সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুর থেকে শাহজাদপুরের হাঁটপাচিল পর্যন্ত যমুনা নদীর ডান তীর রক্ষায় সাড়ে ছয় কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে ৬৫৩ কোটি টাকা।
Published : 02 Nov 2024, 11:15 AM
যমুনা পাড়ের বাসিন্দা রাবেয়া খাতুনের বাড়ি অনেক আগেই নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। কোনো উপায়ন্তর না পেয়ে তিনি প্রায় দুই কিলোমিটার উজানে এসে অন্যের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। কারণ, নতুন জায়গা কিনে ঘর উঠানোর মত অবস্থা তার ছিল না।
রাবেয়া বুধবার সিরাজগঞ্জের চৌহালী উপজেলার জালালপুর ইউনিয়নের সৈয়দপুর পূর্বপাড়ার কবরস্থানের পাশের রাস্তায় দাঁড়িয়ে যমুনার দিকে হাত তুলে দেখাচ্ছিলেন, নদীর প্রায় দুই কিলোমিটার ভিতরে তার বসতবাড়ি ছিল। সেটি নদীতে নিয়ে গেছে।
এখন তিনি যে জায়গায় বসবাস করছেন, সেটিও ভাঙনের মুখে। রাবেয়া খাতুনের চিন্তা, এবার তিনি কোথায় গিয়ে মাথা গোঁজার ঠাঁই পাবেন।
বছর চল্লিশের রাবেয়ার দিনমজুর স্বামী অসুস্থ; বেশিরভাগ সময় তাকে বিছানায় পড়ে থাকতে হয়। তিনি আগে রিকশা, ভ্যান চালানো থেকে নানা কাজ করতেন। কিন্তু বাড়ির সামনে দিয়ে পুরনো যে বেড়িবাঁধ গেছে সেটি সংস্কারের কারণে এখন ছোটখাট যানবাহন চলাচলের অনুপযোগী। ফলে রাবেয়ার স্বামীরও কোনো কাজ নেই।
রাবেয়া খাতুন মানুষের বাড়িতে কাজ করে কোনো রকমে সংসারটা ধরে রেখেছেন। এর মধ্যে নদী ভাঙনের কারণে নিজের আর ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যত চিন্তায় তিনি অস্থির।
রাবেয়ার মতো অবস্থা জালালপুর ইউনিয়নের সৈয়দপুর পূর্বপাড়ার অনেক বাসিন্দার। তাদের দাবি, চৌহালী উপজেলার এনায়েতপুর থেকে শাহজাদপুরের হাঁটপাচিল পর্যন্ত যমুনা নদীর ডান তীর রক্ষা বাঁধ নির্মাণকাজটি হলে তারা কিছুটা হলেও নিজেদের বাড়ি-জমি, সহায়-সম্পদ রক্ষা করতে পারতেন।
স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, এ প্রকল্পে সময়ক্ষেপণ করা হচ্ছে। আর এ কারণে নদী ভাঙনের কবলে পড়ে নদীতীরের হাজারো বিঘা আবাদি জমি, শত শত বসতভিটা, স্কুল-কলেজ, মাদরাসাসহ বিভিন্ন স্থাপনা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) জানায়, সাড়ে ছয় কিলোমিটার দীর্ঘ এ প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ৬৫৩ কোটি টাকা। ২০২১ সালের জুনে একনেকে এ প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হয়। এরপর ছোট-বড় ৩৭টি প্যাকেজে এ প্রকল্পের টেন্ডার আহ্বান করে পাউবো সিরাজগঞ্জ জেলা কার্যালয়।
২০২২ সালের শুরুতে তিন বছর মেয়াদি এ প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। বার বার প্রকল্পের কাজ বন্ধ থাকায় নির্ধারিত সময়ে প্রকল্প কাজে দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি হয়নি। ২০২৫ সালের জুনে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে।
তবে এখনও কোনো কোনো ঠিকাদার কাজই শুরু করেনি বলে অভিযোগ করেছেন স্থানীয়রা। যদিও পাউবো বলছে, যেসব ঠিকাদার কাজ শুরু করেনি তাদের নোটিশ দেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে প্রকল্পের ৪১১ কোটি টাকা প্রাপ্ত বরাদ্দের মধ্যে ২৮১ কোটি টাকা ঠিকাদারদের বিল প্রদান করা হয়েছে।
এ প্রকল্পে নদী ড্রেজিং, ব্লক নির্মাণ ও ব্লক সেটিংয়ের মাধ্যমে সাড়ে ছয় কিলোমিটার এলাকায় নদীর তীর সংরক্ষণে নতুন বাঁধ নির্মাণ করা হবে। এ ছাড়া অতীতে নির্মিত এনায়েতপুর ও বেতিল স্পার সংস্কার এবং নতুন নদীতীর সংরক্ষণ বাঁধের পিছনে অবস্থিত পুরাতন বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ সংস্কারের কথা রয়েছে।
‘মানুষকে কবর দেওয়ার উপায়ও থাকবে না’
বুধবার নদীতীরের সৈয়দপুর পূর্বপাড়া এলাকায় গেলে প্রকল্প নিয়ে ভুক্তভোগীরা নানা অভিযোগ করেন। এদিন তারা গ্রামের কবরস্থানের সামনের রাস্তায় মানববন্ধন করেন। এতে স্থানীয় বাসিন্দা, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীসহ শত শত মানুষ অংশ নেন। কবরস্থানের সামনেই যমুনা নদী।
মানববন্ধনে অংশ নিতে এসেছেন স্থানীয় বাসিন্দা হাজী আব্দুস সালাম। তিনি বলছিলেন, “পানি কমতে শুরু করায় নতুন করে নদীতীরে ভাঙন শুরু হয়েছে। এ নিয়ে মানুষের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে।
পেছনে থাকা পুরাতন সৈয়দপুর পূর্বপাড়া কবরস্থানটি দেখিয়ে তিনি বলেন, “নদী থেকে মাত্র ১০ হাত দূরে এটি। এখানে অনেকের বাপ-দাদার কবর রয়েছে। আশপাশে আর কোনো কবরস্থান নেই।
“এই কবরস্থানটি নদীতে বিলীন হলে মৃতকে দাফন করার জন্য এ এলাকার আর কোনো উপায় থাকবে না।”
স্থানীয় স্কুল শিক্ষক আব্দুল হান্নান বলেন, গত কয়েক বছরে এনায়েতপুর থেকে পাঁচিল পর্যন্ত এলাকার অন্তত ৩০টি স্কুল, কলেজ, মাদরাসাসহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। এখনও নদীতীরের শত শত বিঘা আবাদি জমি ও বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভাঙনের ঝুঁকিতে রয়েছে।
স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতির অভিযোগ
ছয় কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণ ও সংস্কার কাজে দুর্নীতির অভিযোগ করেছেন জালালপুর ইউনিয়ন বিএনপির সিনিয়র সহসভাপতি ওসমান গণি।
তার অভিযোগ, “পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব কবির বিন আনোয়ার তার পছন্দের লোকজনকে কাজ দিয়েছিলেন। প্রকল্পের অনেক গ্রুপের কাজ এখনও শুরুই হয়নি। অথচ ঠিকাদাররা কোনো কাজ না করেই মোটা অংকের বিল তুলে নিয়েছেন।”
তিনি বলেন, তিন-চার বছরে প্রায় চার মাইল এলাকা ভেঙে নদীতে বিলীন হয়ে যমুনা নদী গ্রামগুলোর কাছে চলে এসেছে। প্রকল্পের কাজে তীরগতির কারণে এরই মধ্যে হাটপাঁচিল, ভেকা, সৈয়দপুর, পাকরতলা, বাঐখোলা, রঘুনাথপুর, ঘাটাবাড়ি, জালালপুর ও রূপসী গ্রাম নদীতে বিলীন হয়ে গেছে।
জালালপুর ইউনিয়ন বিএনপির সাবেক সভাপতি আব্দুর রশিদও অনিয়মের অভিযোগ করে বলেন, “এখানে প্রকল্প বাস্তবায়নের নামে কোটি কোটি টাকা হরিলুট করা হয়েছে। কিছু কাজ করা হলেও তা পুনরায় নদীতে বিলীন হয়ে গেছে।”
অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে প্রকল্পে লুটপাটের তদন্ত এবং ঠিকাদার ও পাউবো কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ারও দাবি করেন বিএনপি নেতা। অন্যথায় ছাত্র-জনতাকে সঙ্গে নিয়ে কঠোর আন্দোলনের হুমকি দেন তিনি।
নদী বাচাঁও আন্দোলন শাহজাদপুর উপজেলা শাখার সভাপতি ফারুক রেজা বলেন, কয়েক বছরে নদী ভাঙনের কবলে পড়ে বসতবাড়ি ও আবাদি জমি হারিয়ে এ অঞ্চলের হাজারো মানুষ নিঃস্ব হয়ে গেছে।
“ঠিকাদাররা প্রকল্প বাস্তবায়নের নামে কোটি কোটি টাকা ভাগ-বাটোয়ারা করেছে। প্রতিনিয়ত নতুন নতুন এলাকা ভাঙনের কবলে পড়ছে।”
এ অবস্থায় দ্রুত বাঁধ নির্মাণ এবং অনিয়ম-লুটপাটে জড়িতদের শাস্তি দাবি করেন তিনি।
স্বজনপ্রীতি ও অনিয়মের ব্যাপারে জানতে সাবেক পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব কবির বিন আনোয়ারের মোবাইলে কল করা হলে সেটি বন্ধ পাওয়া যায়।
যা বলছে পাউবো
এ বিষয়ে সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মোখলেছুর রহমান জানান, ঠিকাদাররা এরই মধ্যে বেশ কিছু পয়েন্টে ব্লক ও বস্তা তৈরি করেছে এবং কিছু ঠিকাদার এখনো তা করতে পারেনি।
“পর্যাপ্ত পরিমাণ ব্লক ও বস্তা তৈরি না হওয়ায় আমরা কার্যক্রম শুরু করতে পারছিলাম না। চাহিদার অর্ধেক ব্লক তৈরি হয়েছে। যা দিয়ে আমরা এ বছর প্রকল্পের কিছু কাজ দৃশ্যমান করতে পারবো।”
কাজ বন্ধ থাকা প্রসঙ্গে প্রকৌশলী বলেন, “কিছু ঠিকাদার কাজ বন্ধ রাখায় তাদের নোটিশ করা হয়েছে। ২৮ দিনের মধ্যে তারা কাজে না ফিরলে প্রকল্পের নিয়ম অনুযায়ী তাদের বিরুদ্ধে পরবর্তী সময়ে পদক্ষেপ নেওয়া হবে।”
কাজের অগ্রগতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ছোট-বড় ৩৭টি প্যাকেজের মধ্যে এরই মধ্যে নদী ড্রেজিং ও বেতিল স্পার মেরামত কাজ শেষ হয়েছে। বাকি ৩৫টি প্যাকেজের ৫০ ভাগ কাজ হয়েছে। সবমিলে কাজের অগ্রগতি ৫৫ ভাগ।
কাজে অনিয়ম-দুর্নীতির প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “পাউবোর কাজে অর্থ আত্মসাতের কোনো সুযোগ নেই। কেননা ট্রাস্কর্ফোসের সুপারিশের মাধ্যমে এখানে বিল প্রদান করা হয়ে থাকে। ঠিকাদাররা যে পরিমাণ কাজ করেছে, সেই পরিমাণ বিল দেওয়া হয়েছে।”