নারায়ণগঞ্জে পরিবেশ ছাড়পত্র ও লাইসেন্সবিহীন অবৈধ ইটভাটা ১৮ ডিসেম্বরের মধ্যে বন্ধের লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে কর্তৃপক্ষ। তবে কতটুকু কার্যকর হবে তা নজরে রাখছেন পরিবেশবাদীরা।
Published : 04 Dec 2019, 03:19 PM
জেলার চার শতাধিক ভাটার মধ্যে ৩০ শতাংশের বেশি অবৈধ ইটভাটা থাকলেও নারায়ণগঞ্জ পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক সাঈদ আনোয়ার আগামী ১৮ ডিসেম্বরের মধ্যে অবৈধ ইটভাটাগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেন বলে জানিয়েছেন।
সাঈদ আনোয়ার বলেন, “এরই মধ্যে তিনটি অভিযানে সাতটি ইটভাটা ভেঙে দেওয়া হয়েছে। চারটির কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
গত মাসের শেষ সপ্তাহে রাজধানীর বায়ু দূষণ কমাতে ঢাকাসহ নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, গাজীপুর ও মানিকগঞ্জ জেলার সব অবৈধ ইটভাটা ১৫ দিনের মধ্যে বন্ধের নির্দেশ দেয় হাই কোর্ট।
দেশের ৮ হাজার ৩৩টি ইটভাটার মধ্যে ২ হাজার ৫১৩টি ইটভাটারই পরিবেশগত ছাড়পত্র নেই।
এর মধ্যে নারায়ণগঞ্জে চার শতাধিক ইটভাটা রয়েছে উল্লেখ করে পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিদর্শক মঈনুল হক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, এ ভাটাগুলোর মধ্যে অবৈধ ইটভাটা ৩০ শতাংশের বেশি।
তবে নারায়ণগঞ্জে কোনো ইটভাটায় কাঠ পোড়ানো হয় না দাবি করে তিনি বলেন, “কয়লা দিয়ে তারা ইট উৎপাদন করে।”
অবৈধ ইটভাটার বিরুদ্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার কথা তুলে জেলা প্রশাসক জসিম উদ্দিন বলেন, “উচ্চ আদালতের বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে অবৈধ ইটভাটাগুলোর বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর চেষ্টা করব।”
তবে সব ইটভাটাই দূষণ করছে দাবি করে পরিবেশবাদী সংগঠন নির্ভীকের সমন্বয়ক এটিএম কামাল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, যেসব ইটভাটা পরিবেশবান্ধব বলা হচ্ছে, সেগুলো আসলে কতটুকু পরিবেশবান্ধন সে বিষয়টি খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।
অবৈধ ইটভাটাগুলো জেলা প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমোদন ছাড়া কীভাবে চলে আসছিল সেটি খতিয়ে দেখারও প্রয়োজন মন করেন তিনি।
“আমাদের অসচেতনতা ও ক্ষতির বিষয়ে ধারণা না থাকার কারণে ইটভাটার মালিকরা মানুষের জীবন ঝুঁকিতে ফেলে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।”
সরেজমিনে দেখা গেছে, বুড়িগঙ্গা ও ধলেশ্বরী নদীর তীরে নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার বক্তাবলী ইউনিয়নসহ আশপাশের এলাকায় প্রায় শতাধিক ইটভাটা রয়েছে। লোকালয়, ফসলি জমি ও নদীর পাশে বিপুল সংখ্যক ইটভাটায় প্রতিদিন পোড়ানো হচ্ছে লাখ লাখ কাঁচা ইট। ভাটাগুলো থেকে নির্গত কালো ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ছে আশপাশে।
একই অবস্থায় রূপগঞ্জ উপজেলার ভোলাব ইউনিয়ন, দাউদপুর ইউনিয়ন, তারাব পৌরসভাসহ বেশকিছু এলাকায়। সেখানেও লোকালয়ে, ফসলি জমি ও পৌরসভা এলাকার ভেতরে ইটভাটাগুলোতে ইট উৎপাদন করে যাচ্ছে।
অন্যদিকে নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলার মুছাপুর ইউনিয়নে ফসলি জমি ও লোকালয়ে ৩০টির বেশি ইটভাটা রয়েছে। সেখানে বছরের পর বছর ইট উৎপাদন হচ্ছে বলে স্থানীয়দের ভাষ্য।
এছাড়া সোনারগা ও আড়াইহাজার উপজেলায়ও প্রচুর অবৈধ ইটভাটা দেখতে পাওয়া যায়।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, জেলার বক্তাবলী ইউনিয়নের চর রাজাপুর, চর নবীনগর, পশ্চিমপাড়ে গোপালনগর, রাজাপুর, লক্ষীনগর, মোক্তারকান্দি, ডিক্রিরচর, গোগনগর, আকবর নগরসহ এলাকায় ইটভাটার সংখ্যা বেশি। বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে ধর্মগঞ্জসহ আশপাশের এলাকায় ইটভাটা রয়েছে।
এছাড়া কেরানীগঞ্জের জাজিরা এলাকায় বুড়িগঙ্গা নদীর প্রচুর ইটভাটা রয়েছে। ধলেশ্বরী ও বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে প্রায় শতাধিক ইটভাটা রয়েছে। এর মধ্যে ৭০ শতাংশ ইটভাটা বৈধ। এছাড়া অনেকগুলো পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্রের জন্য আবেদন করেছে বলে জানিয়েছে ভাটা সংশ্লিষ্টরা।
বন্দর উপজেলার মুছাপুর ইউনিয়নের ফনকুল ও শাসনের বাগ, বৈরাগীর পাড়, মদনপুর ইউনিয়নসহ বেশ কিছু এলাকায় ইটভাটা রয়েছে।
রূপগঞ্জ উপজেলার ভোলাবো ও দাউদপুর ইউনিয়নসহ বিভিন্ন এলাকায় ইটভাটা রয়েছে। ভোলাবো ইউনিয়নের অধিকাংশ ইটভাটা অবৈধ। এ ইটভাটাগুলো পৌরসভা এলাকায় পড়েছে। এগুলো পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র ছাড়াই পরিচালনা করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
“ফসলের জমির উৎপাদন আগে থেকে কমে গেছে। জমির উর্বতরতা শক্তি কমে গেছে। ধোঁয়ার আস্তরে ঢেকে লাল হয়ে যায় বাড়িঘরসহ গাছপালার সবুজ রং।
বন্দর উপজেলার শাসনেরবাগ এলাকার বাসিন্দা ওমর ফারুক অভিযোগ করে বলেন, ফসলি জমির ওপর ইটভাটা। দিন দিন ইটভাটাগুলো গিলে খাচ্ছে ফসলি জমি কিন্তু প্রশাসনের দেখার কেউ নেই।
“উচ্চ আদালত নির্দেশনা দিয়েছে তাই এখন দেখার বিষয় কতটুকু জোরালো অভিযান পরিচালনা করা হয়।”
জেলা সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ ইমতিয়াজ বলেন, বাতাস দূষণের কারণে ফুসফুসের প্রদাহ, শ্বাসকষ্ট, এ্যাজমা হতে পারে। দীর্ঘ মেয়াদী দূষণে ক্যান্সারে মত জটিল রোগও হতে পারে।
অবৈধ ইটভাপটা নিয়ে প্রশ্ন করলে বক্তাবলী-এনায়েতনগর ইটভাটা মালিক সমিতির সভাপতি ও ফতুল্লা থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শওকত আলী জানান, বক্তাবলী ও এনায়েতনগর নগরে ৫৫ থেকে ৬০টি ইটভাটা রয়েছে।
“এর মধ্যে পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র আছে ৩০ থেকে ৩৫টি ইটভাটার।
উচ্চ আদালতের নিদের্শনার বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা উচ্চ আদালতের নির্দেশনার দিকে তাকিয়ে আছি।
অনেক ইটভাটা ‘জিগজ্যাগে’ রূপান্তর করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।
গত নভেম্বর থেকে পুরোদমে ইট পোড়ানো শুরু হয়েছে জানিয়ে ইটভাটার মালিকেরা বলছেন, এসব ভাটা চলবে আগামী মার্চ-এপ্রিল মাস পর্যন্ত। প্রতিটি ইটভাটা অন্তত ৫০ লাখ ইট উৎপাদনে সক্ষম।
এক ইটভাটা মালিক তার ভাটায় দিনে তিন টন কয়লা পোড়ার হিসেব টেনে নারায়ণগঞ্জের চার শতাধিক ভাটায় চার লাখ টনের বেশি কয়লা পড়ে বলে দাবি করেন।