প্রতিবারের মতো এবারও নববর্ষে দুপারের বাঙালিরা মিশেছে আপনজনদের সঙ্গে। তবে মাঝখানে ছিল রাজনৈতিক সীমানার কাঁটাতার।
Published : 14 Apr 2017, 05:38 PM
পঞ্চগড় সদরের অমরখানা সীমান্তে বাংলাদেশ ও ভারতের বাংলাভাষী মানুষ কাঁটাতারের দুপাশে থেকে স্বজনদের সঙ্গে সাক্ষাৎ ও কুশল বিনিময় করেছেন।
বাংলা নববর্ষে শুক্রবার সকাল থেকে এই সীমান্ত এলাকা তাদের পদভারে মুখর হয়ে ওঠে।
অমরখানা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মো. নুরুজ্জামান জানান, প্রায় প্রতিবছর বাংলা নববর্ষে বিজিবি ও বিএসএফের সম্মতিতে উভয় দেশের বাঙালিরা এখানে দেখা করার সুযোগ পান। তবে কাঁটাতারের বেড়ার এপার আর ওপার থেকে।
কিছু সময়ের জন্য হলেও তারা একে অপরের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ করার সুযোগ পান। আর এই দুই চার ঘণ্টায় একে অপরে আবেগ আর ভালোবাসা কীভাবে ভাগ করেন সেটা না দেখলে বলে বোঝানো যাবে না, বলেন নুরুজ্জামান।
পঞ্চগড় ১৮ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আল হাকিম মো. নওশাদ জানান, দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সম্মতিতে সকাল ১০টা থেকে বিকাল প্রায় ৪টা পর্যন্ত মানুষ কাঁটাতারের বেড়ার পাশে থেকে কুশল বিনিময়ের সুযোগ পান। পর্যাপ্ত নিরাপত্তায় নির্বিঘ্নে হাজারো মানুষ নববর্ষের দিনটিতে তাদের আনন্দ ভাগাভাগি করে।
“মাঝখানে কাঁটাতারের বেড়া থাকলেও মানুষগুলোর মনের মধ্যে যেন কোনো বেড়া ছিল না। সবাই যেন একে অপরের সঙ্গে একাকার হয়ে যান,” বলেন তিনি।
সরেজমিনে দেখা গেছে, সীমান্তের ৭৪৩ নম্বর থেকে ৭৪৫ নম্বর মেইন পিলার (১ থেকে ৭ নম্বর সাব পিলার) পর্যন্ত প্রায় পাঁচ কিলোমিটার বিস্তৃত এলাকা দুই দেশের হাজারো মানুষের পদভারে মুখর। কাঁটাতারের এপার-ওপার অবাল-বৃদ্ধ-বণিতায় লোকারণ্য। কাঙ্ক্ষিত স্বজনকে খুঁজে পেতে এক একজনের ছোটাছুটি। খুঁজে পেয়ে হইহুল্লোর। আনন্দাশ্রুতে ভেসে যাওয়া। তারপর আবেগ-আনন্দের কুশল বিনিময়। উপহার বিনিময়। আশীর্বাদ, স্নেহ-শ্রদ্ধা বিনিময়। শেষে আবার দেখা হওয়ার আকুতি। সব মিলিয়ে এক অপূর্ব দৃশ্য।
সকাল থেকে বাংলাদেশের পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, নীলফামারী এবং ভারতের জলপাইগুড়ি, শিলিগুড়ি, কলকাতাসহ বিভিন্ন এলাকার বিভিন্ন বয়সী নারী-পুরুষ অপেক্ষার প্রহর গুণতে থাকেন কখন সময় হবে। কখন স্বজনদের দেখা পাবেন। সাইকেল, ভ্যান, অটোরিকশা, মাইক্রেবাস, মিনিবাসসহ নানাভাবে এসে ওই এলাকায় জড়ো হন তারা।
বিজিবি ও বিএসএফের সবুজ সঙ্কেতে সকাল ১০টায় অপেক্ষার অবসান ঘটে।
পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি শহরের অমৃত পাল (৪৫) জানান, বাংলাদেশে থাকা বড় ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হয়েছে। সঙ্গে ছিল তার নাতি, ছেলে ও ছেলের বউ।
তিনি বলেন, “সামান্য দূরত্ব হলেও টাকার অভাবে পাসপোর্ট ভিসা করে আমার যেমন যাওয়া হয় না, তাদেরও আসা হয় না। বছরে এই দিনটির অপেক্ষায় থাকি আমরা।
কোলে দেড় বছরের মেয়েকে নিয়ে আসা অনীতা বালা (২৫) বলেন, “আমাদের বাড়ি ছিল বাংলাদেশের ছিটমহল এলাকায়। বিয়ে যখন হয় তখন আমরা দুই দেশেই যাতায়াত করতে পারতাম। কিন্তু ছিটমহল বিনিময়ের পর আমাদের হাত-পা বাঁধা পড়েছে। তাই এখানে এসে বাংলাদেশে বসবাসকারী মা-বাবার সঙ্গে দেখা করেছি। তারা তাদের নাতনিকে আশীর্বাদ করেছেন। শেষ সময়ে ওরা যেতেই চায় না।
স্থানীয়রা জানান, ১৯৪৭ সালে পাক-ভারত বিভক্তির আগে পঞ্চগড়সহ চারটি উপজেলা ভারতের জলপাইগুড়ি জেলার থানা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত ছিল। বিভক্তির পর সীমান্তবর্তী এ এলাকার অনেকের আত্মীয় স্বজন দুই দেশে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। সত্তরের দশকেও উভয় দেশের লোকজন প্রায় বিনা বাধায় যাতায়াত করতে পারলেও ৮০’র দশকে তা থেমে যায়। কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ করায় যাতায়াত একেবারে বন্ধ হয়ে যায়।