ক্যান্সারের চিকিৎসায় প্রয়োজন একটি সমন্বিত ব্যবস্থার। সেখানে সার্জারি, কেমোথেরাপি ও রেডিয়েশন এক ছাদের নিচে থাকতে হয়। এছাড়া কেমোথেরাপির আগে বা পরে বা বিশেষ প্রয়োজনে রোগীকে নানাবিধ টেস্ট করাতে হয়। কিন্তু মহাখালী ক্যান্সার হাসপাতালে ওই সক্ষমতা গড়ে তোলা হয়নি।
Published : 04 Feb 2025, 01:37 PM
ক্যান্সার নিয়ে যে কোনো খবর এলে তাতে চোখ যায়। কখনো কখনো নিজেও খুঁজে নিই। নিজের ক্যান্সার জার্নির অভিজ্ঞতার কারণেও হয়তো ক্যান্সার সংক্রান্ত খবরাখবর মনোযোগ কাড়ে। খানিকটা ভাবায়ও।
কয়েক দিন আগে দেখলাম দ্য ইউনিয়ন ফর ইন্টারন্যাশনাল ক্যান্সার কন্ট্রোল (ইউআইসিসি) ৪ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব ক্যান্সার দিবস উপলক্ষে ‘ইউনাইটেড বাই ইউনিক’ থিম নির্ধারণ করেছে, অর্থাৎ ‘স্বকীয়তায় ঐক্যবদ্ধ’ হওয়াকে প্রতিপাদ্য করা হয়েছে। ২০২৫ থেকে ২০২৭ পর্যন্ত এ প্রতিপাদ্যের আলোকে ক্যান্সার চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা, ক্যান্সার রোগীর প্রতি মনোভাব, ক্যান্সার সচেতনতা বৃদ্ধিসহ ক্যান্সার সংক্রান্ত কার্যক্রম চালাবে আর্ন্তজাতিক সংস্থাটি। এর আগে ২০২২-২৪ সময়কালে সংস্থাটির প্রতিপাদ্য ছিল ‘ক্লোজ দ্য কেয়ার গ্যাপ’। ক্যান্সার চিকিৎসার ক্ষেত্রে বিশ্বজুড়ে যে বৈষম্য রয়েছে ওই বিষয়টি তুলে ধরে সেই দূরত্ব কমানোর তাগিদ দিতে এই থিম নিয়ে ইউআইসিসি কাজ করেছিল।
১৯৯৩ সালে প্রতিষ্ঠিত ইউআইসিসি বিশ্বজুড়ে ক্যান্সার নির্মূল এবং চিকিৎসা গবেষণাকে এগিয়ে নিতে কাজ করে চলেছে। জেনিভায় সংস্থাটির সদর দপ্তর। ১৯৯৩ সালে তারা প্রথমবারের মতো ক্যান্সার দিবস পালন করে। ২০০০ সালে ক্যান্সারের বিরুদ্ধে প্রথম বিশ্ব সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। প্যারিসে অনুষ্ঠেয় ওই সম্মেলনে ‘ক্যান্সারের বিরুদ্ধে প্যারিস সনদ’ গৃহীত হয়। যেখানে ক্যান্সার চিকিৎসা, গবেষণা, প্রতিরোধসহ রোগীদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের জন্য সদস্য রাষ্ট্রগুলো প্রতিশ্রুতির ভিত্তিতে একটি রূপরেখা প্রণয়ন করে। ওই সনদের দশম অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ৪ ফেব্রুযারি ‘বিশ্ব ক্যান্সার দিবস’ পালনের ঘোষণা দেয়া হয়।
এতসব উদ্যোগ সত্ত্বেও বিশ্বজুড়ে ক্যান্সার আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ২০২২ সালে আনুমানিক ২০ মিলিয়ন মানুষ নতুন করে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছে। আর মারা গেছে ৯.৭ মিলিয়ন মানুষ। এছাড়া প্রায় ২০০ ধরনের ক্যান্সার চিহ্নিত করা হয়েছে যেগুলোর জন্য সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা প্রয়োজন। আরও শঙ্কার কথা হলো গবেষণা বলছে, প্রায় ২০ শতাংশ ব্যক্তির তাদের জীবদ্দশায় ক্যান্সার আক্রান্তের ঝুঁকি রয়েছে।
বাংলাদেশে ক্যান্সার আক্রান্তের সংখ্যা প্রতি লাখে ১০৬ জন বলে বিএসএমএমইউ-এর এক গবেষণা প্রতিবেদনে জানা গেছে। প্রতি বছর নতুন করে লাখে ৫৩ জন ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছেন। এছাড়া বাংলাদেশে ৩৮ ধরনের ক্যান্সার শনাক্ত করা হয়েছে।
অন্যদিকে বিআইডিএস-এর একটি গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীকে নিজ পকেট থেকে চিকিৎসার জন্য গড়ে ৫ লাখ ৮৭ হাজার টাকার বেশি ব্যয় করতে হয়। জনপ্রতি এই খরচ ৮১ হাজার টাকা থেকে সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে। খরচের বড় অংশই ওষুধ কিনতে খরচ হয়। এই খরচ মেটানো বেশিরভাগ পরিবারের পক্ষে অত্যন্ত কঠিন। ফলে পরিবারগুলো ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ে, সম্পদ বিক্রি করতে বাধ্য হয়। এতে করে ১০ থেকে ১৪ শতাংশ পরিবার দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যায়, যা দেশের অর্থনীতির জন্যও বিরাট চ্যালেঞ্জ। এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় নানা উদ্যোগের পাশাপাশি সরকারি, বেসরকারি ও সামাজের সবার সম্মিলিত উদ্যোগে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় একটি জাতীয় ক্যান্সার তহবিল গঠন এখন সময়ের দাবি।
দেশের চিকিৎসায় সন্তুষ্ট না হতে পেরে বা ভুলের শিকার হয়ে একটি বড় অংশ দেশের বাইরে মূলত ভারত, থাইল্যান্ড ও সিঙ্গাপুরে চিকিৎসা নিতে যান। সেখানে তাদের ব্যয় আরও বেশি। উপরন্তু করোনাভাইরাস এবং বর্তমান পরিস্থিতিতে ভারতের ভিসা না পেয়ে অনেক রোগী ভীষণ বিপাকে পড়েছেন। এমন পরিস্থিতিতে তারা আক্ষেপ করেন যে, নিজ দেশে মানসম্মত চিকিৎসা ব্যবস্থা থাকলে পরনির্ভরশীল হতে হতো না।
ক্যান্সার চিকিৎসার জন্য ইউআইসিসি যে থিম নিয়ে তিন বছরের জন্য কাজ শুরু করেছে তার মূল কথা হচ্ছে, চিকিৎসা সেবার মূলে থাকবে আক্রান্ত ব্যক্তির প্রয়োজন। চিকিৎসা সেবা বা ক্যান্সার সংক্রান্ত যাবতীয় কর্মপরিকল্পনা নিতে হবে ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে। আর রোগ হিসেবে নয়, রোগী হিসেবে নয় ব্যক্তি হিসেবে আক্রান্তকে দেখতে হবে। গণমুখী সেবা প্রদানের মাধ্যমে স্থানীয় স্বাস্থ্য সমস্যা পরিচালনার লক্ষে কমিউনিটি স্বাস্থ্য কর্মসূচি, স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীদের জন্য সাংস্কৃতিক দক্ষতা প্রশিক্ষণ, স্বাস্থ্য সাক্ষরতার উদ্যোগ, টেলিমেডিসিন পরিষেবা, রোগীর নেভিগেশন প্রোগ্রাম এবং ক্যান্সার সংক্রান্ত পলিসি এবং কার্যক্রমে আক্রান্তদের সংম্পৃক্ত করার মতো পদক্ষেপ রয়েছে এর মধ্যে। ইউআইসিসি আশা করে যে, এ পদ্ধতিতে কাজ করলে রোগীরা উচ্চমানের সেবা পাবে, সেবা প্রদানকারীর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন হবে, রোগী ও তার পরিবারের চিকিৎসা সেবা নিয়ে সন্তুষ্টি বৃদ্ধি পাবে।
এবার আমরা যদি বাংলাদেশের ক্যান্সার চিকিৎসার দিকে নজর দিই, তাহলে দেখব, দেশের ৭.৮ শতাংশ ক্যান্সার রোগী রোগ নির্ণয়ের পর কোনো চিকিৎসা পায় না। দেশে যে হারে ক্যান্সার আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে ওই হারে চিকিৎসা সেবা বৃদ্ধি পায়নি। আরও সঠিকভাবে বললে, ১৬ কোটির অধিক জনসংখ্যার এই দেশে একটিমাত্র ৫০০ শয্যা বিশিষ্ট ক্যান্সার হাসপাতাল রয়েছে। যেখানে আবার হাসপাতালের সবরকম সাপোর্ট রয়েছে ১০০ শয্যার হাসপাতালের মতো। অর্থাৎ নামে ৫০০ শয্যা হলেও কার্যত তা নয়। তবুও সারা দেশ থেকে মানুষ সেখানে যান। চিকিৎসক, নার্স, চিকিৎসা সরঞ্জাম ও মানের সংকট সত্ত্বেও সেখানে মানুষ খানিকটা হলেও চিকিৎসা পাচ্ছে। ক্যান্সারের চিকিৎসায় প্রয়োজন একটি সমন্বিত ব্যবস্থার। সেখানে সার্জারি, কেমোথেরাপি, রেডিয়েশন এক ছাদের নিচে থাকতে হয়। এছাড়া কেমোথেরাপির আগে বা পরে বা বিশেষ প্রয়োজন রোগীকে নানাবিধ টেস্ট করতে হয়। কিন্তু মহাখালী ক্যান্সার হাসপাতালে ওই সক্ষমতা গড়ে তোলা হয়নি।
অথচ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, প্রতি দশ লাখ মানুষের জন্য একটি ক্যান্সার সেবাকেন্দ্র থাকা দরকার। ঢাকার বাইরে মাত্র নয়টি সরকারি মেডিকেল কলেজে ক্যান্সার চিকিৎসার প্রয়োজনীয় যৎসামান্য সরঞ্জামাদি রয়েছে। এছাড়া ২০১৯ সালে ৮টি বিভাগীয় শহরের সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোতে একটি পূর্ণাঙ্গ ক্যান্সার কেন্দ্র গঠনের জন্য ২৫ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। সেটি এখনো প্রত্যাশিত গতিতে চলছে বলে জানা যায়নি।
আবার এসব ক্যান্সার চিকিৎসাকেন্দ্রগুলোতে রোগীর চাহিদার আলোকে মানসিক স্বাস্থ্য পরামর্শক, কাউন্সিলর, পুষ্টিবিদসহ সুস্থ জীবনচর্চার পদ্ধতি শেখানোর বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেই। অথচ একজন ক্যান্সার সার্ভাইবার হিসেবে খুব উপলব্ধি করি যে, ক্যান্সার আক্রান্ত রোগী এবং তার পরিবারের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য সেবা, কাউন্সেলিং, পুষ্টি ও সুস্থ জীবনযাপন সংক্রান্ত ধারণা কতটা জরুরি। আমরা সেন্টার ফর ক্যান্সার কেয়ার ফাউন্ডেশন (সিসিসিএফ) থেকে এই বিষয়গুলোকে ক্যান্সার চিকিৎসার গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে গ্রহণ করার প্রস্তাব জানাই।
এছাড়া আশু, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদী পদক্ষেপ নিতে হবে। এসব পদক্ষেপের মধ্যে বাংলাদেশে ক্যান্সার কন্ট্রোল পলিসি সময়োপযোগী করা, কমউিনিটিভিত্তিক ক্যান্সার রেজিস্ট্রি করা, পর্যাপ্ত চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীকে প্রশিক্ষণ দেয়া, তাদের জন্য বিশেষ প্রণোদনা দেয়া জরুরি। পাশাপাশি প্রতিটি ক্যান্সার হাসপাতাল সংলগ্ন বা নিকটবর্তী স্থানে চিকিৎসাধীনদের জন্য স্বল্পমূল্যে আবাসনের ব্যবস্থা, ক্যান্সার আক্রান্ত পরিবারের শিশুদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাব্যয় কমানো বা বিনামূল্যে করা, ক্যান্সার সার্ভাইবারদের পুর্নবাসনের বা কাজের জন্য বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ, তরুণ জনগোষ্ঠীকে প্রশিক্ষিত করে সোশ্যাল নেভিগেটর হিসেবে যুক্ত করা, ক্যান্সার প্রতিরোধে বিষমুক্ত খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করার সাথে সাথে বায়ু ও পরিবেশ দূষণ প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া অত্যন্ত জরুরি।
ইতোমধ্যে সারাদেশে জরায়ুমুখের ক্যান্সার প্রতিরোধে ৯ থেকে ১৪ বছর বয়সী মেয়েদের টিকা প্রদান কর্মসূচি চলছে। এটি সফল করতে পারলে আমাদের কন্যাদের জীবন জরায়ুমুখ ক্যান্সারের ঝুঁকি থেকে মুক্ত থাকবে। একইভাবে স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি থেকে বাঁচতে ২০ বছরের পর থেকে সকল নারীকে নিজের স্তন পরীক্ষার প্রশিক্ষণ দিতে হবে। প্রতিমাসে যেন নারীরা নিজেরাই নিজেদের পরীক্ষা করেন এবং স্তনে যে কোনো পরিবর্তন দেখা দিলে চিকিৎসকের কাছে দ্রুত যেতে পারেন। নারীদের জরায়ু ও স্তনসহ যে কোনো অঙ্গে ক্যান্সার নিয়ে অস্বস্তি বা ট্যাবু থেকে বেরিয়ে আসতে পরিবারের পুরুষ সদস্যদের গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখা প্রয়োজন। এমনকি পুরুষ সদস্যরা পরিবারের নারীদের উপহার হিসেবে ‘ব্রেস্ট স্ক্রিনিং’ উপহার দিতে পারেন। চিকিৎসকের কাছে নিয়ে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা করিয়ে নিতে পারেন। কোনো উপসর্গ ছাড়া স্ক্রিনিং যে কোনো সুস্থ মানুষ করতে পারেন। এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কালে এসে আমাদের জীবনযাপন, উপহার, ভালোবাসা, যত্ন অনেক ইতিবাচক ও সৃজনশীলভাবে প্রকাশ করা যেতে পারে। আসছে ফাগুন, ভ্যালেন্টাইন ডে বা জন্মদিনে আপনি আপনার প্রিয়জনকে স্ক্রিনিং উপহার দিন। কেননা স্ক্রিনিং প্রাথমিক পর্যায়ে ক্যান্সার নির্ধারণে সাহায্য করে। আর ক্যান্সার যত দ্রুত চিহ্নিত করা যায় জীবন রক্ষার হারও তত বেশি হয়।
ইউআইসিসি-এর প্রেসিডেন্ট ইলরিকা আরেহেদ কাগস্টোম বলেছেন, ‘ক্যান্সারে আক্রান্ত প্রতিটি ব্যক্তির অভিজ্ঞতা এবং চাহিদা অনন্য’। আমরা চাই সমাজে আক্রান্তের কথা শুনবার দরদি মন তৈরি হোক। সার্ভাইবাররা পরস্পরের শক্তি হিসেবে সম্মিলিত হোক। সেন্টার ফর ক্যান্সার কেয়ার ফাউন্ডেশনের মতো অলাভজনক সামাজিক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আরও গড়ে উঠুক। আমরা চাই, ধনী-দরিদ্র, নারী-পুরুষ, ধর্ম, জাতি, বয়স নির্বিশেষে ক্যান্সারাক্রান্ত সব মানুষের জন্য সুলভে বিশ্বমানের ক্যান্সার চিকিৎসা দেশেই নিশ্চিত হোক।