রাঙামাটির কাপ্তাই ইউনিয়নে সদস্য পদপ্রার্থী সজিব হত্যা মামলার দুই নম্বর আসামি ইমাম আলী এ আইনের বলে বিনাভোটে নির্বাচিত হয়েছেন।
Published : 01 Nov 2022, 05:58 PM
ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে একটি ওয়ার্ডে সদস্য পদপ্রার্থী ছিলেন দুজন; ভোটের আগে তাদের একজন খুন হন এবং সেই খুনের মামলার আসামি হয়ে জেলে যান অন্যজন। সাড়ে তিন মাস পর জামিনে বেরিয়ে এলে আইন অনুযায়ী একমাত্র প্রার্থী হিসেবে তাকেই বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী ঘোষণা করেন রিটার্নিং কর্মকর্তা।
২০২১ সালে এভাবে বিনাভোটে নির্বাচিত, খুনের মামলার আসামি ইমাম আলী এখন রাঙামাটির কাপ্তাই ইউনিয়ন পরিষদের ৫ নম্বর ওয়ার্ডে সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
ওই ওয়ার্ডের সদস্য পদপ্রার্থী সজিবুর রহমান সজিব মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিন রাতে খুন হন; তারপর ইমামই ছিলেন সেখানে একমাত্র প্রার্থী।
“একজন প্রার্থী অন্য প্রার্থীকে হত্যা করে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার সংস্কৃতি‘যেন চালু না হয়, সেজন্য আইন সংশোধনের দাবি জানিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের কাপ্তাই ইউনিয়ন কমিটি।
কাপ্তাই ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের প্যাডে প্রায় ৫০০ জনের স্বাক্ষর সম্বলিত একটি স্মারকলিপি মঙ্গলবার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মুনতাসির জাহানের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানো হয়। অনুলিপি দেওয়া হয়েছে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) ও নির্বাচন কমিশনের সচিবকেও।
কাপ্তাই উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অংসুইছাইন চৌধুরী এবং কাপ্তাই উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মফিজুল হকের নেতৃত্বে নেতাকর্মীরা গিয়ে সেই স্মারকলিপি দেন।
ভোট গ্রহণের আগে প্রার্থীর মৃত্যু হলে কী করতে হবে, সেই নিয়ম বলা আছে স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন পরিষদ) নির্বাচন বিধিমালা-২০১০ এর ২০ (৪) ধারায়।
“ভোট গ্রহণের পূর্বে সংরক্ষিত আসনের সদস্য বা সাধারণ আসনের সদস্য পদে মনোনীত বৈধ কোনো প্রার্থীর মৃত্যু হইলে ভোটগ্রহণ অবশিষ্ট প্রার্থীগণের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকিবে।”
নির্বাচন কমিশনের এই বিধানের কথা উল্লেখ করে কাপ্তাই ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের স্মারকলিপিতে বলা হয়, “… এই রকম আইন যদি নির্বাচন কমিশনে থেকে থাকে, তাহলে দেশের প্রতিটি ইউনিয়ন পরিষদে প্রতিটি ওয়ার্ডে মেম্বার নির্বাচনে দুইজন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী থাকলে, একজন প্রার্থী অন্য প্রার্থীকে হত্যা করে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার সংস্কৃতি চালু হয়ে যাবে এবং সন্ত্রাসীরা বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে জনপ্রতিনিধির মুখোশ পরে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালানোর উৎসাহ পাবে। তাই আমরা নিম্নে স্বাক্ষরকারীরা উক্ত আইন সংশোধনের আবেদন করছি।”
২০২১ সালের ১১ নভেম্বর কাপ্তাই ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের ভোট হয়। ৫ নম্বর ওয়ার্ডে দুইবারের সদস্য ও রাঙামাটি জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সদস্য সজিবুর রহমানের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামেন ইমাম আলী। ২৬ অক্টোবর ছিল মনোনয়ন প্রত্যাহারের শেষ দিন।
আওয়ামী লীগের স্মারকলিপিতে বলা হয়, “মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার পর থেকেই ইমান আলী তার প্রতিদ্বন্দ্বী সজিবুর রহমান সজিবকে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের জন্য নানানভাবে চাপ প্রয়োগ করতে থাকেন। সর্বশেষ মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিন ২৬ অক্টোবর সজিবুর রহমান সজিব মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার না করায় একইদিন রাতে কাপ্তাই নতুনবাজার এলাকায় কিছু মাদকাসক্ত, মাদক ব্যবসায়ী, হত্যাসহ একাধিক মামলার আসামি এবং ইউপি সদস্য প্রার্থী ইমান আলীসহ ৪০ থেকে ৫০ জন চিহ্নিত সন্ত্রাসী সজিবুর রহমান সজিবকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করে।”
হত্যাকাণ্ডের পরের দিন ২৭ অক্টোবর সজিবের বোন বাদী হয়ে ৩২ জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাতপরিচয় আরও কয়েকজনকে আসামি করে হত্যা মামলা করেন। মামলায় ইমাম আলীকে দুই নম্বর আসামি করা হয়।
আসামি ইমাম আলী আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন চাইলে বিচারক তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। প্রায় সাড়ে তিন মাস জেল খেটে তিনি জামিনে বেরিয়ে আসেন।
সজিবের হত্যাকাণ্ডের পর নির্বাচন কমিশন ওই ওয়ার্ডে ভোট স্থগিত ঘোষণা করেছিল। কিন্তু পরে নিয়ম অনুযায়ী ইমামকেই নির্বাচিত ঘোষণা করা হয়।
কাপ্তাই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান প্রকৌশলী আব্দুল লতিফ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “নির্বাচন কমিশন ইমাম আলীকে নির্বাচিত ঘোষণা করার পর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তাকে শপথ পাঠ করান এবং আমাকে তার কাজে সহযোগিতা করার জন্য বলেন। কিন্তু আমি তাকে নিয়ে খুব বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্যে আছি।
“নির্বাচন কমিশনের আইনের কারণে একজন খুনের মামলার আসামি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছে। তার সঙ্গে আমাকে ইউনিয়ন পরিষদের কার্যক্রম চালাতে হচ্ছে। এটা আমার জন্য খুবই বিব্রতকর।”
ইউপি চেয়ারম্যান বলেন, “আমি নির্বাচন কমিশনের কাছে অনুরোধ করব এই আইন সংশোধনের জন্য। কারণ, এমন একটি আইন থাকলে যে কেউ এর সুযোগ নিতে পারে।”
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে কাপ্তাইয়ের উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা তানিয়া আক্তার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে কোনো ওয়ার্ডে শুধুমাত্র দুজন সদস্য পদপ্রার্থী থাকলে তাদের মধ্যে যে কোনো একজন মৃত্যুবরণ করলে অন্যজনকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সদস্য পদে নির্বাচিত ঘোষণা করার বিধান নির্বাচন কমিশনের আইনে আছে। আমরা নির্বাচন কমিশনের নির্দেশ পালন করেছি মাত্র।”
ইসি সচিবালয়ের সহকারী সচিব আশফাকুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন পরিষদ) নির্বাচন বিধিমালা অনুযায়ী (বিধি-২০) ভোটের আগে বৈধ প্রার্থীর মৃত্যু হলে চেয়ারম্যান পদের ক্ষেত্রে নির্বাচন বাতিল হবে এবং নতুন তফসিল হবে। কিন্তু সদস্য পদপ্রার্থীর মৃত্যু হলে ভোট বাকিদের মধ্যে হবে।
বিধি সংশোধনের আবেদন বা দাবি থাকলে তা নির্বাচন কমিশনে পাঠালে এ নিয়ে কমিশনই সিদ্ধান্ত নিতে পারে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
“যে কোনো বিধি সংশোধন করার ক্ষমতা ইসির রয়েছে। সেক্ষেত্রে কমিশন সিদ্ধান্ত নিলে আইন মন্ত্রণালয়ের ভেটিং শেষে তা গেজেট আকারে প্রকাশ করতে পারে ইসি। এজন্য মন্ত্রিসভার অনুমোদন বা সংসদে পাঠানোর প্রয়োজন নেই।”
এ বিষয়ে কথা বলার জন্য কাপ্তাই ইউনিয়ন পরিষদের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য ইমাম আলীকে মঙ্গলবার বিকালে বেশ কয়েকবার ফোন করলেও তিনি ধরেননি। এসএমএস পাঠিয়েও তার সাড়া মেলেনি।
কাপ্তাই উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অংসুইছাইন চৌধুরী মঙ্গলবার স্মারকলিপি দেওয়ার পর সাংবাদিকদের বলেন, “আজকে আমরা এই কালো আইন বাতিলের দাবিতে প্রধানমন্ত্রীর বরাবরে স্মারকলিপি দিয়েছি। একটি ওয়ার্ডে দুজন প্রার্থীর মধ্যে একজন সন্ত্রাসী কর্তৃক নিহত হলে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় অপর প্রার্থীকে নির্বাচিত করার যে বিধান নির্বাচন কমিশনে আছে আমরা সেই আইন বাতিল চাই।”
কাপ্তাই উপজেলার চন্দ্রঘোনা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আক্তার হোসেন মিলন বলেন, “এটি একটি ভয়াবহ আইন। আমরা এই আইন বাতিল এবং সংশোধনের দাবি জানাই।”
একই দাবি করেন কাপ্তাই উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সাগর চক্রবর্তীও।
সজিব হত্যা মামলার অগ্রগতি জানতে চাইলে তদন্ত কর্মকর্তা ও কাপ্তাই সদর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মোহাম্মদ আক্তার হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “তদন্ত কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। মামলায় ৩২ জন আসামির নাম উল্লেখ করা হয়েছে। ইউপি সদস্য ইমাম আলী ২ নম্বর সদস্য। তিনি আত্মসমর্পণ করে সাড়ে তিন মাস কারাগারে ছিলেন। পরে জামিনে বেরিয়ে আসেন।”
স্মারকলিপি প্রদান কর্মসূচিতে কাপ্তাই উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ও কাপ্তাই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান প্রকৌশলী আবদুল লতিফ, চন্দ্রঘোনা ইউপি চেয়ারম্যান আক্তার হোসেন মিলন, ওয়াগ্গা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান চিরঞ্জিত তনচংগ্যা, কাপ্তাই উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সাগর চক্রবর্তী, কাপ্তাই উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান ও উপজেলা যুবলীগের সভাপতি নাছির উদ্দীন, কাপ্তাই ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আকতার আলম, সাংগঠনিক সম্পাদক শওকত আলী, মানবসম্পদ বিষয়ক সম্পাদক আনোয়ার হোসেন, প্রচার সম্পাদক সুলতান আহমদ, সহপ্রচার সম্পাদক রঞ্জিত মল্লিক, কাপ্তাই ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ নেতা মোহাম্মদ আলী, কাপ্তাই ইউনিয়ন কৃষক লীগের সভাপতি চাইথোয়াই মারমা, কাপ্তাই উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি এম নুর উদ্দিন সুমন, কাপ্তাই ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি মহিম উদ্দিন, কাপ্তাই ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতি জহিরুল ইসলাম, সাবেক সভাপতি মো. রাসেল উপস্থিত ছিলেন।
আরও পড়ুন