ক্ষতিগ্রস্তরা বলছেন, যতটা দরকার, ততটা সরকারি সহায়তা তারা এখনও পাচ্ছেন না।
Published : 29 Oct 2024, 01:50 AM
অগাস্টের শেষ দিকের স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় ফেনীর ফুলগাজীর প্রণজিত কুমার দত্তের ঘরদোর ভেঙেছিল, দুই মাসেও তা মেরামত করে উঠতে পারেননি তিনি।
চাষাবাদ করে সংসার চালানো প্রণজিত আর তার পরিবারের মাথা গোজার ঠাঁই হয়েছে ‘গোয়াল ঘরে’। সে ঘরের বেড়ার ফাঁক দিয়ে আলোবাতাস আসে, চালের ছিদ্র দিয়ে পড়ে বৃষ্টির পানি।
উপজেলার দরবারপুর ইউনিয়নের দক্ষিণ বরইয়া গ্রামে প্রণজিতের ভিটা বেড়িবাঁধের কাছে।
তিনি বলেন, “আমার ঘর ভাঙছে তিনটা, সেনাবাহিনী থেকে দুই বান্ডেল টিন দিল, বিভিন্নজন সামান্য অনুদান দিল। এর বাইরে সরকারি সাহায্য পাই নাই। ভাঙাচোরা গোয়ালঘর কোনোরকম মেরামত করে পরিবার নিয়ে গরুসহ একত্রে থাকতে হচ্ছে।
“সংসার চালাতে আর ছেলে-মেয়েকে কলেজে পড়াতেই হিমশিম খাচ্ছি, ঘর মেরামত করার সাধ্য কোথায়।“
গত ২০ অগাস্ট দুপুর থেকে ফেনীতে বন্যা শুরু হয়। ২৪ ঘণ্টার মাথায় তা ভয়াবহ রূপ ধারণ করে। পরশুরাম, ফুলগাজী ও ছাগলনাইয়া উপজেলা শুরুতে বন্যা কবলিত হলেও পরে ফেনী সদর, সোনাগাজী ও দাগনভূঞাতেও ছড়িয়ে পড়ে।
অগাস্টের শেষ ১০ দিনের ওই বন্যায় ২৯ জনের মৃত্যুর তথ্য দিয়েছিল জেলা প্রশাসন। ১১ লাখের বেশি মানুষ এবং ৯৫ শতাংশ এলাকা বন্যায় দুর্গত হয়। এছাড়া কৃষি, মৎস্য, প্রাণি সম্পদ, ঘরবাড়িসহ সব খাতে ব্যাপক ক্ষতি হয় ওই বন্যায়।
ফেনী জেলা প্রশাসক শাহীনা আক্তার বলেন, বন্যার সময় দুর্গতদের জন্য দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় থেকে ২ হাজার ৩শ টন চাল, ৮২ লাখ টাকা, ৬ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার এবং শিশুখাদ্যের জন্য ১৫ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল।
জেলা প্রশাসন জানিয়েছে, বন্যায় জেলায় ৮ হাজার ৯৫টি কাঁচাঘর, আড়াইশ আধাপাকা ঘর সম্পূর্ণ ধসে গেছে; এতে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ আনুমানিক ১৬৩ কোটি ১১ লাখ ৭০ হাজার টাকা।
৫৩ হাজার ৪৩৩টি কাঁচাঘর এবং ২, ৬৩২টি আধাপাকা ঘরের আংশিক ভেঙেছে, এতে ৩৭০ কোটি ৭৮ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। সব মিলিয়ে ৬৪ হাজার ৪১৫টি ঘরবাড়ি ভেঙেচুরে যাওয়ায় মোট ক্ষতি হয়েছে ৫৩৩ কোটি ৮৯ লাখ ৭০ হাজার টাকা।
জেলা প্রশাসক বলছেন, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর বাড়িঘর সংস্কার ও পুনর্বাসনের জন্য ২০ হাজার বান্ডেল টিন এবং নগদ ৬ কোটি টাকা বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে মন্ত্রণালয়ের কাছে।
এছাড়া বেসরকারিভাবে যেসব প্রতিষ্ঠান বা সংগঠন দুর্গতদের পুনর্বাসনে সহায়তা নিয়ে এগিয়ে এসেছে, তাদের কাজগুলোও সমন্বয় করা হচ্ছে।
শাহীনা আক্তার বলেন, ২৭ অক্টোবর পর্যন্ত ৪০০ বান্ডেল টিন এবং নগদ ১২ লাখ টাকা বরাদ্ধ দেওয়া হয়েছে।ক্ষতিগ্রস্ত উপজেলাগুলোতে পরিবার প্রতি এক বান্ডেল টিন ও নগদ ৩ হাজার টাকা করে বিতরণ করেছেন ইউএনওরা।
এছাড়া বন্যার পরে ৩ হাজার পরিবারের ঘর সংস্কারের জন্য ১০ কোটি ৩৫ লাখ টাকা সহায়তা দিয়েছে ইউএনডিপি। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ইপসা দিয়েছে ২ কোটি ৫৩ লাখ টাকা।
বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনে ব্যক্তি উদ্যোগের পাশাপাশি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের ভূমিকার প্রশংসা এসেছে।
স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবী শহিদুল মিশু বলেন, ‘ঘুরে দাঁড়াবে ফেনী’ নামের একটি সংগঠন এ পর্যন্ত ১৩টি পরিবারকে নতুন ঘর করে দিয়েছে এবং ক্ষতিগ্রস্ত ঘরবাড়ি মেরামত করেছে।
মিশু বলেন, “ফেনীর স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলোর পাশাপাশি বিভিন্ন জেলার বাসিন্দারা পুনর্বাসনে কাজে এগিয়ে এসেছেন। তবে সবার আগে সরকার ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে দাঁড়ানো প্রয়োজন ছিল।“
দুই লাখের বেশি কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত
ফেনীর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানিয়েছে, ছয় উপজেলায় কেবল কৃষিতেই ক্ষতি হয়েছে ৫২৪ কোটি ৪৮ লাখ টাকার বেশি। এতে প্রায় দুই লাখের বেশি কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।
পরশুরামের সত্যনগর গ্রামের প্রান্তিক কৃষক আবদুল খালেক বলেছেন, বন্যা শুরুর আগে ১৬ শতক জমিতে ধানের চারা রোপণ করেছিলেন তিনি।
“বন্যায় শুধু চারা না, মাটিও ভেসে গেছে। জমিতে শুধু বালুর স্তর। উপজেলা কৃষি অফিসে বার বার যোগাযোগের পরও কোনো সহায়তা পাই নাই।“
একই অভিযোগ তুলেছেন ওই এলাকার স্থানীয় কৃষক শামছুল হক। বানের পানি নামার পর একাধিকবার কৃষি অফিস ঘুরেও গত দুই মাসে বীজ, সার বা নগদ টাকার কিছুই না পাওয়ার কথা বলেছেন তিনি।
ফেনীর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বলছে, বন্যায় জেলার ৩০ হাজার ৩৫২ হেক্টর ফসলি জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যা মোট ফসলি জমির ৭৯ দশমিক ৬৯ শতাংশ।
তার মধ্যে ১ হাজার ৮৬৫ হেক্টর আমন বীজতলা, ২৬ হাজার হেক্টর আমন, ১ হাজার ৮৫৪ হেক্টর আউশ। চলতি আমন ধানের মৌসুমে ফেনীতে ৩৮ হাজার ৮৭ হেক্টর জমিতে আমন ধানের আবাদ হয়েছিল। এবারের বন্যায় ৩৪ হাজার ৭৭ হেক্টর জমির আবাদ সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বাকি আবাদও আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত বলছে অধিদপ্তর।
এছাড়া আবাদ করা ৫২৫ হেক্টর শরৎকালীন সবজির পুরোটাই, ৬৯ হেক্টর ফলবাগান, ৭ হেক্টর আদা, ১৬ হেক্টর হলুদ এবং ১৬ হেক্টর আখ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. একরাম উদ্দিন বলছেন, বন্যার পরও মাঝেমধ্যেই বৃষ্টি হওয়ায় অনেক জায়গায় নতুন করে আবাদ করা যাচ্ছে না।
সহায়তা নিয়ে এই কর্মকর্তা বলেন, “কৃষকদের ঘুরে দাঁড়াতে প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে। বিনামূল্যে সার, ১২টি ফসলের বীজ এবং অন্যান্য ব্যয়ের জন্য ১ কোটি ২১ লাখ ২৪ হাজার ৪০০ টাকা মন্ত্রণালয় থেকে মঞ্জুরির আদেশ পাওয়া গেছে। “
আমন ধান কাটার পর ১২ হাজার কৃষককে মটর, সরিষার বীজ এবং ৬০ হাজার কৃষককে বোরো চাষে বীজ দেওয়া হবে বলে জানান একরাম উদ্দিন।
বন্যার ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে কৃষকদের নানা জাতের শীতকালীন সবজি চাষের পরামর্শ ও সহায়তা দেওয়ার কথা বলেন উপপরিচালক।
তিনি বলেন, ২৩ হাজার কৃষক পরিবারের জন্য শীতকালীন সবজি বীজ ও নগদ টাকা বাবদ ৩ কোটি ৫০ লাখ ২৯ হাজার টাকা মঞ্জুরি আদেশ পাওয়া গেছে।
ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরাও ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টায় জমিতে চাষ করেছেন লালশাক, মুলা শাক, বরবটি, মিষ্টি কুমড়াসহ শীতকালীন নানা জাতের সবজি।
ফুলগাজীর বসন্তপুর গ্রামের কৃষক মো. মিজানুর রহমান বলেছেন, বছরের প্রথম দফায় বন্যায় তার আমন বীজতলা ভেসে যায়।
তারপর আবার বীজ বপন করে আমন আবাদের কিছুদিন পর নতুন করে দ্বিতীয়বার বন্যা আসে, পানিতে আবার ডুবে যায় সেই জমি। দেড় মাসের ব্যবধানে তৃতীয় দফা বন্যায় সবগুলো ফসলি জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
এখন লালশাক, মুলা শাক চাষ করে কিছু বিক্রি করতে পারছেন মিজানুর।
কৃষির পাশাপাশি বন্যায় নার্সারি ও বনায়নের ক্ষতি হয়েছে ১ কোটি ৩৮ লাখ ৬৫ হাজার ৬৪৮ টাকার।
তবে সেখানে নতুন করে বনায়ন বা বৃক্ষ রোপণের কোনো কর্মসূচি এখনো হাতে নেয়নি সামাজিক বন বিভাগ।
ক্ষতি পোষাতে প্রয়োজন নগদ টাকার
জেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তরের বরাত দিয়ে জেলা প্রশাসন জানিয়েছে, বন্যায় প্রাণী ও মৎস্য খাতে আনুমানিক ৫৭৫ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।
সদর উপজেলার মোটবী ইউনিয়নের বাঘাইয়া গ্রামের প্রকৌশলী ফখরুল ইসলাম মাসুক বলেন, বন্যায় তার ছোট-বড় ২০টি মুরগির খামারে দেড় কোটি টাকার বেশি ক্ষতি হয়।
বন্যার পানি নামার পর ধারদেনা করে আটটি খামার চালু করতে পেরেছেন এই প্রকৌশলী। খামারে বর্তমানে মুরগির লেয়ার বাচ্চা ও সোনালি বাচ্চা মিলিয়ে ১০ হাজার মুরগির বাচ্চা তোলা হয়েছে, এছাড়া সাড়ে ৪ হাজার লেয়ার পুলেট মুরগিও তুলেছেন এই খামারি।
এখন কাজে গতি আনতে নগদ অর্থ দরকার হলেও ব্যাংক থেকে সহযোগিতা পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ ফখরুল ইসলামের।
ফেনী জেলা পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশন সাধারণ সম্পাদক মো. কামরুল আলম বলেন, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তায় এর আগে জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে প্রধান উপদেষ্টা, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা বরাবর ছয় দাবি নিয়ে স্মারকলিপি দেওয়া হয়েছিল।
তিনি বলেন, “বন্যার পরে দুই মাস চলে গেলেও কোনো সহায়তা মেলেনি। বর্তমানে ধ্বংস প্রায় পোল্ট্রি শিল্প সরকারি সহযোগিতা ছাড়া পুনরায় উৎপাদনে যাওয়া সম্ভব নয়।“
এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মো. মোজাম্মেল হক বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত খামারিদের সহায়তায় সংশ্লিষ্ট দপ্তরে চাহিদা পাঠানো হয়েছে।
“চলতি সপ্তাহের মধ্যে কিছু সহায়তা পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে ইতোমধ্যে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার মাধ্যমে কিছু ক্ষতিগ্রস্তদের ছাগল, মুরগী ও পশুখাদ্য বিতরণ করা হয়েছে।”
উপজেলার ফতেহপুর এলাকার মাছের খামারি ফজলে ইমাম রকি বলেছেন, বন্যায় তার খামারের মাছ ও অবকাঠামোসহ ‘প্রায় ৬০ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে’।
সহায়তা পেতে উপজেলা মৎস্য অফিসে আবেদন করলেও দুমাসে কোনো ‘খবর হয়নি’ অভিযোগ করে রকি বলেন, “মাঝখানে একবার উপজেলা মৎস্য অফিস থেকে ফোন করে কিছু তথ্য নিলেও কোনো সহায়তা পাই নাই।“
অভিযোগের বিষয়ে জেলা মৎস্য কর্মকর্তা আমিনুল ইসলাম বলেন, বন্যার পর ফেনী সদর, পরশুরাম, সোনাগাজী ও ফুলগাজী উপজেলার ৭৯৩ জন ক্ষতিগ্রস্ত মাছচাষীর মধ্যে অক্টোবর মাসে ৩ দশমিক ৮২২ মেট্রিকটন কার্পজাতীয় পোনামাছ বিতরণ করা হয়েছে।
তিনি বলেছেন, পরিস্থিতি বিবেচনায় কোনো কোনো চাষীকে ৪ কেজি ও কোনো চাষীকে ১০ কেজি পোনাও দেওয়া হয়েছে।
অবশিষ্ট উপজেলায় পোনামাছ বিতরণের কাজ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে জানিয়ে এই কর্মকর্তা বলেছেন, এ কার্যক্রম মৎস্য অধিদপ্তরের রাজস্ব বাজেটের অধীন বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার মাধ্যমেও ক্ষতিগ্রস্ত খামারিরা মাছের পোনা পাচ্ছেন বলে জানান মৎস্য কর্মকর্তা আমিনুল ইসলাম।
গ্রামীণ সড়কের ক্ষতি বেশি ফুলগাজীতে
সড়ক বিভাগ, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) এবং বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (বাপাউবো) ফেনীর তথ্য অনুযায়ী বন্যায় সড়ক, ব্রিজ ও কালভার্ট, নদীর তীরে বাঁধ ভেঙে ক্ষতি হয়েছে ৯২৮ কোটি ৯৯ লাখ ৩২ হাজার ৯৩৮ টাকার।
ফুলগাজীতে গ্রামীণ সড়কে সবচেয়ে ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছে এলজিইডি কর্তৃপক্ষ।
ফুলগাজীর মুন্সিরহাট ইউনিয়নের, নতুন মুন্সিরহাট থেকে জগতপুর হয়ে আমজাদহাটে চলাচলারে জন্য সড়কটির বিভিন্ন স্থায় বন্যায় এতটাই ভেঙেচুরে গিয়েছিল যে, যান চলাচলই বন্ধ ছিল কিছুদিন।
জগতপুর গ্রামের ৭০ বছর বয়সী আবুল হাশেম বলেন, সড়কটি নতুন করে তৈরি না করে, ভাঙা জায়গায় জোড়াতালি দিয়ে মেরামত করে কোনোমতে যানবাহন চলাচলের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
মেরামতের বিষয়ে প্রশ্ন করলে এলজিইডির ফেনীর নির্বাহী প্রকৌশলী মাহমুদ আল ফারুক বলেন, “নিয়মিত কাজের অংশ হিসেবে গ্রামীণ সড়ক সংস্কারের কাজ চলমান রয়েছে।“
বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ফেনী-সোনাইমুড়ী (নোয়াখালী) আঞ্চলিক মহাসড়কও।
সদর উপজেলার পাঁচগাছিয়ার ইউনিয়নের মাদ্রাসা শিক্ষক শাহজালাল ভূইয়া বলেন, ফেনী-সোনাইমুড়ী আঞ্চলিক মহাসড়কের ফেনী অংশের তালতলা থেকে গণিপুর পর্যন্ত পানিতে তলিয়ে ছিল। পানি নামলেও রাস্তাঘাট ভেঙে যাওয়ায় এই সড়কে চলাচলকারীরা ‘মহা বিপাকে’ পড়েছেন।
তিনি বলেন, “একটু বৃষ্টি হলেই সড়কের বিভিন্ন অংশে পানি জমে গাড়ি চলাচল তো দূরের কথা, সড়কে হাঁটাও যায় না। সড়কে বড় বড় গর্ত সৃষ্টি হয়ে ডোবা হয়ে যাচ্ছে। বন্যার পানির নামার এতদিন পরেও কর্তৃপক্ষের কোনো নজর নেই।“
সড়ক সংস্কারে কাজ চলছে জানিয়ে সড়ক ও জনপথ বিভাগ ফেনীর নির্বাহী প্রকৌশলী বিনয় কুমার পাল বলেন, “অনেক সড়কের ক্ষতি হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক বরাদ্দের ভিত্তিতে ক্রমান্বয়ে মেরামত হচ্ছে। ফেনী-সোনাইমুড়ী সড়কের ফেনী অংশের প্রায় পাঁচ কিলোমিটার সড়কে খানাখন্দ রয়েছে।
“বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত সড়কের উন্নয়ন কাজের টেন্ডার প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। আশা করি খুব শিগগিরই মানুষের কষ্ট লাঘবের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
বড় ক্ষতি শিক্ষা উপকরণে
জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কার্যালয় এবং প্রাথমিক শিক্ষা কার্যালয় জানিয়েছে, জেলার ৯২০টি স্কুল, মাদ্রাসা এবং কলেজ পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ক্ষয়ক্ষতির আর্থিক পরিমাণ ৩৯ কোটি ২ লাখ ৭৩ হাজার ৭৯৮ টাকা।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কাঠামোগত ক্ষতির চেয়েও বন্যায় শিক্ষার্থীদের বড় ক্ষতি হয়েছে শিক্ষা উপকরণে।
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা নাছির উদ্দিন বলেন, প্রয়োজনীয় নতুন বইয়ের বরাদ্দ চেয়ে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে চিঠি পাঠানো হয়েছে। কিন্তু দুইমাসেও বই পাওয়া যায়নি।
ফুলগাজী উপজেলার বন্দুয়া দৌলতপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ইলিয়াছ মামুন বলেছেন, বন্যার পর শিক্ষা উপদেষ্টা ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ স্কুল পরিদর্শনে এসে সংস্কারের জন্য ৭ লাখ টাকার বরাদ্দের ঘোষণা দিলেও উপজেলা এলজিইডি অফিস থেকে ভবন সংস্কারের কোন নির্দেশনা এখনো আসেনি।
“বিভিন্নজনের কাছ থেকে ৫০ হাজার টাকা ধার করে শিক্ষা উপকরণ (ব্যাগ, খাতা, কলম) কেনা হলেও, সেই টাকা উপজেলা শিক্ষা অফিস থেকে এখনও পাওয়া যায়নি।“
জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. শফিউল্যাহ বলছেন, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের শিক্ষা ও বই সংক্রান্ত বিষয় জেলা শিক্ষা অফিস দেখভাল করে। আর ভবন সংক্রান্ত বিষয় শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর দেখভাল করে।
“বন্যা পরবর্তী ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষার্থীদের বই সহায়তা বিষয়ে জেলা প্রশাসকের সঙ্গে সভা করে ২ লাখ ৫০ হাজার বইয়ের চাহিদা চাওয়া হয়েছিলে।“
ইতোমধ্যে ইউনিসেফের সহয়তায় বন্যায় বেশি ক্ষতিগ্রস্ত ফুলগাজী ও পরশুরাম উপজেলায় বই বিতরণ করা হয়েছে বলে তথ্য দেন শিক্ষা কর্মকর্তা শফিউল্যাহ। বাকি উপজেলাগুলোতেও ধাপে ধাপে বই বিতরণ করা হবে বলে তিনি আশ্বাস দেন।
ইউনিসেফের তাঁবুতে রোগীরা
বন্যার পর জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ক্ষয়ক্ষতির হিসেব তুলে ধরে বলা হয়েছে ১০টি হাসপাতাল, ৩টি ক্লিনিক ও ৭৯টি কমিউনিটি ক্লিনিকে ৬ কোটি ১০ লাখ ৯ হাজার ২শ টাকা ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করা হয়েছে।
এছাড়া জেলায় ১ লাখ ২০ হাজার ৪৯০টি স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানার ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করা হয়েছে ১০৯ কোটি ৯৭ লাখ টাকার।
গভীর, অগভীর এবং হস্তচালিত নলকূপে ক্ষয়ক্ষতি দেখানো হয়েছে ১৪৯ কোটি ৫৭ লাখ ৮৫ হাজার টাকা।
জেলা প্রশাসন বলছে, বিদ্যুৎ বিভাগের ৭০৭ কিলোমিটার বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইনের আংশিক ক্ষতি হয়েছে, যা টাকার অংকে ৩ কোটি ৯৭ লাখ ১৫ হাজার ৫৯৮ টাকা।
এছাড়া ৫৪টি মসজিদ সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানিয়েছে জেলা প্রশাসন। এতে মোট ৬ কোটি ৯১ লাখ ৬০ হাজার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। আর ১৪৪টি মন্দির ভেঙেচুরে যাওয়ায় ৪৫ লাখ ২০ হাজার টাকা ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
বন্যা পরবর্তী পানিবাহিত ডায়রিয়া রোগীর চাপ বাড়লে জেলার জেনারেল হাসপাতালে রোগীদের আর জায়গা দেওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। তখন খোলা আকাশের নিচে রোগীদের চিকিৎসা সেবা দিতে হয়।
ওই পরিস্থিতে পরে রোগীদের সেবা দিতে হাসপাতাল সংলগ্ন জমিতে তাঁবুর ব্যবস্থা করে ইউনিসেফ।
মৃতদের পরিবারও ‘সরকারি সহয়তা পায়নি’
ভয়াবহ বন্যায় ফেনীতে সরকারী হিসেবে ২৯ জনের প্রাণহানি হয়েছে। মৃতদের মধ্যে ১৭ জন পুরুষ, ৮ জন নারী ও ৪ জন শিশু। তাদের মধ্যে ২০ জনের পরিচয় মিলেছে। আর অজ্ঞাত পরিচয়ে ৯ জনকে দাফন করা হয়েছে বেওয়ারিশ হিসেবে।
জেলা প্রশাসন বলছে, মৃত ২৯ জনের মধ্যে ফেনী সদরে ৮ জন, ফুলগাজীতে ৭ জন, সোনাগাজীতে ৬ জন, দাগনভূঞায় ৩ জন, ছাগলনাইয়ায় ৩ জন ও পরশুরামের ২ জন রয়েছেন।
এদের মধ্যে ফেনী সদর উপজেলায় অজ্ঞাত ৪ জন, সোনাগাজী ৪ জন এবং ছাগলনাইয়া উপজেলায় অজ্ঞাত একজন রয়েছেন।
ফেনীর জেলা প্রশাসক শাহীনা আক্তার বলেন, “নিহতদের পরিবারকে মানবিক সহায়তার জন্য দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ে ২০ লাখ টাকা বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে। বরাদ্দ পেলে সেসব পরিবারকে সহায়তা দেওয়া হবে।“
অন্তর্বর্তী সরকারের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম, তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানসহ আরো অনেকে বন্যা পরবর্তী সময়ে ফেনী বিভিন্ন উপজেলা পরিদর্শন করেছেন। এ সময় তারা সংস্কার কাজ ও পুনর্বাসনে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
পরশুরামের বাসিন্দা আবু ইউসুফ বলেছেন, বর্ষামৌসুমে ফুলগাজী ও পরশুরামকে বন্যা থেকে বাঁচাতে মুহুরী-কহুয়া-সিলোনিয়া নদীতে টেকসই বেড়াবাঁধ নির্মাণ নিয়ে শুধু আশ্বাসই দেওয়া হয়েছে।
বাঁধে ভাঙন ও ‘জোড়াতালির’ সংস্কার
উজানের পানির ঢলে ফেনীর মুহুরী-কহুয়া-সিলোনিয়া নদীর বেড়িবাঁধের শতাধিক স্থানে ভাঙন ধরে বন্যার সময়ে।
নদীর পানি কমার পর বাঁধ সংস্কারে তৎপরতা ছিল পানি উন্নয়ন বোর্ডের। তবে বাঁধের স্থায়ী সংস্কার না করে নদীর মাটি দিয়ে ‘দায়সার জোরাতালির’ কাজ করেছে বলে অভিযোগ করেছেন স্থানীয়রা।
নদী সংলগ্ন এলাকার বাসিন্দা এম এ হাসান বলেন, “বাঁধের ভাঙনগুলো তড়িঘরি করে মেরামত করতে যেয়ে নদীর বালি-মাটি পলিব্যগে ভরে দায়সার মেরামত করেছে পাউবো। এতে পরে বর্ষায় ফের ভাঙন দেখা দিতে পারে।“
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রাশেদ শাহরিয়ার ‘জোড়াতালির সংস্কারের’ কথা অস্বীকার করে বলেন, “পলিব্যাগে মাটি ভরে বাঁশের খুঁটি গেরে স্থায়ীভাবে ভাঙা অংশগুলো মেরামত করা হচ্ছে।
“কোথাও কাজের গাফিলতি হলে তদন্ত করে ঠিকাদারের বিল আটকে রাখা হবে। ভাঙনধরা বেশিরভাগ অংশ ইতোমধ্যে মেরামত হয়েছে।“
এদিকে বন্যার পর নদী ভাঙন দেখা দিয়েছে ফেনী সদর, পরশুরাম, সোনাগাজী উপজেলার বেশকিছু গ্রামে।
পরশুরাম বাজারে মুহুরী নদীর পুর্ব অনন্তপুর গ্রামে প্রায় ৪০টি পরিবারের বসবাস। এখানে কহুয়া নদীর গতিপথ পরিবর্তন হয়ে মুহুরী নদীতে মিশেছে। গত কয়েক বছরে ভাঙনে এখানকার প্রায় ৫০ একর জমি নদীতে বিলীন হয়ে গেছে।
এবারের বন্যায় অনন্তপুর গ্রামের মমতাজ মিয়া, মফিজুর রহমানসহ আরো অনেকের ভিটেবাড়ি নদীতে বিলীন হওয়ায় পরিবারগুলো মানবেতর জীবন-যাপন করছে।
ভিটেবাড়ি হারানো নুর মিয়া বলেন, “গত দুই মাস ধরে পরিবার নিয়ে ভাড়া বাসায় আছি। আয় নাই, ৬ সদস্যের পরিবার নিয়ে কষ্টে রয়েছি।“
কহুয়া নদীর পাশে দক্ষিণ কোলাপাড়া গ্রামের প্রায় ৫০টি পরিবার ভাঙনের হুমকিতে রয়েছে। বন্যায় নদী পাড় ভেঙে কয়েকটি পরিবারের জমি, টিউবওয়েল ও টয়লেট নদীতে পড়েছে।
কহুয়া নদীর পাশে জসিম উদ্দিনের বাড়ি। তিনি বলেন, “বাড়ির যে জায়গাটুকু বাকি আছে, তাও যে কোনো সময় নদীতে ভেঙে পড়তে পারে।“
তবে পরশুরামে নদী ভাঙনের বিষয়টি পানি উন্নয়ন বোর্ড অবগত নয় বলে জানিয়েছেন নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ রাশেদ শাহরিয়ার।
তিনি বলেন, “ভাঙন এলাকা পরিদর্শন করে প্রতিবেদন পাওয়ার পর ভাঙনরোধে দ্রত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
ছোট ফেনী নদীতে নির্মিত ‘মুছাপুর রেগুলেটর’ বন্যায় ভেঙে বিলীন হওয়ায় সোনাগাজীর বিভিন্ন এলাকায় সাগরের পানি ভেতরে ঢুকে নতুন করে বিভিন্ন এলাকায় নদী ভাঙন দেখা দিয়েছে। এতে বিলীন হয়ে যাচ্ছে রাস্তাঘাট ও ফসলি জমি।
অপরদিকে সদর উপজেলার ছনুয়া ইউনিয়নের দক্ষিণ টংগীরপাড় এলাকার কালিদাস পাহালিয়া নদীর পাড় ঘেষে তৈরি হওয়া অন্তত ৫০টি ঘর নদী ভাঙনে বিলীন হয়ে যায়। ওই এলাকায় আরও শতাধিক ঘর বাড়ি ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে।
সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নাজমুল হাসান বলেছেন, ভাঙন রোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রাশেদ শাহরিয়ার বলেন, “সদরের নেয়ামতপুর, টঙ্গিরপাড় ও লেমুয়া ব্রিজ সংলগ্ন স্থানে ভাঙনের দৃশ্য দেখেছি। ইতোমধ্যে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে লিখিতভাবে জানানো হয়েছে।“
প্রাথমিকভাবে জরুরিভাবে জিও ব্যাগ ফেলার প্রস্তুতি চলছে বলেও জানিয়েছেন এই প্রকৌশলী।