“বাংলাদেশে সাত বছর পার হয়ে গেছে, কোনো সমাধান হয়নি। আমরা নিজ দেশে ফিরে যেতে চাই।”
Published : 25 Aug 2024, 10:35 PM
নির্যাতন-গণহত্যা বন্ধ এবং নিজ দেশে ফিরতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সর্বোচ্চ সহযোগিতা চেয়েছেন কক্সবাজারের আশ্রয়রত রোহিঙ্গারা।
রোহিঙ্গা সংকটের সাত বছরে এসে রোববার কক্সবাজারের উখিয়া ক্যাম্পে আয়োজিত সমাবেশে এ দাবি জানিয়েছেন তারা। সকাল ১০টা থেকে ক্যাম্পের বিভিন্ন স্থানে সাধারণ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ব্যানারে আয়োজন করা হয় সমাবেশ ও দোয়া মাহফিলের।
২৫ অগাস্টকে ‘গণহত্যা দিবস’ চিহ্নিত করে হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবিতে নানা স্লোগান ছিল আয়োজকদের ব্যানার ও ফেস্টুনে। সমাবেশে অংশ নেওয়া রোহিঙ্গাদের অধিকাংশই ছিলেন সাদা পোশাকে। যেসব পোশাকে ছিল নানা দাবি।
রোহিঙ্গা ক্যাম্প সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ৩৩টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ১৩-১৪টি স্থানে পৃথকভাবে একযোগে অনুষ্ঠিত হয়েছে এমন সমাবেশ। সবচেয়ে বড় জমায়েত হয়েছে উখিয়ার কুতুপালংয়ের ৪ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মাঠে।
বৃষ্টি উপেক্ষা করে সকাল ১০টা থেকে দুপুর পর্যন্ত এই সমাবেশ ঘিরে লাখের বেশি রোহিঙ্গা নর-নারীর অংশগ্রহণ দেখা গেছে। তারা গণহত্যার ঘটনায় আন্তর্জাতিক আদালতের বিচার দ্রুত শেষ করার দাবি জানান এবং নিহতের আত্মার মাগফেরাত কামনা করে বিশেষ মোনাজাত করেন।
মোনাজাতে মিয়ানমারের ২০১৭ সালের নির্যাতন-নিপীড়ন, হত্যাযজ্ঞ বর্ণনা করে কান্নায় ভেঙে পড়েন অংশগ্রহণকারীরা। নিহতদের জন্য দোয়া কামনা করে মিয়ানমারে বর্তমানে চলমান নির্যাতন বন্ধে সৃষ্টিকর্তার সহায়তা চান এবং বিশ্ববাসীর সুদৃষ্টি কামনা করেন। আশ্রয় ও মানবিক সহযোগিতার জন্য বাংলাদেশের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন তারা।
সমাবেশে রোহিঙ্গা নির্যাতন নিয়ে সংগীত পরিবেশন ছাড়াও নেতারা বক্তব্য দেন।
রোহিঙ্গা কমিউনিটি নেতারা বলেছেন, ২০১৭ সালের ২৫ অগাস্ট মিয়ানমারের সামরিক জান্তার গণহত্যার মুখে লাখ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসে আশ্রয় নেয়। সামরিক জান্তা রোহিঙ্গাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দিয়েছে। তারা আরাকানে জাতিগত নিধন চালিয়ে গেছে। ২০১৭ সালের পর এ বছর আরাকানে রোহিঙ্গা জাতি দ্বিতীয় গণহত্যার শিকার হচ্ছে। বর্তমানে রাখাইন রাজ্যে আরাকান আর্মি রোহিঙ্গাদের ওপর দ্বিতীয় দফা গণহত্যা চালাচ্ছে।
তারা বলেন, দেশে ফিরে যাওয়ার জন্যে গণহত্যা দিবস পালন করা হচ্ছে। নতুন অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে সবচেয়ে বেশি প্রত্যাশা রেখে অনেকেই বলেন, এই দিনে মিয়ানমার জান্তা সরকার তাদের ওপর গণহত্যা চালিয়েছে। এই দেশে আর কত বছর থাকবে রোহিঙ্গারা? আর থাকতে চায় না তারা। স্বদেশে ফিরতে চায়। মিয়ানমার তাদের দেশ। অনতিবিলম্বে তাদের ফেরত নিতে হবে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে প্রত্যাবাসন সফল করতে তাদের পাশে থাকতে হবে।
সমাবেশে বক্তব্য দেন রোহিঙ্গা এফডিএমএন রিপ্রেজেনটেটিভ কমিটির বোর্ড সদস্য ছৈয়দ উল্লাহ, রোহিঙ্গা এফডিএমএন রিপ্রেজেনটেটিভ কমিটির মুখপাত্র কামাল হোসেন, মাস্টার রশিদ, আহমদ মাস্টার, রহমত উল্লাহ।
ছৈয়দ উল্লাহ বলেন, “এখন সেদেশে থাকা রোহিঙ্গাদের 'জেনোসাইড' করছে আরকান আর্মি। আরকানের জমিতে আরকান আর্মি মে মাসে বুথিডংয়ে দুই হাজারের ওপর মানুষ হত্যা করেছে।
“এ ছাড়া অগাস্ট মাসে বোমা হামলায় বহু মানুষ মারা গেছে। যার কারণে এখনও টেকনাফের নাফ নদীতে রোহিঙ্গাদের মরদেহ ভেসে আসছে।”
তিনি বলেন, “বাংলাদেশে সাত বছর পার হয়ে গেছে, কোনো সমাধান হয়নি। আমরা নিজ দেশে ফিরে যেতে চাই। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বলছি, আমরা সেফ জোন পেলে ফিরে যাব নিজ দেশে।”
ক্যাম্পে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা ১৪ এপিবিএনের অধিনায়ক অতিরিক্ত উপ-মহাপরিদর্শক (এডিআইজি) মোহাম্মদ ইকবাল বলেন, “ক্যাম্পে শান্তিপূর্ণভাবে কর্মসূচি শেষ হয়েছে। ক্যাম্পে যাতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি না হয় সেজন্য নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। বৃষ্টির কারণে রোহিঙ্গারা দ্রুত কর্মসূচি শেষ করেছে। কর্মসূচিতে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে ফিরে যেতে বিভিন্ন দাবি তুলে ধরেন।”
কক্সবাজারের অতিরিক্তি শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার সামসু-দৌজা বলেন, “রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন ক্যাম্পে 'জেনোসাইড ডে' পালন করেছে। শান্তিপূর্ণভাবে তাদের কর্মসূচি শেষ হয়েছে। সেখানে তারা নিজ দেশে ফিরে যেতে বিভিন্ন দাবি তুলে ধরেন।”
এ ছাড়া ১, ৩, ৫, ৭, ৯, ১২, ১৩, ৮, ১৮, ১৯ নম্বরসহ ১৩ স্থানে একই ধরনের সমাবেশ হয়েছে।
২০১৯ সালের ২৫ অগাস্ট ক্যাম্পে প্রথম বড় সমাবেশ করা হয়, যার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যানিটির চেয়ারম্যান মাস্টার মুহিবুল্লাহ। পরে তিনি মিয়ানমারের সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আরসার সন্ত্রাসীদের হাতে নিহত হন।
তবে এবারের সমাবেশে আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যানিটির কোনো সদস্যকে দেখা যায়নি।
এ বিষয়ে আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যানিটির বর্তমান চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জোবায়ের বলেন, “ক্যাম্পে সাত বছর উপলক্ষে আজকে 'গণহত্যা' দিবসে পালন করা হয়েছে। কিন্তু যেই এই দিনটি পালন করতে ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে তার (মাস্টার মুহিব উল্লাহ) নাম পর্যন্ত স্মরণ করা হয়া না। এটা খুব দুঃখজনক।”
এ রোহিঙ্গা নেতা বলেন, “ইচ্ছা থাকার সত্ত্বেও নিরাপত্তার কারণে সেখানে (সমাবেশে) যাওয়া সম্ভব হয়নি। ২০১৭ সালে ২৫ আগস্টে ‘জেনোসাইডের' কারণে সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গাদের বিতাড়িত করা হয়েছে। তখন সেখানে আরও সাড়ে ছয় লাখ রোহিঙ্গা ছিল।
“কিন্তু এখন জান্তা সরকার এবং আরকান আর্মি মিলে ফের যুদ্ধের নামে সেখানে থাকা রোহিঙ্গাদের দেশ ছাড়া করছে। এটির শক্ত প্রমাণ রয়েছে। বোমা এবং ড্রোন হামলায় এখন রোহিঙ্গাদের মেরে ফেলা হচ্ছে।”
“আমরা আর বাংলাদেশের বোঝা হয়ে থাকতে চাই না”- মন্তব্য করে তিনি বলেন, “আর টু পি দিয়ে 'সেফজোন' পেলে আমরা এখনি মিয়ানমারে ফিরে যাব। তবে আমাদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ সরকার এবং জনগণকে ধন্যবাদ জানাই।”