আগামী তিনদিন ভারী বর্ষণের পূর্বাভাস রয়েছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হতে পারে।
Published : 19 Jun 2024, 04:26 PM
সিলেটের নদ-নদীর পানি বিপৎসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। চারদিনের টানা বৃষ্টিপাত ও উজানের পাহাড়ি ঢল অব্যাহত থাকার কারণে বুধবার জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি আরও অবনতি হয়েছে।
সিলেট মহানগরীকে দুইভাগে বিভক্ত করা সুরমা নদীর পানিতে তীরবর্তী ওয়ার্ডগুলোর বাসা-বাড়িসহ বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। ফলে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে বন্যার্তদের।
সীমান্তবর্তী উপজেলা গোয়াইনঘাট, কানাইঘাট, জৈন্তাপুর, কোম্পানীগঞ্জ, জকিগঞ্জ ও বিয়ানীবাজারের পাশাপাশি বন্যা ছড়িয়ে পড়েছে সদর, দক্ষিণ সুরমা, বিশ্বনাথ, ওসমানীনগর, ফেঞ্চুগঞ্জ, গোলাপগঞ্জ ও বালাগঞ্জ উপজেলায়।
সিলেটের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মোহাম্মদ মোবারক হোসেন বলেন, “বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। নতুন করে কিছু এলাকা প্লাবিত হয়েছে; তবে পানির লেভেল আগের থেকে বাড়েনি। বন্যাদুর্গত এলাকায় ত্রাণ বিরতণ অব্যাহত রয়েছে। মঙ্গলবার নতুন করে আরও বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। জেলা প্রশাসন বন্যা পরিস্থিতির উপর সর্তক দৃষ্টি রাখছে।”
তিনি জানান, বুধবার দুর্যোগ ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মহিবুর রহমান সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ, সিটি করপোরেশন এবং ওসমানীনগরে বন্যা পরিস্থিতি পরিদর্শন ও বন্যার্তদের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ করবেন।
সিলেট জেলা আবহাওয়া অধিদপ্তরের সহকারী আবহাওয়াবিদ শাহ মো. সজীব হোসাইন বলেন, মঙ্গলবার সকাল ৬টা থেকে বুধবার সকাল ৬টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ১০০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে।
আর বুধবার সকাল ৬টা থেকে ৯টা পর্যন্ত মাত্র তিন ঘণ্টায় ৫৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত ২৭ দশমিক ২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড-পাউবো সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী দীপক রঞ্জন দাস বলেন, “বৃষ্টিপাত অব্যাহত রয়েছে। তাই পরিস্থির উন্নতি ঘটতে সময় লাগবে। গত পাঁচ দিনে ভারতের চেরাপুঞ্জিতে ১ হাজার ৬০০ মিলিমিটারের উপরে বৃষ্টিপাত হয়েছে। তবে গত ২৪ ঘণ্টায় চেরাপুঞ্জির বৃষ্টিপাত একটু কমেছে; ১১০ মিলিমিটার হয়েছে।’’
সিলেট সিটি করপোরেশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা সাজলু লস্কর বলেন, নগরীর ৪২টি ওয়ার্ডের মধ্যে ২২টি ওয়ার্ডের ৮০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়েছেন। নগরীর ৮০টি আশ্রয়কেন্দ্রের মধ্যে ২২টিতে মানুষজন ওঠেছেন। সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীর নির্দেশনায় আশ্রয়কেন্দ্র ছাড়াও বন্যাকবলিত এলাকায় রান্না করা ও শুকনা খাবার, বিশুদ্ধ পানি, ওষুধসহ প্রয়োজনীয় সামগ্রী বিতরণ করা হচ্ছে।
বালাগঞ্জের বাসিন্দা ও স্থানীয় সাংবাদিক তারেক আহমদ বলেন, “বালাগঞ্জ উপজেলার বেশিরভাগ এলাকায় পানি রয়েছে। এসব এলাকার মানুষজন আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছেন। পানি বেড়েই চলছে। বালাগঞ্জ-ফেঞ্চুগঞ্জ সড়কে পানি থাকার কারণে যানচলাচল বন্ধ রয়েছে।”
নগরীর কোথাও হাঁটু, কোথাও কোমর সমান পানি
সকাল সাড়ে ১০টার দিকে সরেজমিনে সিলেট নগরীর তালতলা, জামতলা, যতরপুর, সোবাহনীঘাট, মেন্দিবাগ ও উপশহর এলাকায় ঘুরে দেখা গেছে, নগরীর রাস্তাঘাট-বাসাবাড়ির কোথাও-কোথাও হাঁটু থেকে কোমর পানিও রয়েছে। এসব এলাকার বাসিন্দারা নোংরা পানি মাড়িয়ে চলাচল করছেন। পানিবন্দি এলাকার মানুষজন কেউ যাচ্ছেন ভ্যান করে, কেউবা রিকশায়। বিশেষ করে উপশহরের বাসিন্দাদের নৌকা ও ভ্যানে করে চলাচল করতে হচ্ছে।
তাদের ভাষ্য, বাধ্য হয়েই চলাচল করতে হচ্ছে। ঈদের দিন ভোর থেকে নগরীর পাড়া-মহল্লায় পানি উঠতে শুরু করে। মঙ্গলবার বিকালে কিছুটা কমলেও বুধবার আবার বেড়েছে পানি।
তালতলা পয়েন্টের ব্যবসায়ী এনামুল হোসেন বলেন, “কয়েকদিন ধরে পানি রয়েছে। তাই দোকান বন্ধ। পয়েন্টের পানি কমছে না। ২০২২ সালের বন্যার কথা মনে হচ্ছে, পানি না কমলে আমাদের গত বন্যার মত কষ্ট ও দুর্ভোগ পোহাতে হবে। দোকান বন্ধ রাখলে পরিবার চলবে কিভাবে সে চিন্তাও মাথায় ঘুরছে।”
নগরীর উপশহর পয়েন্টে ভ্যান চালক সুমন মিয়া বলেন, মঙ্গলবার থেকে তিনি উপশহর এলাকায় ভ্যান চালিয়ে মানুষকে আসা-নেওয়া করছেন। পাড়ার সড়ক বুঝে ভাড়া আগে কথা বলে ঠিক করে নেন।
“গতকাল ভালো ইনকাম করেছি; আশা করছি আজও ভালো হবে। উপশহরের কোনো গলির ভেতরে কোমর পানি রয়েছে।”
একই এলাকার ডি ব্লকের বাসিন্দা রুবেল আহমদ জানান, তাদের তিনতলা বাসার নিচতলায় হাঁটুর উপরে পানি রয়েছে। তাই নিচতলার বাসিন্দরা চলে গেছেন। ঈদের দিন সকাল থেকে বাসায় পানি উঠেছে। ময়লা পানি মাড়িয়ে চলাচল করতে হচ্ছে কয়েক দিন ধরে।
“কী আর করা। ২০২২ সালের বন্যার পর যদি কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হত তাহলে পাড়ার বাসিন্দাদের আবার দুর্ভোগ-ভোগান্তি পড়তে হত না।”
মেন্দিবাগ পয়েন্টে ভ্যান চালক কামাল মিয়া বলেন, “পয়েন্ট থেকে মেন্দিবাগ মসজিদ পর্যন্ত পানি রয়েছে। আমি ভ্যানে করে মানুষদের এই জায়গা পার করে দিচ্ছি গতকাল থেকে। প্রতিজনের কাছ থেকে ১০ টাকা করে ভাড়া নিচ্ছি।”
নগরীর যতরপুর এলাকার বাসিন্দা আব্দুল খালেক (৫৫) বলেন, “আমাদের পাড়ায় ঈদের দিন সকাল থেকে পানি রয়েছে। আমি এই এলাকায় ভাড়া থাকি, আমি দুই তলার থাকার কারণে সমস্যা হয়নি। তবে আমাদের বিল্ডিংয়ের নিচতলার ভাড়াটিয়ারা আশ্রয়কেন্দ্রে চলে গেছেন। পানির কারণে আমাদের ঈদের আনন্দ হয়নি। এই পাড়ায় কিছুদিন পরপর পানি উঠার করণে রাস্তা দিয়ে চলাচল করতে সমস্যা হয়।”
একই এলাকার বেগম জাহান (৫০) হাঁটুর উপরে পানি মাড়িয়ে সোবাহানীঘাট পয়েন্টে এসেছেন। তার ভাষ্য, “বাসার ভেতরে হাঁটু সমান পানি আজ তিন দিন ধরে। রোববার ভোরে পানি ঢুকে ভিজে নষ্ট হয়েছে বাসার জিনিসপত্র। এসব জিনিসপত্রসহ বাসার লোকজন খাটের উপর বসে রাত-দিন কাটাচ্ছে।”
পানি না কমলে আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে হবে জানিয়ে তিনি বলেন, “এই ভোগান্তি আর শরীরে মানে না। পানি কমার কোনো লক্ষণও দেখছি না। ময়লা পানি দিয়ে চলাচল করলে হাত-পা চুলকায়, কী আর করা, চলাচল না করেও পারা যায় না। বাসার উপর তলায় রান্না হচ্ছে। তবে বিশুদ্ধ পানির জন্য বাইরে আসতে হয়; ভিজে নিতে হয় পানি। ঈদের দিন থেকে এভাবেই চলছে।”
সোবাহানীঘাটের বাসিন্দা ও নগরীর দি এইডেড স্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্র চয়ন দাস জানায়, ঈদের দিন সকাল থেকে তাদের বাসায় পানি প্রবেশ করে। বর্তমানে বাসায় কোমর পানি রয়েছে। পরিবারের পাঁচ সদস্য পাশের বাসার দোতলায় গিয়ে উঠেছে ঈদের দিন। তাদের পাড়ার আরও অনেকে অন্য জায়গায় চলে গেছে।
নগরীর বেতেরবাজার এলাকার বাসিন্দা পারভেজ আহমদ বলেন, “সোমবার দুপুর থেকে বাসায় পানি ওঠেছে। বর্তমানে বাসার ভেতরে হাঁটুপানি। পরিবারের সবাইকে নিয়ে খাটের উপর বসে আছি। বুধবার পর্যন্ত কোনো সহায়তা পাইনি, ঘরের থাকা খাবার চলছে। আজ আরও পানি বেড়েছে, মঙ্গলবার একটু কমেছিল। আমাদের পুরো পাড়াতে পানি রয়েছে। আর আমাদের পাশের লামাপাড়ার বাসার বাড়িতে কোমর পানি রয়েছে। এই হচ্ছে আমাদের অবস্থা।”
বেড়েছে পানিবন্দি মানুষের সংখ্যা
সিলেট জেলা প্রশাসন জানায়, বন্যাদুর্গত এলাকার ১৭ হাজারের বেশি মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান করছেন। আগামী তিনদিন ভারী বর্ষণের পূর্বাভাস রয়েছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হতে পারে। মঙ্গলবার পর্যন্ত মহানগরের ২১টি ওয়ার্ড ও জেলার ১৩টি উপজেলার ১১৬টি ইউনিয়নের ১ হাজার ৩২৩টি প্রাম প্লাবিত হয়েছে।
এতে ছয় লাখ ৭৫ হাজার ৯৩৭ জন বন্যা আক্রান্ত হয়েছে। এর মধ্যে সিলেট মহানগরে অর্ধলাখ মানুষ পানিবন্দি। আর জেলা ও নগরী মিলিয়ে ৬২৭টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে; এর মধ্যে মহানগরে ৮০টি। এসব আশ্রয়কেন্দ্রে ১৭ হাজার ২৮৫ জন মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন।
বিপৎসীমার উপরে নদ-নদী
পানি উন্নয়ন বোর্ড-পাউবোর তথ্যমতে, সিলেটের কুশিয়ারা নদীর পানি আমলশীদ পয়েন্টে মঙ্গলবার ১৫ দশমিক ৮৭ সেন্টিমিটার দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল; যা বিপৎসীমার ৪৭ সেন্টিমিটার উপরে ছিল। বুধবার সকাল ৬টায় এক পয়েন্ট কমে বিপৎসীমার ৪৬ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সকাল ৯টায়ও অবস্থা অপরিবর্তি রয়েছে।
তবে এই নদীর পানি ফেঞ্চুগঞ্জ পয়েন্টে মঙ্গলবারের তুলনায় বুধবার আরও বেড়েছে; মঙ্গলবার পানি বিপৎসীমার ৮৮ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। বুধবার সকাল ৬টায় তা বেড়ে বিপৎসীমার ৯২ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সকাল ৯টার প্রতিবেদনে অবস্থা অপরিবর্তিত রয়েছে।
মঙ্গলবার সুরমার পানি কানাইঘাট পয়েন্টে বিপৎসীমার ১২২ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। বুধবার সকালে তা কমে বিপৎসীমার ৯৩ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সকাল ৯টায় আরও দুই পয়েন্ট কমে ৯১ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
তবে সুরমা নদীর পানি সিলেট পয়েন্টে মঙ্গলবারের চেয়ে আজ সকালে আরও বেড়েছে। মঙ্গলবার এই পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার ২৫ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। বুধবার সকালে তা বেড়ে বিপৎসীমার ৩৮ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সকাল ৯টায় এক পয়েন্ট কমে বিপৎসীমার ৩৭ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
সারি-গোয়াইন নদীর সারিঘাট পয়েন্টে বিপৎসীমার ০ দশমিক ৯ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে।
আরও পড়ুন:
নেত্রকোণায় তিন নদীর পানি বাড়ছে, একটির কমেছে
তিস্তা-দুধকুমার বিপৎসীমার উপরে, বাড়ছে ধরলা-ব্রহ্মপুত্রের পানি
সুনামগঞ্জে দোকানপাটে পানি ঢুকে ব্যবসায়ীদের ক্ষতি
মৌলভীবাজারের ৪ উপজেলায় বন্যা, নদীর পানি বিপৎসীমার উপরে
সিলেটে পানিবন্দি ৪ লাখ, আশ্রয়কেন্দ্রে যাচ্ছে মানুষ
ঢলে ডুবছে সুনামগঞ্জ, যোগাযোগ ও বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন
বন্যার মধ্যে সিলেটের সব পর্যটনকেন্দ্র বন্ধ ঘোষণা
বাড়ছে নদ-নদীর পানি,সিলেটে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি
নেত্রকোণায় বাড়ছে নদ-নদীর পানি,বন্যার শঙ্কা
সিলেটে জলাবদ্ধ ড্রেনে পড়ে শিশুর মৃত্যু
নেত্রকোণায় নদ-নদীর পানি বিপৎসীমা ছুঁই ছুঁই
পাহাড়ি ঢল-বৃষ্টিতে সুনামগঞ্জে নিচু এলাকায় পানি
বিপৎসীমার উপরে সুরমা,বন্যার শঙ্কা