“বাবার রুহানি আত্মার দাওয়াতে আমরা এখানে আসি। এবার আসার সাথে সাথে কিছু উগ্রবাদী লোক আয়োজনের বিরোধিতা করতেছে। এইটা ভালো না,” বলেন সুনামগঞ্জ থেকে আসা এক ভক্ত।
Published : 07 Dec 2024, 11:37 PM
নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার রাধানগর গ্রামে সুফি সাধক শাহ্ সোলায়মান লেংটার ১৯৬তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে বাৎসরিক উরস ও মেলার আয়োজন নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
রোববার থেকে পাঁচদিন ব্যাপী বক্তাবলী ইউনিয়নের ওই গ্রামে উরস ও মেলা শুরু হওয়ার কথা।
এ আয়োজনকে কেন্দ্র করে সারাদেশের বিভিন্ন জেলার ভক্ত ও দর্শণার্থীদের সমাগম ঘটে।
শতবছর ধরে হয়ে এলেও এবার ‘তৌহিদী জনতার’ পরিচয়ে স্থানীয় কয়েকজন ব্যক্তির আপত্তির মুখে প্রশাসনের অনুমতি মেলেনি উরস ও মেলার।
আয়োজকরা বলছেন, এ বছর স্থানীয় কয়েকজন ব্যক্তির আপত্তি ও হুমকির কারণে শনিবার রাত পর্যন্ত এ আয়োজনে প্রশাসনের অনুমতি পাওয়া যায়নি।
এ পরিস্থিতিতে অনুষ্ঠান সীমিত করে আনার সিদ্ধান্ত নিলেও আতঙ্কে আছেন আয়োজকরা।
শনিবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে মোবাইল ফোনে ডিসি মোহাম্মদ মাহমুদুল হক বলেন, “হেফাজতে ইসলামসহ স্থানীয় তৌহিদী জনতার পক্ষ থেকে এই মেলা নিয়ে আপত্তি জানানো হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বিবেচনায় রেখে আমরা বিষয়টি পর্যালোচনা করছি। তবে, এখনও মেলা আয়োজনের অনুমতি দেওয়া হয়নি।”
এর আগে ২২ নভেম্বর স্থানীয় ‘তৌহিদী জনতা’র বিক্ষোভ, হুমকির মুখে সদর উপজেলার কাশীপুর ইউনিয়নের মধ্য নরসিংহপুর গ্রামের ‘মহতি সাধুসঙ্গ ও লালন মেলার’ আয়োজন বন্ধ করে দেয় জেলা প্রশাসন। এ নিয়ে পরে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে সংবাদ প্রচার হলে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে স্থানীয় প্রশাসন।
একই পরিস্থিতিতে এবার সোলায়মান লেংটার উরস ও মেলা অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে।
আয়োজক কমিটির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ আলী বলেন, শাহ সোলায়মানের জন্মস্থান কুমিল্লায় হলেও তার আবাসভূমি ছিল রাধানগর গ্রামে। তবে তিনি দেহত্যাগ করেন চাঁদপুরের মতলবে।
এখানে তার স্ত্রী, ছেলে ও আত্মীয়দের মাজার (কবর) রয়েছে।
একশ বছরেরও বেশি সময় ধরে শাহ সোলায়মানের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে রাধানগরে উরস ও মেলার আয়োজন করা হয়।
তিনি বলেন, “নব্বইয়ের দশকে একবার এই আয়োজনে বাধা আসে। সেবার স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও গণ্যমান্য ব্যক্তিরা মিলে সমাধান করেন। তারপর এই বছর বাধা এল।”
“এখানে পীর-মুর্শিদ-পাগল-ভক্তদের মিলনমেলা হয়। ভক্তিমূলক ও আধ্যাত্মিক গান হয়। এইটাকে কেন্দ্র করে আশপাশে কিছু খাবারের দোকানও বসে। এবার কোনোকিছু হইতে দিবে না বলে হুমকি আসছে। প্রশাসনও অনুমতি দেয়নি। সবকিছু নিয়া আতঙ্কে আছি”, বলেন ৬৬ বছর বয়সি মোহাম্মদ আলী।
স্থানীয়রা জানান, গত ৩০ নভেম্বর ‘বক্তাবলী পরগনার যুবসমাজ ও সর্বস্তরের তৌহিদী জনতার’ ব্যানারে শতাধিক লোক মাদরাসা ছাত্রদের নিয়ে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করে।
ওই সময় ‘লেংটার মেলায় মাদক সেবন-বিক্রি ও অসামাজিক কার্যকলাপ চলে’ বলে অভিযোগ তুলে এ আয়োজন বন্ধের দাবি জানান তারা।
শুক্রবারও একই অভিযোগে নারায়ণগঞ্জ প্রেস ক্লাবের সামনে ব্যানার হাতে মানববন্ধন করেন তারা।
এখানে দেওয়া বক্তব্যে ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান আব্দুল কাদির বলেন, “স্পষ্ট ভাষায় বলে দিচ্ছি, লেংটার মেলার নামে অশ্লীলতা, বেহায়পনা ও অপসংস্কৃতি চলতে দিব না। সমস্ত তৌহিদী জনতা ঐক্যবদ্ধ।
“প্রশাসনের মাধ্যমে যদি এটি বন্ধ করে দেওয়া হয় তাহলে সেখানে কোনো সংঘাত-সংঘর্ষ হবে না। আর যদি প্রশাসন এটি বন্ধ না করলে তৌহিদী জনতা অবশ্যই এটি বন্ধ করে দিবে।”
শাহ সোলায়মান লেংটার উত্তরসূরি হিসেবে পরিচিত মো. আমজাদ হোসেন বলেন, “আমরা ওলি-আউলিয়াদের নিয়ে কাজ করি। আয়োজন তো বিশাল ছিল। কিন্তু আমরা কোনো সংঘাত চাই না। প্রশাসন থেকে যেহেতু অনুমতি এখনও পাইনি, তাই আমরা আয়োজন স্বল্প পরিসরে করছি।
“আমরা কি ধর্মের নামে ব্যবসা করি নাকি? যার নৈকট্যের জন্য কাজ করি, সেইটার বিচার ওই ওপরওয়ালার কাছেই ছেড়ে দিলাম।”
‘লেংটার মেলা’ উপলক্ষে সুনামগঞ্জ থেকে এসেছেন মোহাম্মদ হালিম পাগল।
মরমি সাধক লালন সাঁইয়ের এ ভক্ত গত কয়েক বছর ধরে রাধানগরে আসেন। তবে এবারের আয়োজন নিয়ে স্থানীয় কয়েকজন ব্যক্তির ‘আপত্তি ও হুমকি’তে মনক্ষুণ্ন হয়েছেন তিনি।
তার ভাষ্য, “আশেক-ভক্তদের মিলনমেলা প্রতিবছর এখানে হয়। বাবার রুহানি আত্মার দাওয়াতে আমরা আসি। এবার আসার সাথে সাথে কিছু উগ্রবাদী লোক বিরোধিতা করছেন। এইটা ভালো না। আমরা তো কারও বিরোধিতা করি না। আমরা আমাদের মত চর্চা করি। তারা তাদের মত থাকুক, আমাদেরও ভালো থাকতে দিক।”
বক্তাবলী পরগনা মাদক ও অসামাজিক কার্যকলাপ প্রতিরোধ কমিটির আহ্বায়ক মাওলানা বেলাল হোসাইন বলেন, “এটা যদি শুধু উরস হইত তাহলে আমাদের কোনো বিরোধিতা থাকত না। এখানে ছেলে-মেয়েদের অবাধ মেলামেশা চলে, গাঁজা সেবন হয়।
“গান-বাজনা চলতে পারে কিন্তু মেয়েদের দিয়ে তো গানবাজনা ঠিক না। এইগুলো তো এলাকার নারী ও যুবসমাজকে বিপথে নিয়ে যাবে।”
তিনি বলেন, “যার কারণে এলাকার সব মানুষ ওনাদের (আয়োজক) দুইমাস ধরে বুঝিয়েছেন। কিন্তু তারা কিছুতেই মানছেন না। তাই আমরা প্রশাসনকে এই মেলার অনুমতি না দিতে অনুরোধ করেছি।”
উরস শুরুর দিন স্থানীয় ঈদগাহে শাহ সোলায়মান ও কবরবাসীদের রুহের মাগফেরাত কামনায় ইসলামী মহাসম্মেলনের আয়োজন করার কথাও জানান তিনি।
এদিকে, উরস ও লেংটার মেলাকে ঘিরে কোনো প্রকার যাতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি না ঘটে সে ব্যাপারে গোয়েন্দা নজরদারি থাকবে বলে জানান ফতুল্লা মডেল থানার ওসি শরীফুল ইসলাম।
তিনি বলেন, “লেংটার মেলার অনুমতি প্রশাসন থেকে দেওয়া হয়নি। তারপরও যেকোনো ধরনের অপ্রীতিকর পরিস্থিতি যাতে না ঘটে সেজন্য রোববার সকাল থেকেই সেখানে পুলিশের উপস্থিতি ও গোয়েন্দা নজরদারি থাকবে।”
আরও পড়ুন: