আরও তিন দিন ভারী বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা আছে বলে জানিয়েছে রংপুরের আবহাওয়া অফিস।
Published : 19 Jun 2024, 08:43 PM
উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল আর টানা ভারী বৃষ্টিপাতে রংপুরের তিস্তা নদীতে পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। যার ফলে ভাঙনের আতঙ্ক বাড়ছে নদীপাড়ের মানুষের মনে।
এছাড়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বন্যার পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানিয়েছে আগামী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে রংপুরের নিম্নাঞ্চলে স্বল্পমেয়াদি বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে।
রংপুর আবহাওয়া অফিসের আবহাওয়াবিদ মোস্তাফিজার রহমান জানান, মঙ্গলবার রাত থেকে বুধবার সকাল ৯টা পর্যন্ত গত ২৪ ঘণ্টায় রংপুর অঞ্চলে ২২১ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। আরও তিন দিন এ ধরণের ভারী বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা আছে।
পাউবোর নিয়ন্ত্রণ কক্ষ জানায়, বুধবার সন্ধ্যা ৬টায় তিস্তার কাউনিয়া পয়েন্টে পানি প্রবাহ ছিল ২৮ দশমিক ৮৮ সেন্টিমিটার। এই পয়েন্টে বিপৎসীমা ২৮ দশমিক ৭৫ সেন্টিমিটার ধরা হয়। এর আগে সকাল ৯টায় এই পয়েন্টে পানি প্রবাহ শূন্য দশমিক ২০ সেন্টিমিটার বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। ভোর ৬টায় ছিল বিপৎসীমার ১৫ সেন্টিমিটার ওপরে।
অপরদিকে দেশের বৃহত্তম সেচ প্রকল্প তিস্তা ব্যারেজের ডালিয়া পয়েন্টে বুধবার সন্ধ্যায় ৬টায় পানি প্রবাহ রেকর্ড করা হয় ৫১ দশমিক ৮৮ সেন্টিমিটার, এ পয়েন্টে ৫২ দশমিক ১৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হলে বিপৎসীমা অতিক্রম করে।
এর আগে সকাল ৯টায় পানি প্রবাহ রেকর্ড করা হয় ৫১ দশমিক ৯২ সেন্টিমিটার, যা বিপৎসীমার শূন্য দশমিক ২৩ সেন্টিমিটার নীচ দিয়ে প্রবাহিত হয়। সকাল ৬টায় যা রেকর্ড করা হয় ৫১ দশমিক ৯৫ সেন্টিমিটার।
সূত্র বলছে, গত ২৪ ঘণ্টায় ডালিয়া পয়েন্টে ১২০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে।
পানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জেলার কাউনিয়া, পীরগাছা ও গঙ্গাচড়া উপজেলার তিস্তা অববাহিকার বেশ কয়েকটি এলাকায় ভাঙন শুরু হয়েছে।
ভাঙনকবলিত পরিবারগুলোর অনেকে নিরুপায় হয়ে বসতি সরিয়ে নিচ্ছে। বেশ কিছু চরাঞ্চলের বাড়িঘরের চারপাশে পানি প্রবেশ করার খবর পাওয়া গেছে।
পীরগাছা উপজেলার ছাওলা ইউনিয়নের শিবদেব পানিয়ালের ঘাট এলাকায় দেখা যায়, নদীতে ঘোলা পানির স্রোত বইছে। চরের অধিকাংশ জমি পানির নিচে নিমজ্জিত। কৃষকের ফসলি জমিতে ধরেছে ভাঙন। কেউ কেউ নদীর পাড়ে বাদাম তুলে স্তূপ করে রেখেছেন।
স্থানীয়রা জানান, কয়েকদিন ধরে পানি প্রবাহ বেড়েছে। কখনো পানি বাড়ছে আবার কমছে। ফলে ভাঙন দেখা দিয়েছে।
পানিয়াল ঘাটের কৃষক আবুজাফর বলেন, “আমি দুই একর জমিতে বাদাম করেছিলাম। হঠাৎ করে নদীর পানি বেড়ে যাওয়ায় বাদাম সংগ্রহ করতে পারিনি। এতে আমার ১ লাখ টাকার বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ”
তিনি অভিযোগ করে বলেন, “চেয়ারম্যান, মেম্বার বা কেউ আমাদের খোঁজখবর নিতে আসেনি।”
আরেক কৃষক মুকুল মিয়া বলেন, “আমি ৭ দোন জমিতে বাদাম চাষ করেছিলাম। এক দোন মাটির বাদাম পানির স্রোতে ভেসে গেছে।”
কাউনিয়া উপজেলার বালাপাড়া গ্রামের বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম বলেন, নদীতে পানি বেড়ে যাওয়ায় ওই এলাকায় ভাঙন শুরু হয়েছে। গত দুই সপ্তাহে তিস্তা তীরবর্তী কয়েকটি এলাকার অন্তত ১৫-২০টি বসতঘর ও স্থাপনা নদী গর্ভে বিলীন হয়েছে। পাশাপাশি হুমকিতে রয়েছে গদাইসহ আশপাশের তিন গ্রামের কয়েকশ বসতভিটা, স্কুল ও মসজিদ।
বালাপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আনছার আলী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “তিস্তার পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় নদী তীরবর্তী ও চরাঞ্চলের মানুষদের মধ্যে আতঙ্ক রয়েছে। নদীর নিম্নাঞ্চল হালকা প্লাবিত হয়েছে। নদীর তীরবর্তী আবাদি জমিগুলো তলিয়ে গিয়ে বাদাম ও শাক-সবজিসহ উঠতি বিভিন্ন ফসলের ক্ষতি হচ্ছে।
হঠাৎ পানি বাড়ার ফলে গবাদি পশুপাখি নিয়েও মানুষজন বিপাকে পড়ার আশঙ্কা করছেন তিনি।
এ বিষয়ে কাউনিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মহিদুল হক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “তিস্তার পানি প্রবাহ বাড়ায় বন্যার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত ওই পরিমাণ পানি চরাঞ্চলে প্রবেশ করেনি। তারপরও সরকারিভাবে সব ধরনের আগাম প্রস্তুতি নেওয়া আছে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সার্বক্ষণিক নদীপাড়ের পরিস্থিতির খোঁজখবর রাখতে বলা হয়েছে।”
পীরগাছা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. নাজমুল হক সুমন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা পানি উন্নয়ন বোর্ডের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত বন্যাসংক্রান্ত খোঁজখবর রাখছি। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাওয়ার উপক্রম হলে বা গেলে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
কোনো কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকলে সরকারিভাবে সহযোগিতা করা হবে বলে জানান তিনি।
গঙ্গাচড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নাহিদ তামান্না বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, “এখনো প্লাবন পরিস্থিতি হয়নি। তবুও তারা সতর্ক রয়েছেন। নদীর চরাঞ্চলে বসবাস করা বাসিন্দাদের উঁচু জায়গায় গবাদি পশুসহ অন্যান্য সামগ্রী রাখার আহ্বান জানানো হয়েছে।”
তিনি জানান, বন্যা পরিস্থিতি হলে উদ্ধার তৎপরতার জন্য টিম প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
রংপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রবিউল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ডালিয়া ও কাউনিয়া পয়েন্টে তিস্তায় পানি বাড়তে শুরু করেছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে ডালিয়া ব্যারেজের সবকটি গেইট খুলে রাখা হয়েছে। এছাড়া ভাটির অঞ্চলে সার্বক্ষণিক নদীপাড়ের পরিস্থিতির খোঁজখবর রাখা হচ্ছে।
রংপুরের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোবাশ্বের হাসান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বন্যা মোকাবিলায় মাঠ পর্যায় উপজেলা প্রশাসনকে প্রস্তুত রাখা হয়েছে। সম্ভাব্য সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। নদী তীরবর্তী নিম্নাঞ্চল ও চরে থাকা মানুষজনকে নিরাপদে থাকার জন্য পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।”
এ বিষয়ে তিস্তা বাঁচাও, নদী বাঁচাও সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি অধ্যক্ষ নজরুল ইসলাম হক্কানি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, অসময়ের বন্যা ও ভাঙনে প্রতি বছর এক লাখ কোটি টাকার সম্পদ তিস্তার গর্ভে চলে যায়। এই সমস্যার স্থায়ী সমাধানের জন্য তিস্তা খনন, সংরক্ষণ ও তিস্তা মহাপরিকল্পনার বাস্তবায়ন করা ছাড়া বিকল্প নেই।
রংপুর বিভাগীয় কমিশনার জাকির হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, উজানের ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে উত্তরাঞ্চলের তিস্তা, ধরলা, ঘাঘট, করতোয়া, ব্রহ্মপুত্রসহ সব নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত বন্যার আভাস পাওয়া যায়নি।
“তারপরও সরকারিভাবে সব ধরনের আগাম প্রস্তুতি নেওয়া আছে, যাতে বন্যায় কেউ ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। প্রশাসনের পাশাপাশি স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক নদীপাড়ের পরিস্থিতির খোঁজখবর রাখা হচ্ছে”, বলেন বিভাগীয় কমিশনার।