পিতৃস্থানীয় কোচ ছোটনের বিদায় অজানা এক সংশয়ের জন্ম দেয় মেয়েদের মনে। সে সংশয় অচিরেই শঙ্কায় রূপ নেয় পিটারের কঠিন পেশাদার মনোভাবের দেয়ালে ঘা খেয়ে। মেয়েদের ভাষায় তিনি ‘অতি পেশাদার’। দলে জায়গা হারানোর ভীতিও প্রবলভাবে জেঁকে বসে কয়েকজনের মনে।
Published : 05 Feb 2025, 05:51 PM
কয়েক মাসের ব্যবধানে দুটি বিস্ফোরণ। একটি নেপালে, অন্যটি ঢাকায়। দুই বিস্ফোরণে প্রবল ঝাঁকুনিতে টালমাটাল নারী ফুটবল। কোচ বনাম খেলোয়াড়– স্রেফ এই দুই পক্ষে এখন আর সীমাবদ্ধ নেই বিষয়গুলো। বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন, তদন্ত কমিটি, নানা মতের-পথের সমর্থকগোষ্ঠীও নেমেছে ময়দানে। দেদার চলছে অভিযোগ, পাল্টা অভিযোগের তীর ছোঁড়াছুঁড়ি। তাতে ক্ষত-বিক্ষত, রক্তাক্ত হচ্ছে কেবল নারী ফুটবল।
গত অক্টোবরে নেপালে উইমেন’স সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ চলাকালীন প্রথম বোমাটি ফাটিয়েছিলেন মনিকা চাকমা। জাতীয় দলের মাঝমাঠের এই তারকার এক বিস্ফোরক মন্তব্য দিয়ে পিটার জেমস বাটলারে বিরুদ্ধে ‘এক দল বিদ্রোহীর’ সম্মুখযুদ্ধের শুরু। মনিকা বলেছিলেন, দলের সিনিয়রদের পছন্দ করেন না কোচ। তখনও পিটার সরাসরি আক্রমণ করেননি মেয়েদের; এই ইংলিশ কোচ বরং তোপ দাগিয়েছিলেন, আড়ালে থাকা কুশীলবদের উদ্দেশে। বলেছিলেন, সাবেক কোচ, বাফুফের টিডিসহ (টেকনিক্যাল ডিরেক্টর) আরও অনেকে মেয়েদের প্রলুব্ধ, প্ররোচিত ও বিপথগামী করছে।
এরপর ঘটনা নিয়েছে নানা বাঁক। সবশেষ পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে, যার সমাধানের পথ মসৃণ নয় মোটেও। সমাধান খুঁজতে দেরি করার পুরানো রীতি মেনে একটি তদন্ত কমিটি করেছে বাফুফে। আজ বাদে কাল বৃহস্পতিবার তাদের প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা। এরপর সিদ্ধান্ত নেবে দেশের ফুটবলের নিয়ন্তা সংস্থাটি। তবে, সিদ্ধান্ত যাই হোক, যে ক্ষত তৈরি হলো নারী ফুটবলের বাড়ন্ত শরীরে, তা শুকাবে কী আদৌও?
প্রশ্ন আছে আরও অনেক। এই বিষবৃক্ষের বীজ আসলে পোতা হয়েছিল কখন? কীভাবে? এই বিস্ফোরণের হেতু কী শুধুই পিটার? নাকি সেখানে স্রেফ ছোট্ট একটা অংশ তিনি? নাকি দিনের পর দিন, মাসের পর মাস ধরে পুঞ্জীভূত ক্ষোভের অবশেষে প্রবল উদগীরণ? এত প্রশ্নের উত্তর মেলাতে একটু পেছন ফেরা যাক, মানে ঘটনাপ্রবাহের শুরুতে।
সীমাহীন দারিদ্র্যের কষাঘাত, সমাজের চোখ রাঙানি, চপেটাঘাত সয়েই প্রতিকূল স্রোতে নাও ভিড়িয়েছিল মেয়েরা। ডিফেন্ডার নিলুফা ইয়াসমিন নীলার মায়ের সঙ্গে কথা হয়েছিল কয়েকদিন আগে। তিনি বলছিলেন মেয়েকে ফুটবলে দেওয়ার সময়ের ভাবনা, “ওকে তো দেখার কেউ নেই। হয় ভেসে যাবে, না হয় জেগে উঠবে।” নীলার মতো সাবিনা, মাসুরা, মনিকা, মারিয়া কিংবা শামসুন্নাহারদের গল্প একই। এরা সবাই প্রতিকূল স্রোতে ফুটবলকে আঁকড়ে ধরে জেগে উঠেছে। দেশের ফুটবলকে জাগিয়েছে। এনে দিয়েছে ঈর্ষণীয় সাফল্য। অচেনা, অখ্যাত থেকে তারা হয়ে উঠেছেন চেনামুখ, বিখ্যাত।
এই যশ-খ্যাতির সঙ্গে এসেছে আর্থিক স্বচ্ছলতা। অনিশ্চিত জীবনে এসেছে স্বস্তি, কিছুটা নিরাপত্তাও। যেহেতু পাওয়ার সঙ্গে হারানোর ভয়ও জড়িয়ে; সেহেতু মেয়েদের মনের গহীনে তখন থেকে একটু একটু করে হারানোর ভয়ও বাসা বাধতে থাকে। সম্ভবত প্রথম ধাক্কাটা আসে ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে; যখন বসুন্ধরা কিংস মেয়েদের লিগ থেকে সরে গেল। এই দলটিতে খেলে মোটামুটি ভালো অঙ্কের পারিশ্রমিক পাচ্ছিলেন সাবিনা-ঋতুপর্ণারা। কিন্তু তারা দল না গড়ায় অর্থের স্রোতে পড়ল ভাটার টান, স্বস্তির জায়গাটুকু ছিনিয়ে নিল উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা।
বসুন্ধরা কিংস ছাড়াই ২০২৩-২৪ মৌসুমে লিগ আয়োজন করেছিল বাফুফে। মেয়েদের খেলার মাঠে থাকার সুযোগ মিলেছিল বটে, কিন্তু আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার পথটা হয়ে গেল রুদ্ধ। সে দুয়ার আজও ঠিকঠাক খুলতে পারেনি বাফুফে। যেমনটি পারেনি মেয়েদের ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগের গেরো খুলতে। দফায় দফায় প্রতিশ্রুতি এসেছে, মেয়েদের মনে আশার কুঁড়ি উঁকি দিয়েছে, কিন্তু শতপল্লবে ডানা মেলেনি। প্রতিশ্রুতির অকাল মৃত্যু অসন্তোষ, ক্ষোভ, হতাশা হয়ে জমতে থাকে আশাহতদের মনে। কেউ হয়তো বলবেন, টাকার প্রতি এত লোভ মেয়েদের! তাহলে এবার পড়ুন তাজুল ইসলাম স্যারের কথা, যার হাত ধরে ঠাকুরগাঁওয়ের সাঁওতাল পল্লী কিংবা পিছিয়ে থাকা জনপদের মেয়েদের এতদূর উঠে আসা।
“সোহাগী, কোহাতি, সাগরিকারা যখন এসে বলে, স্যার আপনি আমাদের নতুন জীবন দিয়েছেন। তখন খুব গর্ব হয়। কিন্তু আমি ওদের এটাও বলি, আমি তোমাদের ক্ষতিও করে দিয়েছি। এখন তোমাদের যে লাইফ স্টাইল, সেখান থেকে তোমরা কিন্তু আর নিচে নামতে পারবে না।”
কথা সত্যি। তারকাদের জন্য জীবনমান কমানো সত্যিই কঠিন। এই মানে টান পড়লে মনে জন্মে ভীতি। দিশেহারা হতে সময় লাগে না। চারপাশে এমন উদাহরণ দুর্লভ নয় মোটেও। সাবিনা-মনিকারা এখন তারকা, ছোটবেলায় খালি পায়ে, ভুখা পেটে, খড়-পলিথিন মুড়িয়ে কিংবা বাতাবি নেবু দিয়ে ফুটবল খেলার দিন তারা পেছনে ফেলে এসেছেন সেই কবে! পাঁচ তারকা হোটেলে থাকা, অ্যাডিডাস, নাইকির কেডস পরা, আইফোন এখন তাদের নিত্যসঙ্গী। এই সঙ্গ হারানোর ভয় তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়ার উপায় নেই।
আরেকটি ধাক্কা সম্ভবত ছিল, গোলাম রব্বানী ছোটনের বিদায়। নারী ফুটবলের বাংলাদেশের সেরা সাফল্য প্রথম ধরা দিয়েছিল ছোটনের হাত ধরে। তিনি শুধু কোচ ছিলেন না, ছিলেন পিতা, বন্ধু, ত্রাতা, ছায়া, আরও অনেক কিছু। সাফ জয়ী এই কোচকে ধরে রাখতে পারেনি বাফুফে। পারিশ্রমিকসহ নানা বিষয়ে বনিবনা না হওয়ায় ছোটন ইস্তফা দেন। মেয়েদের আকাশ থেকে তখন এত দিনের নির্ভরযোগ্য, সবচেয়ে আস্থার ছাতাটি সরে যায় মুহূর্তেই।
বিশেষ করে সিনিয়রদের মনে, মগজে ভীষণভাবে প্রভাব ফেলে ছোটনের অনুপস্থিতি। তবে কোচের পদে না থেকেও অদৃশ্যভাবে ছোটন ছিলেন সাবিনা-মারিয়াদের মনে। প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে, দুঃসময়ে, বিপদে-আপদে সাবেক কোচের দরজায় কড়া নাড়তেন মেয়েরা; নিতেন উপদেশ, সাহস, অনুপ্রেরণা। এই ‘অতিরিক্ত যোগাযোগের’ মধ্যে কেউ কেউ দেখেন উস্কানিও। কারো কারো কাছে এটা স্বাভাবিক। এই আত্মিক অনুভূতি নিয়ে বলতে গিয়ে ছোটন ভেজা কণ্ঠে টেনেছিলেন, ২০১৫ সালে নেপালে ভূমিকম্পের কবলে পড়া সেই ভয়ঙ্কর সময়ের স্মৃতি।
“নেপালে যেদিন ভূমিকম্প হলো, সেদিন তো এই মেয়েদের সাথে আপনারা কেউ ছিলেন না। আমি, লিটু (মাহবুবুর রহমান) ছিলাম। ভয়ে মেয়েরা একজন এদিক দৌড় দেয়, আরেকজন ওদিক। রাস্তায়, মাঠে, বিমানবন্দরে খোলা আকাশের নিচে ওদের আকঁড়ে ধরে তো আমরাই ছিলাম। ওদের সাথে আমার সম্পর্ক তো এমনই হবে, তাই না? বলেন, ওই দিনগুলো কি ভোলা যায়?”
মেয়েরাও ভুলতে পারেনি, তাই পিতৃস্থানীয় কোচ ছোটনের বিদায় অজানা এক সংশয়ের জন্ম দেয় মেয়েদের মনে। সে সংশয় অচিরেই শঙ্কায় রূপ নেয় পিটারের কঠিন পেশাদার মনোভাবের দেয়ালে ঘা খেয়ে। মেয়েদের ভাষায় তিনি ‘অতি পেশাদার’। দলে জায়গা হারানোর ভীতিও প্রবলভাবে জেঁকে বসে কয়েকজনের মনে।কেননা, ক্যাম্প বা জাতীয় দলে নেই মানে কোথাও ঠাঁই নেই। একেবারে পর্দার আড়ালে চলে যাওয়া। ২০২২ সাফ জয়ের পর ক্যাম্প ও দলছুট হওয়া মার্জিয়ার ছলছল চোখ, বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠ এই ভয়ের অকাট্য প্রমাণ।
‘বিদ্রোহী’দের জন্য আত্মখননের জায়গাও এখানেই। হাজারো ভয় জয় করে এতদূর আসা তাদের। মার্জিয়া, মিশরাত জাহান মৌসুমীদের দলছুট হয়ে আড়ালে চলে যাওয়ার চাক্ষুস সাক্ষীও তারা। দলে জায়গা হারানোর অতি ভয় দূরে ঠেলে পিটারের মানদণ্ডের ফিটনেস ফিরে পেতে কঠোর পরিশ্রমী, দলে জায়গা ধরে রাখতে নিজেদের প্রতিনিয়ত প্রমাণের দুরন্ত সাহস তো তারা দেখাতেই পারতেন। হারানোর ভয়ে মাঝপথে এসে কেন কুঁকড়ে যাওয়া যে তাদের মানায় না!
মেয়েদের অভয় দেওয়ার মতো বিকল্প পিটারের হাতেও ছিল কী? ২০২৪ সাফের মাস ছয়েক আগে তার হাতে দায়িত্ব তুলে দেয় বাফুফে। দল গোছাতে গিয়ে এই ইংলিশ কোচ পড়লেন এক মহাবিপদে। কেউ মুটিয়ে গেছে, কেউ ব্যস্ত টিকটকে, কারো কমেছে গতি- এমন হাজারো দুর্গতির মধ্যে তিনি নিলেন শক্ত পদক্ষেপ। যেমনটা নিয়ে থাকেন ‘কড়া হেড মাস্টার’। শৃঙ্খলায়, অনুশীলনে, সবকিছুতে আনলেন কড়াকড়ি। এই ইংলিশ কোচের নিয়ম যত কড়া হয়, ছোটনের অভাব ততই অনুভব করতে থাকে মেয়েরা। বজ্র আঁটুনি ফসকা গেরো অবস্থা!
ভাষাগত সমস্যারও ভূমিকা ছিল। বিশেষ করে টেকটিক্যাল বিষয়গুলো বুঝিয়ে দেওয়ার পর মেয়েরা সেটা শতভাগ অনুসরণ করতে না পারলে পিটার রাগান্বিত হতেন, কড়া কথা শোনাতেন, ক্ষোভ-উষ্মা প্রকাশ করতেন, পেশাদার দুনিয়ায় যেটা একেবারেই স্বাভাবিক। কিন্তু মেয়েদের চাওয়া ছিল, কোচ যেন তাদের আরেকটু সময় নিয়ে, প্রয়োজনে একাধিকবার বুঝিয়ে বলেন কিংবা ‘ছোটন হয়ে ওঠেন’ পিটার। আবেগের দৃষ্টিকোণ থেকে যে চাওয়া একেবারে অমূলক নয়, আবার পেশাদার দুনিয়ায় এ চাওয়া মূল্যহীনও। পিটার চেয়েছেন পিটার-ই হতে।
সাফের আগে যে সময় পিটার পেয়েছিলেন, দলের সবার মনোভাব বোঝা, খেলোয়াড়দের ঠিকঠাক চেনা তো দূর অস্ত, প্রস্তুতির জন্যই তা যথেষ্ট ছিল না। সঙ্গে ছিল মুকুট ধরে রাখার পাহাড়সমান চাপ। তাই সেরাটা নিংড়ে বের করে আনতে শেষ পর্যন্ত ‘বিভাজন এবং শাসন’ তত্ত্ব খাটালেন। জুনিয়রদের বেশি বেশি বাহবা দিয়ে, খোঁচা মেরে কথা বলে সিনিয়রদের তাতিয়ে দিতে থাকলেন। এই টোটকায় কাজও হলো, সিনিয়রদের ফিটনেসে উন্নতি হলো, খেলায় ধার বাড়ল, গতিতে উন্নতি হলো কিছু। কিন্তু ‘ছোটন স্যার থাকলে আমাদের সাথে এমন করতেন না’– এই ভাবনাও প্রথম সাফ জিতে ‘উন্মুক্ত বিহঙ্গ’ হয়ে উড়তে থাকা কয়েকজনের মনে গেঁথে গেল প্রকটভাবে! এর একটা প্রমাণ কদিন আগেই তিন পৃষ্ঠার বিবৃতি পড়তে গিয়ে সাবিনা দিয়েছেন, “আমাদের প্রমাণের কিছু নেই।”
কিন্তু পেশাদার দুনিয়ায় যে অনুক্ষণ প্রমাণ দিতে হয়। লড়তে হয়। মোটাদাগে পিটারের চাওয়াও এটি– দলে জায়গা পেতে হলে সামর্থ্যের প্রমাণ দিতে হবে সবাইকে। অতীত সাফল্যে তাকিয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তোলার মানুষ নন তিনি। দক্ষিণ এশিয়ার গণ্ডি পেরিয়ে মেয়েদের এশিয়ার আঙিনায় নিয়ে যাওয়ার দুর্নিবার স্বপ্ন তার। একই স্বপ্ন মেয়েদেরও, কিন্তু দুই পক্ষের স্বপ্ন একবিন্দুতে মেলেনি অদ্ভুত এক কারণে। সেটা ইনটেশন (উদ্দেশ্য) ও অ্যাপ্রোচের (প্রকাশ) তফাৎ।
খেলোয়াড়দের সঙ্গে আলাপচারিতায় নিশ্চিত বুঝতে পেরেছি কোনো ফুটবলারই মনে করেন না পিটার মন্দ কোচ! টেকটিক্যাল ও টেকনিক্যাল বিষয়ে ৫৮ বছর বয়সী এই কোচ কারো কাছে দারুণ, কেউ বলেছেন অসাধারণ, কারো কাছে এ পর্যন্ত পাওয়া কোচদের মধ্যে তিনি সেরা। কোচিং স্টাফদেরও একই মত। সমস্যা এক জায়গাতেই; অ্যাপ্রোচে। ছোটন স্যারও রাগ করতেন, তার চোখে চোখ রেখে কথা বলার সাহস কারো ছিল না– কথাটি বলেছেন একাধিক ফুটবলার। কিন্তু পিটার এতটাই পেশাদার যে, কোনো কিছুতেই এক বিন্দু ছাড় দিতে চান না। এখন মানে এখনই হতে হবে। করতে হবে মানে করতেই হবে যে কোনো মূল্যে। যে পেশাদার মানসিকতা ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে তিনি দেখেছেন, মেনেছেন, একই বীজ বুনে দিতে চেয়েছেন দলের মধ্যে। বিপত্তিও এখানে।
এই চাওয়া পূরণ করতে গিয়ে তিনি কখনও রূঢ় হয়েছেন, কখনও মেজাজ হারিয়েছেন, কখনও তির্যক ভাষায় বিঁধেছেন শিষ্যদের। সিনিয়রদের দলের জায়গা পাওয়ার চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছেন। সামর্থ্যের প্রমাণ দিতে না পারলে পত্রপাঠ বিদায়ের ডঙ্কাও বাজিয়েছেন। তাতেই নেপালে সাফ চলাকালে বেঁধে যায় লঙ্কাকাণ্ড। পাকিস্তানের বিপক্ষে ড্রয়ের পর মনিকার ওই বিস্ফোরক মন্তব্য। অথচ ওই ম্যাচের সেরা একাদশে ছিলেন, ২০২২ সাফ জয়ী দলের ৯ জন! নতুন দুই মুখ আফঈদা খন্দকার ও কোহাতি কিসকু। মনিকার ওই মন্তব্যে প্রকাশ্যে আসে দলের মধ্যে চলা সিনিয়র বনাম জুনিয়র গ্রুপিং।
এই টানাপোড়েনের মধ্যেও পেশাদার পিটার নিজের ছকে ছিলেন অটল। তাতে পরিস্থিতি এমন দাঁড়াল, জুনিয়ররা প্রস্তুতই ছিল, এবার সিনিয়ররাও চাইলেন কোচকে দেখিয়ে দিতে এবং দেখিয়ে দিলেনও। ভারতকে ৩-১ গোলে হারিয়ে, ভুটানকে ৭-১ ব্যবধানে উড়িয়ে, ফাইনালে স্বাগতিক নেপালের স্বপ্ন ২-১ গোলে ভেঙে মুকুট ধরে রাখল মেয়েরা। মেয়েদের অগোচরে জিতে গেলেন কৌশলী পিটারও! টুর্নামেন্ট চলাকালীন আলাপচারিতায় তিনি প্রায়ই বলতেন, “ওরা আমাকে ভুল প্রমাণ করতে পারলে আমি বরং খুশিই হবো!” এই খুশি পিটার উদযাপন করেছিলেন গত ৩০ অক্টোবর, মেয়েরা যখন উদযাপনের বেদিতে ট্রফি উঁচিয়ে ধরেছেন, তখন তিনি নিঃসঙ্গ, একাকী দূরে দাঁড়িয়ে! এই দূরত্ব ঘোচানোর দায়িত্ব ছিল কার?
মুকুট জিতে দেশে ফেরার পর বল ছিল বাফুফের কোর্টে। কেননা, পিটার নেপালে থাকতেই বলেছিলেন, মেয়েদের কোচ হিসেবে এই তার শেষ। সিনিয়ররা হয়ত তাতে কিছুটা স্বস্তি পেয়েছিলেন, কিন্তু অনেক দিন ঝুলিয়ে রাখার পর গত ১৫ জানুয়ারি দুই বছরের জন্য মেয়েদের দায়িত্ব এই ইংলিশ কোচের হাতেই তুলে দেয় বাফুফে। কোচ নিয়োগে খেলোয়াড়দের মতামতের প্রয়োজন নেই বটে, কিন্তু এমন বিরুদ্ধ পরিস্থিতিতেও মেয়েদের সঙ্গে সেভাবে আলোচনার প্রয়োজন অনুভব করেনি বাফুফে। কিংবা সাফ জয়ের পর কোচ ও খেলোয়াড়দের বিরোধের মীমাংসা করতে খুব একটা আগ্রহী দেখা যায়নি বাফুফেকে। অথচ, কে না জানে, জয়ের আনন্দ অনেক কিছু ভুলিয়ে দেয়। সাফের সাফল্যের পরই উদ্যোগ নিলে বিভেদের দেয়ালটুকু হয়ত গুঁড়িয়ে দেওয়া যেত।
এর ফাঁকে অবশ্য যোগ হয়ে যায় আরও অনেক বিষয়, আগুনে ঘি ঢালার জন্য যেগুলোর ভূমিকা নেহায়েত কম নয়। যেমন, অক্টোবর থেকে বাফুফের চুক্তির বাইরে মেয়েরা, ফলে বেতন বন্ধ। সাফ জয়ের পর দেড় কোটি টাকা পুরস্কারের অর্থ এখনও প্রতিশ্রুতির আকাশে ঝুলছে। গুঞ্জন আছে, মেয়েদের ম্যাচ ফিও আছে বকেয়া। সব মিলিয়ে গত ৩০ জানুয়ারি ঘটে দ্বিতীয় বিস্ফোরণ। জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলন। নানা অভিযোগ, অনুযোগের সঙ্গে বিদ্রোহের ঘোষণা দিয়ে ১৮জন খেলোয়াড় হুমকির সুরে বলে দিলেন পিটার থাকলে গণ-পদত্যাগ করবেন। দেশের নারী ফুটবলের ইতিহাসে যা অভাবণীয় এবং অবিশ্বাস্য!
ওই বিবৃতিতে ভয়ঙ্কর সব অভিযোগ কোচের বিরুদ্ধে এনেছেন মেয়েরা। তার মধ্যে আছে ‘গালিগালাজ করা’, ‘বডি শেমিং’, ‘মানসিক নির্যাতন’। পিটার অবশ্য এত অভিযোগের জবাবে শুধু বলেছেন, ‘নো কমেন্টস’। এরপর বাফুফে তদন্ত কমিটি করেছে। জেরা চলছে খেলোয়াড়, কোচিং স্টাফ, কোচসহ সবার। আগামীকাল ৬ ফেব্রুয়ারি তদন্ত কমিটি তাদের প্রতিবেদন জমা দেবে। কিন্তু এরই মধ্যে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ধুন্ধুমার আলোচনা, সমালোচনা চলছে। কেউ খেলোয়াড়দের পক্ষে, কেউ কোচের পক্ষে অবস্থান নিয়ে যাকে তাকে ধুয়ে দিচ্ছেন অভব্য, অশ্রাব্য, অকথ্য ভাষায়। তিন পৃষ্ঠার বিবৃতি ইংরেজিতে অনুবাদ করে দেওয়ায় মাতসুশিমা সুমাইয়াকে দেওয়া হয়েছে হত্যা ও ধর্ষণের হুমকি! জল কী এতদূর গড়ানোর কথা ছিল? অন্দরে বয়ে চলা বিভেদের স্রোতে যে নারী ফুটবলের শক্ত পাড় ভেঙে যাচ্ছে, বাফুফে কী টের পায়নি একটুও?
কোচ-খেলোয়াড় কারো চাওয়াই তো আহামরি ছিল না। মেয়েদের কাছে পিটার চেয়েছেন সম্মান, বিশেষ করে সমীহ, আরও পেশাদার মানসিকতা; দিয়েছেন আরও বড় স্বপ্ন দেখার বার্তা; আগামীর কথা ভেবে দলে তারুণ্যেকে প্রধান্য দিতে চেয়েছেন তিনি। কোচের কাছে মেয়েদের চাওয়া ছিল আরেকটু নমনীয়তা, বাফুফের কাছে প্রত্যাশা ছিল আর্থিক নিরাপত্তার স্বস্তিটুকু অটুট রাখা। দেশের ফুটবলের নিয়ন্তা সংস্থাটি কেন বুঝল না দুই পক্ষের মনোভাব? নাকি বিস্ফোরণের অপেক্ষায় ছিল তারা?