বাঘাইছড়িতে নির্বাচনকর্মীদের উপর গুলিবর্ষণ, নিহত ৭

রাঙামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলায় পাহাড়িদের এক পক্ষের বর্জনের মধ্যে ভোটগ্রহণের পর নির্বাচনী দায়িত্ব পালনকারীদের উপর সশস্ত্র হামলায় নিহত হয়েছেন অন্তত সাতজন।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকও রাঙামাটি প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 18 March 2019, 01:30 PM
Updated : 18 March 2019, 06:02 PM

সোমবার দেশের বিভিন্ন স্থানের ১১৫টি উপজেলার সঙ্গে বাঘাইছড়ি উপজেলায়ও ভোটগ্রহণ হয়। তবে জেএসএস সমর্থিত প্রার্থীদের বর্জনের কারণে আগে থেকে বাঘাইছড়িতে চলছিল উত্তেজনা।

এর মধ্যেই ভোটগ্রহণ শেষে সন্ধ্যায় সাজেক ইউনিয়নের দুর্গম কংলাক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মাচালং সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও বাঘাইহাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্র থেকে ফেরার পথে নির্বাচনকর্মীদের উপর সশস্ত্র দুর্বৃত্তরা হামলা চালায় বলে পুলিশ ও প্রশাসনিক কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

বাঘাইছড়ি-দিঘিনালা সড়কের নয় মাইল এলাকায় নির্বাচন কর্মকর্তা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের বহনকারী চাঁদের গাড়িগুলোর উপর হামলা হয় বলে বাঘাইছড়ি থানার ওসি মঞ্জুরুল আলম জানান।

রাতে ইসির যুগ্ম-সচিব (জনসংযোগ) এস এম আসাদুজ্জামান এক বিজ্ঞপ্তিতে জানান, দ্বিতীয় ধাপে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে দায়িত্বরত অবস্থায় বাঘাইছড়ি উপজেলায় দুর্বৃত্তদের হামলায় ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা ও আনসার সদস্যসহ ৬ জন নিহত হয়েছেন। এছাড়া কয়েকজন আহত হয়েছেন।

তার কিছুক্ষণ পর রাত পৌনে ১১টার দিকে বাঘাইছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নাদিম সারওয়ার চট্টগ্রামের হাসপাতালে নেওয়ার পথে আরও একজনের মৃত্যুর খবর জানান। 

পুলিশ ও স্থানীয় কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, হামলায় সাতজন নিহত হওয়ার পাশাপাশি ১১ জন আহত হয়েছেন।

ইউএনও নাদিম সারওয়ার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, নিহতরা হলেন আমির হোসেন, আবু তৈয়ব, মন্টু চাকমা, মিহির কান্তি দত্ত, আল আমিন, বিলকিস আক্তার ও জাহানারা বেগম।

আহতদের স্থানীয় হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে হেলিকপ্টারে চট্টগ্রাম পাঠানো হয় বলে জানান তিনি।

চট্টগ্রামের আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা মো হাসানুজ্জামান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, নিহতদের মধ্যে শিক্ষক আমির ও আবু তৈয়ব পোলিং কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। মিহির দত্ত, আল আমিন, বিলকিস আক্তার ও জাহানারা বেগম আনসার ও ভিডিপি সদস্য। মন্টু চাকমার পরিচয় জানা যায়নি।

নিহত মন্টু চাকমা পথচারী বলে জানিয়েছেন বাঘাইছড়ির পুলিশ সদস্য।

প্রিজাইডিং কর্মকর্তা শিক্ষক আবদুল হান্নান আহত অন্যদের চট্টগ্রাম সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) ভর্তি করা হয়েছে।

এই হামলা কারা চালিয়েছে, তাৎক্ষণিকভাবে সে বিষয়ে কিছু বলতে পারেননি পুলিশ ও স্থানীয় কর্মকর্তারা।

তবে তারা বলেছেন, হামলাকারীদের ধরতে অভিযান শুরু হয়েছে।

পাহাড়ে বিবাদমান পক্ষগুলোর একটি জনসংহতি সমিতি (জেএসএস-এমএন লারমা) এই হামলার জন্য জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা) নেতৃত্বাধীন জনসংহতি সমিতিকে (জেএসএস) দায়ী করেছে। তবে এতে জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেছেন সন্তু লারমার দলের নেতারা।

কয়েক বছর আগে সন্তু লারমার দল থেকে আলাদা হওয়া জনসংহতি সমিতির (এমএন লারমা) নেতা সাবেক চেয়ারম্যান সুদর্শন চাকমা বাঘাইছড়িতে উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থী হয়েছিলেন এবারও।

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগসহ জাতীয় দলগুলোর কোনো প্রার্থী না থাকার মধ্যে সুদর্শনকে জেতাতে কারচুপির ষড়যন্ত্র হচ্ছে দাবি করে সকালে ভোট বর্জনের ঘোষণা দেন জেএসএস সমর্থিত চেয়ারম্যান প্রার্থী ও বিদায়ী চেয়ারম্যান বড়ঋষি চাকমা।

পাহাড়িদের সবচেয়ে বড় সংগঠন জেএসএসের ভোট বর্জনের মধ্যে দিনভর ভোটগ্রহণে শেষে ঘটে হামলার ঘটনা।

ইউএনও নাদিম সারোয়ার বলেন, কংলাক বিদ্যালয়, মাচালং বিদ্যালয় ও বাঘাইহাট বিদ্যালয় কেন্দ্রে ফল দেওয়ার পর ভোটের সরঞ্জাম নিয়ে ফেরার পথে নয় মাইল এলাকায় হামলা হয়।

পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, তিনটি কেন্দ্রের প্রিজাইডিং কর্মকর্তা, পোলিং কর্মকর্তা, পুলিশ এবং আনসার ও ভিডিপি সদস্যরা বিজিবি পাহারায় তিনটি চাঁদের গাড়িতে করে দীঘিনালা ফিরছিলেন। এসময় সংঘবদ্ধ দৃর্বৃত্তরা ‘ব্রাশফায়ার’ করলে দ্বিতীয় গাড়িটি আক্রান্ত হয়। এসময় চালক গাড়ি না থামিয়ে দ্রুতগতিতে গাড়িটি চালিয়ে বাঘাইছড়ি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যান। সেখানে গাড়ি থেকে নামানোর পর একে একে মারা যান ছয়জন।

এই হামলার নিন্দা জানিয়ে ইসি বলেছে, ইতোমধ্যে নির্বাচন কমিশন আহতদের চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়েছে। নির্বাচন কমিশন যে কোনো পরিস্থিতিতে নিহতদের পরিবারের এবং আহতদের পাশে আছে ও থাকবে।

নির্বাচনে অংশ নেওয়া জেএসএস (এমএন লারমা) প্রার্থী ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান সুদর্শন চাকমা হামলার জন্য সন্তু লারমার জেএসএসকে দায়ী করেছেন।

তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “সন্তু লারমার জেএসএস’র এর বড়ঋষি চাকমা নিশ্চিত পরাজয় জেনে সকালে নির্বাচন বর্জন নাটক করার পর সন্ধ্যায় সরকারি কাজে নিয়োজিতদের উপর এই নৃশংস হামলা চালিয়েছে।”

এই হামলার সঙ্গে পাহাড়িদের আরেকটি সংগঠন ইউপিডিএফের সম্পৃক্ততার অভিযোগও তুলেছেন জেএসএস-এমএন লারমার কেন্দ্রীয় ছাত্র বিষয়ক সম্পাদক সুদর্শন; যদিও নতুন দল গঠনের পর ইউপিডিএফের সঙ্গেই সুসম্পর্ক ছিল জেএসএস-এমএন লারমার।

সুদর্শনের অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে সন্তু লারমার দল জেএসএসের বাঘাইছড়ি উপজেলা কমিটির সহ সাধারণ সম্পাদক ত্রিদিব চাকমা সাংবাদিকদের বলেন, “এই ঘটনার সাথে আমাদের দূরতম সম্পর্কও নেই। ওই এলাকায় আমাদের কোনো সাংগঠনিক কার্যক্রম বা অবস্থানও নেই। ওটা পুরোটাই ইউপিডিএফ নিয়ন্ত্রিত এলাকা।

“আর আমরা যেহেতু সকালেই নির্বাচন বর্জন করেছি এবং লিখিতভাবে আমাদের অভিযোগ নির্বাচন কমিশনকে জানিয়েছি, আমরা কেন এমন কাজ করব? আমরা গনতান্ত্রিক রাজনীতিতে বিশ্বাসী,গণতান্ত্রিক আন্দোলনেই আমাদের আস্থা।”

প্রসিত বিকাশ খিসা নেতৃত্বাধীন ইউপিডিএফের মুখপাত্র মাইকেল চাকমাও এই হামলার সঙ্গে জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করে বলেছেন, “এটা সুস্থ মস্তিষ্কের কারও কাজ নয়। এই নির্বাচনে আমাদের কোনো প্রার্থীও ছিল না। আমরা কেন এই কাজ করতে যাব?”

এম এন লারমার (প্রয়াত) গড়া পাহাড়িদের সংগঠন জনসংহতি সমিতি দুই দশক আগে ভেঙে গঠিত হয়েছিল ইউপিডিএফ। তারপর দুই দলের সংঘাত লেগেই ছিল। তার মধ্যে কয়েক বছর আগে সন্তু লারমার নেতৃত্ব চ্যালেঞ্জ করে গঠিত হয় জেএসএস-এমএন লারমা। তাদের সঙ্গে শুরুতে সুসম্পর্ক ছিল ইউপিডিএফের।

এবার উপজেলা ভোটের প্রচার চলার মধ্যে গত ৩ মার্চ বঙ্গলতলিতে হামলায় নিহত হন জনসংহতি সমিতির গুরুত্বপূর্ণ নেতা উদয় জয় চাকমা চিক্কোধন।

বড় ঋষি চাকমার সঙ্গে ভোট বর্জনের ঘোষণা দিয়েছিলেন ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থী সুমিতা চাকমা,সমীরণ চাকমা ও অমরশান্তি চাকমা।

তারা ভোট বন্ধ রাখার দাবি জানিয়ে বলেছিলেন, ‘ভোট ডাকাতি’র নির্বাচন বাতিল করা না হলে বাঘাইছড়ি উপজেলায় যে কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির জন্য নির্বাচন কমিশন ও সরকারই দায়ী থাকবে।