কোন বইয়ের কনটেন্ট কেমন এবং পাঠক কোনটি গ্রহণ করবে বা করবে না, সেটি পাঠকের সিদ্ধান্ত। রাষ্ট্র যদি বইয়ের কনটেন্ট ও ভাষা ঠিক করে দেয়, তাহলে কোনো রাজনৈতিক উপন্যাস এমনকি রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে কোনো প্রবন্ধের বইও প্রকাশিত হবে না।
Published : 03 Feb 2025, 06:33 PM
শিল্প-সাহিত্যে পুলিশিং বা পুলিশের খবরদারির চেষ্টা নতুন নয়। ২০২০ সালের ডিসেম্বরে ‘আই থিয়েটার’ নামক একটি অ্যাপে আংশিকভাবে মুক্তি পাওয়া ‘নবাব এলএলবি’ সিনেমায় ধর্ষণের শিকার এক নারীকে থানায় জিজ্ঞাসাবাদের দৃশ্যে পুলিশকে হেয় করা হয়েছে— এমন অভিযোগে সিনেমার পরিচালক ও অভিনেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। তাদের বিরুদ্ধে পর্নোগ্রাফি আইনে মামলা হয়। অথচ ২০১২ সালের পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইনে ‘পর্নোগ্রাফি’ বলতে বুঝানো হয়েছে যৌন উত্তেজনা সৃষ্টিকারী কোনো অশ্লীল সংলাপ, অভিনয়, অঙ্গভঙ্গি, নগ্ন বা অর্ধনগ্ন নৃত্য যা চলচ্চিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও ভিজ্যুয়াল চিত্র, স্থিরচিত্র, গ্রাফিক বা অন্য কোনো উপায়ে ধারণকৃত ও প্রদর্শনযোগ্য এবং যার কোনো শৈল্পিক বা শিক্ষাগত মূল্য নেই। সুতরাং সিনেমায় একজন ভিকটিমকে ধর্ষণের বিষয় নিয়ে পুলিশের প্রশ্ন করার দৃশ্য দেখানোর মধ্য দিয়ে কী করে যৌন উত্তেজনা সৃষ্টি করা হলো— সেটি বিরাট প্রশ্ন। সেখানে যে সংলাপ ব্যবহৃত হয়েছে তাও ‘অশ্লীল’ ছিল বলে মনে হয় না।
অসংখ্য সিনেমার সংলাপে গালাগাল আছে। বিশেষ করে নায়ক ও খলনায়কের মধ্যে যখন বাহাস হয়। সে হিসেবে ওইসব সিনেমার বিরুদ্ধেও অশ্লীলতার অভিযোগ তুলে পর্নোগ্রাফি আইনে মামলা করা যায়। সিনেমার প্রচুর গানে নারীর শরীর যেভাবে প্রদর্শন করা হয়, তা কি অশ্লীল? যদি তা-ই হয়, তাহলে বাংলাদেশের অধিকাংশ সিনেমার বিরুদ্ধেই এই আইনে মামলা করা যায়। তার চেয়ে বড় কথা, স্বাভাবিক জীবনের অশ্লীলতা আর শিল্পের অশ্লীলতা এক নয়। শিল্পী অনায়াসে একজন নগ্ন নারীর ছবি আঁকতে পারেন, কিন্তু চাইলেই একজন মানুষ নগ্ন হয়ে রাস্তায় হাঁটতে পারেন না। আবার একজন শিল্পী নগ্ন ছবি আঁকলেও তিনি নিজে নগ্ন হয়ে রাস্তায় বের হতে পারেন না। একজন অভিনয়শিল্পী গল্পের প্রয়োজনে সিনেমায় গালাগাল করলেও ওই একই গালি তিনি ব্যক্তিজীবনে দিলে অপরাধ হিসেবে গণ্য হয়। তার মানে ব্যক্তিজীবন ও শিল্পী-জীবনের এই স্বাধীনতার পার্থক্যটি সারা বিশ্বেই স্বীকৃত।
একইভাবে লেখকেরও স্বাধীনতা রয়েছে। তিনি যা দেখেন ও বোঝেন ওই বিষয়ে তিনি নিজের মতো করে লিখতে পারেন। নানা সূত্র থেকে তথ্য জোগাড় করে বা মাঠেঘাটে ঘুরে তিনি যেমন ঐতিহাসিক ঘটনা নিয়ে ননফিকশন লিখতে পারেন, তেমনি যেকোনো বিষয়ের ওপর ফিকশন বা কল্পকাহিনী লেখার অধিকারও তার রয়েছে। পাঠক সেটি গ্রহণ করবে না কি করবে না সেটি লেখক ও পাঠকের সম্পর্কের বিষয়। রাষ্ট্র এখানে খবরদারি করতে পারে না। তবে এটা ঠিক যে, কেউ যদি সচেতনভাবে সমাজ ও রাষ্ট্রে অস্থিরতা সৃষ্টির জন্য কিছু লেখেন— সেখানে রাষ্ট্র বা সরকার নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে পারে। তর্কটা উঠেছে ওই কারণেই।
তবে অতীতের ঘটনাপ্রবাহের সঙ্গে এবারের ঘটনার একটা সুস্পষ্ট পার্থক্য হলো, এবার পুলিশের তরফে বই প্রকাশ বিষয়ক একধরনের ‘পুলিশিংয়ের’ পরামর্শ দেয়া হলেও সরকার সঙ্গে সঙ্গেই এর বিরোধিতা করেছে এবং এটি নাকচ করে দিয়েছে। কিন্তু অতীতে এই ধরনের পুলিশিংয়ের চেষ্টায় সরকার কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। তাতে মনে হয়েছে যে, সরকার নিজেই এই ধরনের পুলিশিং চায় বা সরকার চায় বলেই পুলিশ বা অন্য কোনো বাহিনী শিল্প-সাহিত্যের ওপর খবরদারি করতে পারে।
বইয়ের পাণ্ডুলিপি যাচাই
সংবাদমাধ্যমের খবর বলছে, অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে— এমন বিষয়বস্তু ঠেকাতে মেলায় বই প্রকাশের আগেই পাণ্ডুলিপি যাচাই করতে বাংলা একাডেমিকে পরামর্শ দিয়েছে পুলিশ। ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) চাইছে, ২০২৬ সালের একুশে বইমেলা থেকে এই ব্যবস্থা চালু করা হোক। শুক্রবার (৩১ জানুয়ারি) সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এবারের বইমেলার নিরাপত্তা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ শেষে ডিএমপির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এ কথা বলেন।
সংবাদ ব্রিফিংয়ে এক সাংবাদিক প্রশ্ন করেন, এর আগে বইয়ের কনটেন্ট নিয়ে মেলায় সমস্যা হয়েছে, এমন পরিস্থিতি এড়াতে পুলিশের কোনো উদ্যোগ আছে কি না? জবাবে ডিএমপি কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী বলেন, “আমরা একটা সমন্বয় সভা করেছিলাম; সেখানে বাংলা একাডেমির কর্মকর্তারা ছিলেন। তাদের আমরা রিকোয়েস্ট করেছি– এরকম কোনো বই যেন মেলায় না আসে, যেখানে উসকানিমূলক কথা বা লেখা আছে। এটা যেন ওনারা স্ক্যানিং করে, ভেটিং করে স্টলে উপস্থাপন করেন। আমি আশা করি, তারা তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করবেন।”
এ সময় তার পাশে থাকা ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার এস এন নজরুল ইসলাম বলেন, “আমরা এবার বাংলা একাডেমিকে সাজেস্ট করছি, আগামীতে নতুন যে বইগুলো প্রকাশিত হবে— তার পাণ্ডুলিপি আগেই যেন বাংলা একাডেমিকে জমা দেওয়া হয়। তারা এটা যাচাই-বাছাই করবে, পড়ে দেখবে যে এমন কোনো কন্টেন্ট যেন ছাপানো না হয়, যেটা আমাদের সোশাল লাইফকে ডিজরাপ্ট করে, আমাদের কমিউনাল হারমনিকে ডিজরাপ্ট করে, আমাদের দেশদ্রোহী কোনো বক্তব্য বা প্রকাশনা বা সরকারকে ডিস্টাবিলাইজ (অস্থির) করে— এরকম কোনো ধরনের প্রকাশনা যেন মেলায় না আসে। এটা আমরা রিকোয়েস্ট করেছি বাংলা একাডেমিকে।” (বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম, ৩১ জানুয়ারি ২০২৫)।
রসিকজনেরা অবশ্য পুলিশকে এক হাত নিয়ে নিয়েছেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। তাদেরই একজন সাংবাদিক পিনাকী রায় লিখেছেন, “বাংলা একাডেমিকে এই দায়িত্ব না দিয়ে থানায় অবিলম্বে একটা পদ তৈরি করা হোক, নাম– ওসি (সাহিত্য)। বই প্রকাশের আগে তিনি পড়ে দেখবেন কে কি লিখছেন।”
যাচাই করবে কে?
প্রশ্ন হলো, কোন বই আমাদের সামাজিক জীবনকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে বা আমাদের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করবে— সেটি কীভাবে বোঝা যাবে? এর কোনো উদাহরণ বা মানদণ্ড আছে? পৃথিবীর কোথাও, কোনো গণতান্ত্রিক দেশের সরকার এভাবে বই মনিটর করে? কোন বইয়ের কনটেন্ট সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করবে বা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করবে— সেটি কে ঠিক করবে? পৃথিবীতে এভাবে বই লেখা হয় বা এই প্রক্রিয়ায় জ্ঞান বিজ্ঞানের চর্চা হয়? যারা এই ধরনের পরামর্শ দিলেন, তারা এই একুশ শতকের পৃথিবীতে বাকস্বাধীনতা, নাগরিক অধিকার ও মানবাধিকারের বিষয়গুলো সম্পর্কে আদৗ কোনো খোঁজ-খবর রাখেন?
কোন বইয়ের কনটেন্ট দেশদ্রোহী বা কোনটি দেশদ্রোহীমূলক বক্তব্য সেটি কে ঠিক করবে? কোনো বক্তব্য বা প্রকাশনা বা সরকারকে অস্থির করে— এ রকম কোনো ধরনের প্রকাশনা যেন মেলায় না আসে, সেজন্য বাংলা একাডেমিকে অনুরোধ করেছে পুলিশ। প্রশ্ন হলো, কোন বই কীভাবে সরকারকে অস্থির করবে? তার মানে সরকার খুশি থাকবে, সেরকম বই লিখতে হবে?
যাচাইয়ের নামে কী হবে?
বইমেলায় এই ধরনের পুলিশিং প্রথমত সংবিধানপ্রদত্ত নাগরিকের বাকস্বাধীনতা এবং শিল্পীর স্বাধীনতার ওপর সুস্পষ্ট হস্তক্ষেপ। কেননা রাষ্ট্র যদি সৃষ্টিশীল কাজ, সেটি হোক কোনো পেইন্টিং, ভাস্কর্য, কবিতা, উপন্যাস, প্রবন্ধ ইত্যাদির খসড়া বা পাণ্ডুলিপি যাচাই করতে চায় তাহলে সেখানে আর শিল্পচর্চা হবে না। কারণ রাষ্ট্র তখন সেখানে সেন্সরশিপ আরোপ করবে যে এই ধরনের লেখা যাবে না; এই বাক্যটি বাদ দিতে হবে; অমুককে নিয়ে লেখা যাবে না; এই বিষয়ে বেশি বেশি লিখতে হবে— এরকম নানাবিধ বিধিনিষেধ ও প্রেসক্রিপশন আরোপ করবে। এটা কোনো সভ্য দেশে, কোনো গণতান্ত্রিক কাঠামোতে সমর্থনযোগ্য নয়।
রাষ্ট্র যদি কবি-সাহিত্যিক-শিল্পী ও গবেষকদের ওপর এই ধরনের খবরদারি করতে থাকে, তাহলে সেই দেশে কোনো কবি-লেখক ও গবেষক তৈরি হবে না। বরং রাষ্ট্র যা চাইবে, যেভাবে চাইবে— লেখকদের সেভাবে লিখতে হবে। এভাবে শিল্পচর্চা হয় না। গবেষণাও হয় না।
কোন বইয়ের কনটেন্ট কেমন এবং পাঠক কোনটি গ্রহণ করবে বা করবে না, সেটি পাঠকের সিদ্ধান্ত। রাষ্ট্র যদি বইয়ের কনটেন্ট ও ভাষা ঠিক করে দেয়, তাহলে কোনো রাজনৈতিক উপন্যাস এমনকি রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে কোনো প্রবন্ধের বইও প্রকাশিত হবে না। কারণ সরকার যদি মনে করে বা বইয়ের পাণ্ডুলিপি যাচাইয়ের জন্য গঠিত কমিটির সদস্যরা যদি মনে করেন বা তাদের কাছে যদি মনে হয় যে, কোনো একটি প্রবন্ধ বা তার অংশবিশেষ সরকারের সমালোচনামূলক— তাহলে সেই যুক্তিতেও ওই বইয়ের প্রকাশনা আটকে দিতে পারবে। তাছাড়া অনেক লেখকই তাদের লেখায় রাজনৈতিক অবস্থান নেন এবং সারা পৃথিবীতেই এটা স্বীকৃত। শর্ত হচ্ছে তিনি কোনো দলের পক্ষে লিখলেও যা লিখলেন সেটি সত্য কি না, ফ্যাক্ট কি না। যদি তিনি অসত্য লেখেন, ইতিহাসের নামে গালগল্প লেখেন— সেটা পাঠক নেবে না বা পাঠকই বিচার করবে ওই বই বা লেখার পরিণতি কী হবে? এখানে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ করার কিছু নেই।
বাংলা একাডেমি বা সরকারের অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান যদি এভাবে ছাপার আগেই বইয়ের কনটেন্ট যাচাইয়ে নেমে পড়ে তাহলে সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়বেন ননফিকশন লেখকরা। ধরা যাক, জুলাই অভ্যুত্থান নিয়ে কোনো একটি লেখায় বা বইতে কোনো একজন লেখক আন্দোলনের সময়ের এমন কিছু ঘটনা লিখলেন বা এমন কিছু প্রশ্ন তুললেন যা ওই আন্দোলনে সক্রিয় কোনো ব্যক্তি, সংগঠন বা দলের সমালোচনামূলক— তাহলে ওই ধরনের বই কর্তৃপক্ষ কি আটকে দেবে? এভাবে কি ইতিহাস ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা হবে? লেখক কি রাষ্ট্রের প্রেসক্রিপশন মেনে লিখবেন? সেটা এই একুশে শতকে, কোনো একটি দেশে যদি ন্যূনতম গণতন্ত্র থাকে, এমনকি গণতন্ত্র যদি নাও থাকে— তারপরও সম্ভব নয়। পুলিশের মনে রাখা উচিত, সব জায়গায় পুলিশিং চলে না। সব জায়গায় পুলিশিং করতে চাইলে তারা আরও বেশি জনবিচ্ছিন্ন ও বিতর্কিত হয়ে যাবে। বইয়ের কনটেন্ট নিয়ে না ভেবে তাদের বরং দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় অধিকতর মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন। কেননা এটাই তাদের মূল কাজ।
আইন কী বলছে?
বইয়ের বিষয়বস্তু যদি রাষ্ট্রদ্রোহমূলক হয় সেটি নিষিদ্ধ করার বিধান দেশের বিদ্যমান আইনেই রয়েছে। যেমন মুদ্রণ ও প্রকাশনা আইন ১৯৭৩-এর আলোকে সরকার কোনো বই বা প্রকাশনা নিষিদ্ধ করতে পারে যদি সেটি জনশৃঙ্খলা, নৈতিকতা বা রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। সরকার প্রকাশকের লাইসেন্সও বাতিল করতে পারে। কিছু নির্দিষ্ট বইয়ের ক্ষেত্রে সরকার প্রকাশকদের কাছে ব্যাখ্যা চাইতে পারে। পুলিশের গোয়েন্দা শাখা বা সরকারি সংস্থা বইয়ের কনটেন্ট নিয়ে তদন্ত করতে পারে। কিন্তু বই প্রকাশের আগেই তার পাণ্ডুলিপি যাচাই করতে হবে— এটি একটি উদ্ভট আবদার। এই ধরনের সিদ্ধান্ত হলে দেশের প্রকাশনা শিল্প দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কেননা প্রতিটি বইয়ের জন্য সরকারি অনুমোদনের অপেক্ষা করতে হবে। আর সেই অনুমোদনের নামে চলবে নানাবিধ দুর্নীতি, সময়ক্ষেপণ ও হয়রানি। ফলে তারা সিরিয়াস বই প্রকাশে আগ্রহ হারিয়ে ফেলবেন। গুরুত্বপূর্ণ গবেষণাধর্মী বই প্রকাশ সবচেয়ে বেশি বাধাগ্রস্ত হবে। এই ধরনের সৃজনশীলতাবিরোধী সিদ্ধান্ত নেয়া হলে সেটি আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করবে। বাংলাদেশকে একটি কট্টরপন্থি দেশ হিসেবে চিহ্নিত করার সুযোগ তৈরি হবে। সুতরাং যারা এই ধরনের বুদ্ধি পরামর্শ দেন তাদের উদ্দেশ্যটাও বোঝা দরকার।
সরকার কী বলছে?
আশার সংবাদ হলো, বইমেলায় প্রকাশের আগে বইয়ের পাণ্ডুলিপি বাংলা একাডেমিকে দিয়ে যাচাই করিয়ে নেওয়ার যে পরামর্শ পুলিশের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়েছে, তাকে ‘হাস্যকর’ বলেছেন সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। তিনি বলেন, বইমেলার নীতিমালায় এরকম কোনো বিষয় নেই। আর গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে দায়িত্ব নেওয়া বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার মত প্রকাশের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী।
ফারুকী বলেন, “এটা অবিশ্বাস্য, এটা হাস্যকর। এটা আমাদের সরকারের নীতিমালার আশপাশেই নাই। আমাদের সরকার স্পষ্ট বিশ্বাস করে মত প্রকাশের স্বাধীনতাতে এবং সেটা যদি আমাকেও গালমন্দ করে এতে কিছু যায় আসে না। আমরা কোনো মতপ্রকাশে সেন্সরশিপে বিশ্বাস করি না।” ( বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম, ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫)।
প্রসঙ্গত, ফারুকী নিজেও শিল্পীর স্বাধীনতার প্রশ্নে একজন ‘ভিকটিম’। কেননা তার ‘শনিবার বিকেল’ সিনেমাটি নিয়ে কম জল ঘোলা হয়নি। প্রায় পাঁচ বছর ধরে সেন্সর বোর্ডে আটকে আছে সিনেমাটি। এটি একটি বিরল ঘটনা। গত ৫ অগাস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের তিন সপ্তাহ পরে গণমাধ্যমে খবর আসে যে, ‘শনিবার বিকেল’ অবশেষে আলোর মুখ দেখবে। দীর্ঘ পাঁচ বছর ধরে নানান বাহানায় সেন্সরে আটকে থাকা এ সিনেমাটির মুক্তিতে আর কোনো বাধা নেই বলে জানান এর প্রযোজক জাজ মাল্টিমিডিয়ার কর্ণধার আবদুল আজিজ।
পরিশেষে...
নাগরিকের বাকস্বাধীনতা আর শিল্পীর স্বাধীনতায় কিছু তফাৎ আছে। একজন কবি তার কবিতায় অনেক কিছুই বলতে পারেন। আবার কবিতা লেখার দায়ে রাজরোষে পড়ে অনেক কবিকে জেলও খাটতে হয়েছে। জীবনের হুমকি এসেছে। অনেক শিল্পীর অনেক ছবি নিয়ে বিতর্ক হয়েছে। সমালোচনা হয়েছে। কিন্তু তাই বলে শিল্পীর স্বাধীনতা কেউ অস্বীকার করে না।
ভারতের প্রখ্যাত শিল্পী মকবুল ফিদা হুসেন হিন্দুদের দেব-দেবীর নগ্ন ছবি এঁকে বেজায় তোপের মুখে পড়েছিলেন। আবার ইসলামের নবী ইব্রাহীম (আ.)-এর কোরবানি ইস্যুতে রেমব্রান্টের ছবি কিংবা যিশু ও মা মরিয়মকে নিয়েও বহু শিল্পী ছবি এঁকেছেন। কিন্তু এসব ছবির জন্য তাদের কাউকে কারাগারে যেতে হয়নি। যে কারণে বাকস্বাধীনতা ও শিল্পীর স্বাধীনতার সীমারেখা কী এবং কোনো শিল্পী সচেতনভাবে কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে হেয় করা বা কারো ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিতে পারেন কি না— সে প্রশ্নও এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু তারপরও শিল্পী ও লেখকের স্বাধীনতা সারা বিশ্বেই স্বীকৃত।