“মেয়ে তো এখন বড়, বিচারের কথা জিজ্ঞেস করে, কিন্তু উত্তর দিতে পারি না। খুনিগো শাস্তিটা দেখলে অন্তত শান্তি পাইতাম।”
Published : 27 Apr 2025, 01:01 PM
নারায়ণগঞ্জের আলোচিত সাত খুনের ঘটনায় গাড়িচালক জাহাঙ্গীর আলম যখন নিহত হন তখন তার স্ত্রী শামসুন্নাহার আক্তার নুপুর সাতমাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। আগামী জুলাইতে তাদের একমাত্র মেয়ে রোজা আক্তার জান্নাতের বয়স ১১ বছর হবে।
বাবার মৃত্যুর পর জন্ম নেওয়া রোজা এখন স্থানীয় একটি হাফেজিয়া মাদ্রাসায় পড়ছে। তার কাছে বাবা মানে কেবল পুরোনো ছবি। তা আঁকড়েই বাবা হারানোর বেদনা প্রশমনের চেষ্টা ছোট্ট এই শিশুর।
“আমি আমার বাবাকে দেখি নাই, আদর-স্নেহ পাই নাই। মাদ্রাসায় আমার বান্ধবীদের তাদের বাবা দিয়ে আসে, আবার নিয়েও যায়। অনেক সময় রাতে মা কিংবা দাদি ব্যস্ততার কারণে আমাকে নিতে আসতে দেরি হলে আমি বাবাকে খুব মিস করি।
“বাবা বেঁচে থাকলে তিনিই আমাকে মাদ্রাসায় দিয়ে আসতেন এবং নিয়ে আসতেন”, কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলছিল রোজা।
শিশুটি মাঝে মাঝেই তার বাবার হত্যাকারীদের বিচারের বিষয়ে জানতে চায়, তবে সে প্রশ্নের কোনো জবাব দিতে পারেন না বলে জানান রোজার মা শামসুন্নাহার আক্তার নুপুর।
তিনি বলেন, “মেয়ে তো এখন বড়, বিচারের কথা জিজ্ঞেস করে, কিন্তু উত্তর দিতে পারি না। খুনিগো শাস্তিটা দেখলে অন্তত শান্তি পাইতাম।”
জাহাঙ্গীরের স্ত্রী নুপুরের মত এমন আক্ষেপ এই হত্যাকাণ্ডে নিহত অন্যদের পরিবারের সদস্যদেরও।
জাহাঙ্গীর আলমের সঙ্গে ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ সংযোগ সড়ক (লিংক রোড) থেকে অপহরণের শিকার হয়েছিলেন নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের তৎকালীন কাউন্সিলর ও প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম, আইনজীবী চন্দন সরকারসহ মোট সাতজন।
তিনদিন পর ৩০ এপ্রিল শীতলক্ষ্যা নদীতে ভেসে ওঠে তাদের মরদেহ।
হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়া অন্যরা হলেন- নজরুলের সহযোগী তাজুল ইসলাম, বন্ধু সিরাজুল ইসলাম লিটন, মনিরুজ্জামান স্বপন ও আইনজীবী চন্দনের গাড়িচালক ইব্রাহিম। জাহাঙ্গীর আলম ছিলেন স্বপনের গাড়িচালক।
এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় তখন ক্ষোভে ফুঁসে উঠেছিলেন সারাদেশের মানুষ।
ঘটনার তিন বছরের মাথায় সাবেক এক কাউন্সিলর ও তিন র্যাব কর্মকর্তাসহ ২৬ আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দেয় বিচারিক আদালত। পরের বছর উচ্চ আদালত ১৫ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখলেও বাকিদের সাজা কমিয়ে দেন।
কিন্তু মামলাটি আপিল বিভাগে আটকে থাকায় দীর্ঘ ১১ বছরেও নিহত পরিবারগুলোর ন্যায়বিচারের অপেক্ষার অবসান হয়নি।
দীর্ঘবছর ধরে নিহতদের স্বজন ও বাদীপক্ষের আইনজীবীর অভিযোগ ছিল আদালতে রায় কার্যকর না হওয়ার পেছনে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের অনীহা কাজ করেছিল।
কিন্তু গণঅভ্যুত্থানের মুখে ওই সরকারের পতন হওয়ার পর এখনও আপিল বিভাগে মামলাটি নিষ্পত্তি না হওয়ায় চাপা ক্ষোভ রয়েছে নিহত পরিবারগুলোতে।
রায় কার্যকরের দীর্ঘসূত্রিতায় আসামিরা শাস্তি পাবেন কিনা তা নিয়েও সন্দিহান জাহাঙ্গীরের স্ত্রী শামসুন্নাহার।
হতাশার সুরে তিনি বলেন, “এই ঘটনার পর সারাদেশ তোলপাড় হইয়া গেলো। কিন্তু সেই হত্যার বিচারও যে ১১ বছর ধইরা আটকাইয়া থাকবো তা কখনো ভাবি নাই।”
‘সরকারি লোকজন’ জড়িত ছিল বলে এই হত্যার রায় কার্যকর হয়নি বলে মন্তব্যের পর তিনি প্রশ্ন রাখেন, “আওয়ামী লীগ সরকার তো নাই, এখনও এই বিচারের কাজ শেষ হয় না কেন?”
মৃত্যুর আগে ছেলে হত্যার বিচার দেখে যেতে চান নিহত তাজুল ইসলামের বাবা আবুল খায়ের।
তিনি বলেন, “বর্তমানে যে সরকার আছে তারা তো জানেন কীভাবে খুনটা করা হয়েছে। সিভিল লোকের প্ররোচনায় পইড়া আইনের লোকেরা এই ঘটনা ঘটাইলো। আমরা বিচার দেখার আশায় আছি। দুইজনের বাবা এর মধ্যে মারা গেছেন। আমরাও বিচার দেখে যেতে পারবো কিনা তা নিয়ে সন্দেহ।”
ঘটনার দিন একটি মামলায় হাজিরা শেষে কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম বাড়ি ফেরার জন্য রওনা হয়েছিলেন। তবে তার আর বাড়ি ফেরা হয়নি।
দীর্ঘ বছরেও এই মামলার আসামিরা শাস্তি না পাওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করে নজরুলের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বলেন, “নির্মম এই হত্যাকাণ্ডের জন্য যদি শাস্তি না হয়, তাহলে অপরাধীরা আরও সাহস পেয়ে যাবে। নিম্ন ও উচ্চ আদালতে রায় হওয়ার পরও তা কার্যকর হচ্ছে না। অপরাধীদের শাস্তি না হওয়ায় আমাদের মধ্যে আতঙ্ক থাকে সবসময়।”
নজরুলের বড় ছেলে তরিকুল ইসলাম বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ায় এমএসসি করছেন। ছোট ছেলে জাহিদুল ইসলাম একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক এবং একমাত্র মেয়ে নাজিফা ইসলাম একটি মেডিকেল কলেজে পড়ছেন।
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নজরুলের স্ত্রী বেলন, “তাদের বাবার স্বপ্ন ছিল ছেলে-মেয়েরা ভালো জায়গায় পড়াশোনা করবে, জীবনে সফলতা পাবে। তার স্বপ্ন সত্যি হয়েছে। কিন্তু সেটা দেখার জন্য লোকটাই বেঁচে নেই।”
আলোচিত এই মামলার রায়ে ২০১৭ সালের ১৬ জানুয়ারি নারায়ণগঞ্জ জেলা ও দায়রা জজ আদালত সাবেক কাউন্সিলর নূর হোসেন ও র্যাবের সাবেক তিন কর্মকর্তাসহ ২৬ আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দেন। ওই রায়ের বিরুদ্ধে আসামিরা উচ্চ আদালতে যান।
২০১৮ সালের অগাস্টে উচ্চ আদালত ১৫ আসামির মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে বাকিদের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেন। এরপর আপিল করা হয়।
কিন্তু গত সাত বছর ধরেই মামলাটি সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে শুনানির অপেক্ষায় আছে বলে জানিয়েছেন নারায়ণগঞ্জ জেলা ও দায়রা জজ আদালতের রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি (পিপি) আবুল কালাম আজাদ।
এছাড়া বিগত বছরগুলোতে আপিল বিভাগে মামলাটির কোনো শুনানিও হয়নি জানিয়ে বাদীপক্ষের আইনজীবী ও মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক সাখাওয়াত হোসেন খান বলেন, “নারায়ণগঞ্জে বিচারিক আদালত মামলাটির রায় ঘোষণা করেছে ২০১৭ সালে। এরপর কয়েকজনের সাজা কমালেও পূর্ণাঙ্গ রায় ঘোষণা করেন হাইকোর্ট। আমরা ভেবেছিলাম, এই রায় কার্যকর হলে দেশে যে হত্যা, গুমের যে সংস্কৃতি চালু হয়েছিল সেটি বন্ধ হয়ে যাবে।
“কিন্তু তৎকালীন ফ্যাসিস্ট সরকার আসামিদের দিয়ে অ্যাপিলেট ডিভিশনে রিভিশন আবেদন দাখিল করায়। কিন্তু এখন পর্যন্ত এই রিভিশন আপিলের শুনানি আর হয়নি।”
“মামলাটি অগ্রাধিকার দিয়ে দ্রুত শুনানি বিষয়ে আমরা চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু আসামি ও রাষ্ট্রপক্ষ এটা চায়নি। তৎকালীন সরকার আসামিদের প্রচ্ছন্নভাবে সহযোগিতা করেছে। এটি একটি ওয়েল প্রুভড কেস।”
তিনি আরও বলেন, “আমরা আশা করি, দেরিতে হলেও এই মামলার বিচার কার্যক্রম দ্রুত শেষ করতে অন্তর্বর্তী সরকার নির্দেশনা দিবে।”
এ বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি আবুল কালাম আজাদ বলেন, “মামলাটি দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য অ্যাটর্নি জেনারেল ও রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা এই মামলাটির বিষয়ে খুবই আন্তরিক। অন্তর্বর্তী সরকারও চাচ্ছে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে এই মামলাটির রায় চূড়ান্ত করতে।”
নারায়ণগঞ্জে ৭ খুন: এক দশক ধরে বিচারের অপেক্ষায় স্বজনরা
সাত খুন: রায় কার্যকর নিয়ে 'হতাশায়' নিহতের স্বজনরা
র্যাবের বর্ণনায় ৭ খুনের আদ্যোপান্ত