফজাল করিম বিডিনিউজ টোয়েন্টি ফোর ডটকমকে বলেন, “রাত ৯টার দিকে তারা রুমা শাখায় হামলা করেছে। কুকি চিন গোষ্ঠীর (বম পার্টি) সদস্য হতে পারে শোনা যাচ্ছে। তাদের সঠিক পরিচয় এখন পরযন্ত জানতে পারিনি। তারা আমাদের শাখা ব্যবস্থাপককে অপহরণ করে নিয়ে গিয়েছে। ম্যানেজারের খোঁজ এখনো পাইনি।
“ভল্ট ভাঙতে পেরেছে কিনা তাও সঠিক জানি না। আমরা কেবলমাত্র শুনলাম, চেষ্টা করছি তথ্য পেতে। পুলিশ ও সেনা সদস্যদের জানানো হচ্ছে।"
এই শাখায় লেনদেন কম হয়, টাকার পরিমাণ তাই অনেক কম থাকে উল্লেখ করে ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, “রুমা শাখা বান্দরবানের প্রত্যন্ত এলাকা হওয়ার শাখাটিতে সার্বক্ষণিক পুলিশ পাহারা থাকে। ব্যাংকের নিজস্ব অস্ত্রধারী নিরাপত্তা কমীও ছিল। কিন্তু সন্ত্রাসীদের হামলায় তারা টিকতে পারেনি।”
প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাতে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সোনালী ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা বলেন, “ঘটনার সময় ম্যানেজার পাশের একটি মসজিদে নামাজ পড়ছিলেন। তিনি ব্যাংকে গণ্ডগোল হচ্ছে শুনে এগিয়ে আসেন। তখন সশস্ত্র গোষ্ঠীর সদস্যরা ব্যাংকের নিরাপত্তাকর্মীদের সঙ্গে বাক-বিতণ্ডা করছিলেন। ম্যানেজারকে চিনতে পেরে তারা অপহরণ করে নিয়ে যায়।”
বান্দরবানের জেলা প্রশাসক শাহ্ মোজাহিদ উদ্দিন রাত ১১টায় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ব্যাংকের লুটের বিষয়টা এখনো স্পষ্ট নয়। ওখানে ভাঙচুর হয়েছে, ম্যানেজার অপহৃত হয়েছে। ভল্ট না খুললে বোঝা যাবে না- আসলে কী হয়েছে।”
কত টাকা লুট হয়েছে, এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, “এটা আমি বলতে পারব না। যেটা আমি জানি না তা বলতে পারব না। এ বিষয়টা স্পষ্ট (লুট) না।”
হামলায় জড়িত থাকার বিষয়ে বম পার্টির বক্তব্য জানা যায়নি।
২০২২ সালের শুরুর দিকে বান্দরবানের রুমা উপজেলায় কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) নামে একটি সশস্ত্র সংগঠনের কথা সোস্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে জানা যায়। বম, পাংখোয়া, লুসাই, খিয়াং, খুমি ও ম্রোদের নিয়ে গঠন করা হয়েছে বলে দাবি করা হলেও সেখানে বম জনোগষ্ঠীর কিছু সংখ্যক লোকজন রয়েছে। যার কারণে সংগঠনটি পাহাড়ে ‘বম পার্টি’ নামে পরিচিতি পায়।
কেএনএফের ফেইসবুক পেইজে তারা জানায়, রাঙ্গামাটি জেলার বাঘাইছড়ি, বরকল, জুরাইছড়ি বিলাইছড়ি ও বান্দরবান জেলার রোয়াংছড়ি, রুমা, থানচি, লামা ও আলীকদমসহ নয়টি উপজেলা নিয়ে ‘কুকি-চিন রাজ্য’ হিসেবে গঠন করা হবে।
পরবর্তীতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সশস্ত্র সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে তারা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে আতঙ্কে সেই সময় ভারতের মিজোরামে পালিয়ে আশ্রয় নেয় পাঁচ শতাধিক বম নারী-পুরুষ।
সশস্ত্র সংগঠনটি অর্থের বিনিময়ে নতুন জঙ্গি সংগঠন ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’ সদস্যদের সামরিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় বলে ২০২২ সালে অক্টোবর মাসে ঢাকায় সংবাদ সম্মেলন করে জানায় র্যাব।
এরপর ২০২২ সালের ১৭ অক্টোবর থেকে জঙ্গি ও কেএনএফ সদস্যদের বিরুদ্ধে রোয়াংছড়ি ও রুমা উপজেলার অভিযান চালায় র্যাব ও সেনা সদস্যের যৌথ বাহিনী। পরবর্তীতে এ অভিযান চালানো হয় থানচি উপজেলাতেও। এরই মধ্যে অভিযান চালাতে গিয়ে নিহত হয়েছে সেনাবাহিনীর বেশ কিছু সদস্যও। সংঘাতে প্রাণ গেছে কেএএনএফ সদস্যেরও।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের কারণে ২০২২ সালের অক্টোবর থেকে কয়েক দফা ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ বাড়িয়ে রোয়াংছড়ি, রুমা, থানচি ও আলীকদম উপজেলায় অনির্দিষ্টকালের জন্য দেশি-বিদেশি পর্যটক ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। পরে পর্যায়ক্রমে তিন উপজেলা থেকে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা নেওয়া হয়। কিন্তু রোয়াংছড়ি উপজেলা থেকে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা উঠে যায় ২০২৪ সালে জানুয়ারিতে।
কেএনএফকে শান্তির পথে ফেরাতে বেশ কিছু উদ্যোগ অব্যাহত রয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় তাদের সঙ্গে বেশ কয়েকবার প্রকাশ্য আলোচনা ও সমঝোতা স্মারকও স্বাক্ষর হয়েছে।
এর মধ্যেই সোনালী ব্যাংকের রুমা শাখায় হামলা ও লুটের ঘটনা ঘটল; যেখানে কেএনএফের নাম চলে এসেছে।