প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে খুশি চা শ্রমিকরা

ভার্চুয়াল এ সভায় শ্রমিকরা ভূমির অধিকার দাবি করলে প্রধানমন্ত্রী বলেন, "তারা ভূমিহীন থাকবে এটা হতে পারে না।"

মৌলভীবাজার প্রতিনিধিসিলেট প্রতিনিধি ও হবিগঞ্জ প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 Sept 2022, 04:04 PM
Updated : 3 Sept 2022, 04:04 PM

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে নিজেদের জীবনের দুঃখ-দুর্দশার চিত্র তুলে ধরার পর তা থেকে পরিত্রাণের আশ্বাস পেয়ে খুশি দেশের চা শ্রমিকরা।

দৈনিক মজুরি বাড়ানোর ঘোষণার এক সপ্তাহের মাথায় শনিবার বিকালে ভিডিও কনফারেন্সে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে যুক্ত হয়ে কথা বলেন মৌলভীবাজার, সিলেট, হবিগঞ্জ ও চট্টগ্রামের চা শ্রমিকরা।

এসময় মৌলভীবাজারের চা শ্রমিক গীতা পাইনকা বলেন, “প্রধানমন্ত্রী আপনি আপনার বাবার মতো আমাদের পাশে আছেন। আপনি আমাদের মা জননী। আপনি মজুরি বৃদ্ধির জন্য যে কষ্ট করেছেন এর জন্য আমরা কৃতজ্ঞ। আপনি আমাদের কষ্ট বোঝার জন্য ধন্যবাদ।”

চা বাগান শ্রমিকরা ভার্চুয়াল এ সভায় নিজেদের ভূমির অধিকার দাবি করেন। হবিগঞ্জের চুনারুঘাটের চন্ডিছড়া চা বাগান, মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের পাত্রখোলা, সিলেট সদরের লাক্কাতুরা এবং চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির কর্ণফুলী চা বাগানের শ্রমিকরা নিজেদের বক্তব্য তুলে ধরেন।

পাত্রখোলার সোনামনি রাজবংশী, চন্ডিছড়ার শিমুল রানী রায়, শ্যামলী গোয়ালাসহ বেশ কয়েকজন শ্রমিক ভূমির মালিকানা, বাসস্থান, মাতৃত্বকালীন ছুটি বৃদ্ধি, হাসপাতাল, অ্যাম্বুলেন্স সুবিধা এবং সন্তানদের উচ্চ শিক্ষার ব্যবস্থার দাবি জানান।

এ সময় প্রধানমন্ত্রী চা শ্রমিকদের উদ্দেশে বলেন, “আপনাদের সাথে কথা বলে অনেক কিছু জানলাম। সবই আমি ব্যবস্থা করব। যারা শ্রম দেয়, কষ্ট করে, তাদের দিকে তাকানো আমাদের দরকার। আমার বাবা কৃষক শ্রমিক মেহনতি মানুষের জন্য এ দেশ স্বাধীন করেছেন।

“তারাই এ বাংলাদেশে কষ্টে থাকবে এটা মেনে নিতে পারি না।”

চা শ্রমিকদের ব্রিটিশরা এনে অমানবিক খাটাত উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, “আমার বাবা তাদের ভোটাধিকার দিয়েছিলেন। তারা ভূমিহীন থাকবে এটা হতে পারে না। সকলের জন্য বাসস্থানের ব্যবস্থা করব।

“তারা কোনোদিকে তাকায় না। শুধু পরিশ্রম করে। চা শ্রমিকরা অবহেলিত থাকবে, এটা হতে পারে না। প্রত্যেকটি পরিবার তাদের অধিকার যেন তাদের মাটিতে থাকে সে ব্যবস্থা করব।"

মৌলভীবাজার

ভিডিও কনফারেন্সে মৌলভীবাজার প্রান্তে চা শ্রমিক সন্তানরা প্রধানমন্ত্রীর সম্মানে তাদের ঐতিহ্যবাহী কাটিনৃত্য ও ঝুমুর নৃত্য পরিবেশন করেন।

প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে এই আলোচনায় মৌলভীবাজারেরর ৯২টি চা বাগান থেকে দেড় হাজার শ্রমিক অংশ নেন। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের সময় প্রচণ্ড বৃষ্টি শুরু হয়। এ সময় প্যান্ডেলের বাইরেও কয়েকশ চা শ্রমিক বৃষ্টিতে ভিজেই বক্তব্য শুনেন।

পাত্রখলা চা বাগানের ধলই ভ্যালি মাঠে উপস্থিত ছিলেন শ্রীমঙ্গল-কমলগঞ্জ আসনের সংসদ সদস্য উপাধ্যক্ষ আব্দুস শহীদ, মৌলভীবাজার-৩ আসনের সংসদ সদস্য নেছার আহমদ, জেলা প্রশাসক মীর নাহিদ আহসান, জেলা পরিষদ প্রশাসক মিছবাহুর রহমান, কমলগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা আলহাজ অধ্যাপক রফিকুর রহমান, মৌলভীবাজারের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ জাকারিয়া, সিনিয়র পুলিশ সুপার (সার্কেল শ্রীমঙ্গল) কমলগঞ্জ শহিদুল ইসলাম মুন্সি, শ্রীমঙ্গল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আলী রাজিব মাহমুদ মিঠুন, কমলগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সিফাত উদ্দিন।

প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের আগে চা শ্রমিকদের উদ্দেশে বক্তব্যে সংসদ সদস্য উপাধ্যক্ষ আব্দুস শহীদ বলেন, প্রধানমন্ত্রী চা শ্রমিকদের ভালোবাসেন বলেই আজ শত ব্যস্ততার মধ্যেও আপনাদের সঙ্গে কথা বলতে এসেছেন। প্রধানমন্ত্রী চা শ্রমিক আন্দোলন প্রশমিত করার জন্য সরাসরি হস্তক্ষেপ করে মজুরি ১৭০ টাকায় উন্নীত করে দিয়েছেন। আগামীতেও তিনি সব সমস্যা দেখবেন।

সিলেট

প্রধানমন্ত্রীর কাছে নিজেদের দুঃখের কথা তুলে ধরবেন এ নিয়ে সকাল থেকেই উচ্ছ্বাস ছিলো শ্রমিকদের মাঝে। বিকেল সাড়ে ৪টায় আসে সেই মহেন্দ্রক্ষণ। প্রধানমন্ত্রীকে ভিডিওতে দেখেই স্লোগান দেন শ্রমিকরা। শুরুতেই স্বাগত বক্তব্য দেন প্রধানমন্ত্রী। সেসময় তিনি চা শিল্পে জাতির পিতার অবদান তুলে ধরেন।

সিলেটের লাক্কাতুরা চা বাগান এলাকার গলফ মাঠে আয়োজিত অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন জেলা প্রশাসক মো. মজিবর রহমান। শুরুতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্মরণ করে এবং প্রধানমন্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে লাক্কাতুরা বাগানের নারী শ্রমিক শ্যামলি গোয়ালার হাতে মাইক্রোফোন তুলে দেন জেলা প্রশাসক।

ইতিহাসের সাক্ষী হওয়া শ্যামলি গোয়ালা আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন এবং বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন।

পরে প্রধানমন্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে কয়েকটি দাবি পেশ করেন তিনি। সেগুলো হচ্ছে- সিলেটের চা শ্রমিকদের জন্য নিজস্ব ভূমি ও ঘর, চিকিৎসাসেবায় অ্যাম্বুলেন্স ও বিশেষজ্ঞ ডাক্তার এবং চা শ্রমিক গর্ভবতী নারীদের চার মাসের বদলে ছয় মাসের ছুটির ব্যবস্থা করা।

শ্যামলি গোয়ালার পরে বক্তব্য দেন চা শ্রমিক ইউনিয়ন সিলেট ভ্যালির সভাপতি রাজু গোয়ালা। তিনি চা শ্রমিক সন্তানদের জন্য চাকরির ক্ষেত্রে আলাদা কোটা ও উচ্চতর শিক্ষা অর্জনের সুযোগ প্রদান এবং গ্র্যাচুইটি (অনিবার্য কারণবশত: পাঁচ বছর পর চাকরি ছেড়ে দিলে এককালীন ভাতা বা বখশিশ) ব্যবস্থা চালুর দাবি জানান।

এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রী নিজে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে চা শ্রমিকদের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে সেগুলো দূর করার ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন এমন দাবি জানান রাজু গোয়ালা।

তাদের বক্তব্য শেষে প্রধানমন্ত্রী চা শ্রমিকদের শিক্ষা, চিকিৎসা ও বাসস্থানসহ নাগরিক বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করে দেওয়ার আশ্বাস দেন।

প্রধানমন্ত্রীও চা শ্রমিকদের কান্নাময় বক্তব্য শুনে অনেকটা আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন।

তিনি বলেন, “আমার তো বাবা-মা কেউ নেই। আপনারাই আমার সব। আপনাদের সব দাবি পূরণ করা হবে।”

সিলেটের অনুষ্ঠানস্থলে উপস্থিত ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও সিলেট-১ আসনের সংসদ সদস্য এ কে আব্দুল মোমেন, সিলেট রেঞ্জের ডিআইজি মফিজ উদ্দিন আহম্মেদ, জেলা প্রশাসক মো. মজিবুর রহমান, সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মো. নিশারুল আরিফ, সিলেট জেলা পুলিশ সুপার আব্দুল্লাহ আল মামুন, সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মাসুক উদ্দিন আহমদ, জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য শফিকুর রহমান চৌধুরী, সিলেট-৩ আসনের সংসদ সদস্য হাবিবুর রহমান হাবিব, মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক জাকির হোসেন, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট নাসির উদ্দিন খান।

হবিগঞ্জ

সভা শুরুর কয়েক ঘণ্টা আগেই চা শ্রমিকরা চন্ডিছড়া বাগান মাঠে নিজ নিজ বাগানের ব্যানার ফেস্টুন নিয়ে হাজির হন। প্রধানমন্ত্রীর সভাকে কেন্দ্র করে গত কয়েকদিন ধরে চা বাগানগুলোতে উৎসবের আমেজ বিরাজ করছিল।

অনুষ্ঠানে ২৪টি বাগানের চা শ্রমিক, বাগান কর্তৃপক্ষসহ চুনারুঘাট উপজেলা আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতারা উপস্থিত ছিলেন।

এ সময় উপস্থিত ছিলেন বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুব আলী, হবিগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সংসদ সদস্য মো. আবু জাহির, সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট আব্দুল মজিদ খান, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও জেলা পরিষদ প্রশাসক ডা. মুশফিক হোসেন চৌধুরী, হবিগঞ্জের জেলা প্রশাসক ইশরাত জাহান, পুলিশ সুপার এস এম মুরাদ আলী, চুনারুঘাট উপজেলা চেয়ারম্যান আব্দুল কাদির লস্কর।

আরও পড়ুন

চা শ্রমিকদের ঘর দেওয়ার ঘোষণা প্রধানমন্ত্রীর

ভিডিও কনফারেন্সে চা শ্রমিকদের কথা শুনবেন প্রধানমন্ত্রী

কাজে ফিরেছেন চা শ্রমিকরা, সিলেটের বাগানে বাগানে প্রাণচাঞ্চল্য

৫০ টাকা বাড়িয়ে চা শ্রমিকদের মজুরি ১৭০ টাকা নির্ধারণ

আন্দোলনে নেমে ভাতও বন্ধ, বাঁচবে কি করে চা শ্রমিক?

চা শ্রমিকের মজুরি বেড়ে ১৪৫ টাকা, আন্দোলন প্রত্যাহার

১২০ টাকায় কীভাবে সংসার চলে, প্রশ্ন চা শ্রমিকের