গাইবান্ধার নিহত সাংসদ মঞ্জুরুল ইসলাম লিটনের স্বজনরা এখন নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
Published : 03 Jan 2017, 10:03 PM
সরকারি দলের অনেক নেতার মতো নিহত সাংসদের স্ত্রীও এ ঘটনার পেছনে জামায়াতে ইসলামী থাকতে পারে বলে মনে করছেন।
শনিবর সন্ধ্যায় সুন্দরগেঞ্জের সর্বানন্দ ইউনিয়নের শাহাবাজ গ্রামে নিজ বাড়িতে গাইবান্ধা-১ (সুন্দরগঞ্জ) আসনের সংসদ সদস্য লিটনকে গুলি চালিয়ে পালিয়ে যায় মোটরসাইকেলে আসা হামলাকারীরা। রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পর তার মৃত্যু হয়।
ঘটনার তিন দিনেও হত্যাকারীদের গ্রেপ্তার কিংবা সনাক্ত করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তদন্তে নেমেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একাধিক দল।
মঙ্গলবার সকালে পুলিশের রংপুর রেঞ্জের উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) খন্দকার গোলাম ফারুক এবং গাইবান্ধা পুলিশ সুপার আশরাফুল ইসলাম সুন্দরগঞ্জ থানায় পুলিশের পদস্থ কর্মকর্তাদের নিয়ে সভা করেছেন।
স্বজনদের আহাজারি থামেনি। এরই মধ্যে নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছেন মামলার বাদী ও স্ত্রীসহ অন্যান্য ঘনিষ্ঠজনরা।
লিটনের বোন মামলার বাদী ফাহমিদা বুলবুল কাকলী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা শুধু আমার ভাই হত্যার বিচার চাই। হত্যাকারী যেই হোক তাকে গ্রেপ্তার করে শাস্তির আওতায় আনা হোক। একজন এমপিকে যদি এভাবে বাড়িতে এসে হত্যা করা হয় তাহলে আমাদের জীবনের নিরাপত্তা কোথায়।”
লিটনের স্ত্রী খুরশিদ জাহান স্মৃতির বড় বোন আফরোজা বারী বলেন, “একটি বিশেষ মহল থেকে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। সে কারণে আমার যে কোনো সময় বিপদে পড়তে পারি এমন আশঙ্কা করছি।”
লিটনের বড় বোন তৌহিদা বুলবুল বলেন, “আমাদের নিরাপত্তা নিয়েই এখন সমস্যা। আমাদের কথা বলাও সমস্যা। তাই কোনো কথা বলতে পারছি না।”
লিটনের স্ত্রী স্মৃতি সাংবাদিকদের বলেন, তার স্বামীকে হত্যার পেছনে স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াত-শিবিরের হাত থাকতে পারে।
তিনি জানান, ১৯৯৮ সালের ২৬ জুন সুন্দরগঞ্জ ডি ডব্লিউ ডিগ্রি কলেজ মাঠে জামায়াত-শিবির আয়োজিত জনসভায় গোলাম আযমের বক্তব্য দেওয়ার কথা ছিল।
“সেসময় স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের ওই সভা পণ্ড করতে লিটন বন্দুক হাতে কর্মী-সমর্থকদের নিয়ে ওই জনসভায় প্রবেশ করে গোলাম আযমকে লক্ষ্য করে কয়েক রাউন্ড গুলি ছোড়েন। এতে জনসভাটি পণ্ড হয়ে যায়।”
সেই থেকে জামায়াত-শিবির লিটনকে যে কোনো মূল্যে হত্যার লক্ষ্য ঠিক করে বলে মনে করেন স্মৃতি।
তিনি বলেন, “সেসময় তার গুলিতে আহত জামায়াতের ফতেখাঁ গ্রামের ক্যাডার হেফজসহ আরও দুর্ধর্ষ জামায়াত ক্যাডাররা লিটনকে মোবাইলে মেসেজ পাঠিয়ে এবং মোবাইল করে দীর্ঘদিন থেকে হত্যার হুমকি দিয়ে আসছিল।লিটনকে গুলি করে হত্যা তারই জের।”
বাড়িতে দোয়া অনুষ্ঠানের পর তারা ঢাকা চলে যাবেন বলে সাংবাদিকদের জানান স্মৃতি।
লিটনের বাড়িতে মঙ্গলবার সকাল থেকে কোরআন তেলওয়াত করে স্থানীয় ৫ মাদ্রাসার প্রায় দুই শতাধিক এতিম শিশু। দুপুরে কবরের পাশে আত্মার মাগফেরাত কামনা করে দোয়া করা হয়। এতে লিটনের আত্মীয়-স্বজন, শুভাকাঙ্ক্ষী, বিভিন্ন মসজিদের ইমাম-মুয়জ্জিনসহ এলাকাবাসীরা অংশ নেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা জানান, বর্তমানে বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে পুলিশ লিটন হত্যার নানা বিষয় নিয়ে তদন্তে মাঠে নেমেছে। তদন্তে পাঁচটি বিষয় গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে। পারিবারিক, স্থানীয় আওয়ামী লীগ দলীয় রাজনীতির বিভেদ, ব্যবসাগত অর্থনৈতিক লেনদেন, জামায়াত শিবির ও জঙ্গি সংশ্লিষ্টতা।
শিগগিরই ঘটনায় জড়িতদের পুলিশ শনাক্ত করতে সক্ষম হবে বলে ওই কর্মকর্তারা মনে করেন।
মঙ্গলবার পুলিশ সুপার আশরাফুল ইসলামের নেতৃত্বে একটি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দল সুন্দরগঞ্জের সোনারায় ইউনিয়নের ফতেহখাঁ গ্রামে এমপি লিটনের শ্বশুর বাড়িতেও যায়। সেখানে তারা আত্মীয় স্বজনদের জিজ্ঞাসাবাদ করেন।
সুন্দরগঞ্জ থানার ওসি আতিয়ার রহমান জানান, এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত সন্দেহে মঙ্গলবার আরও তিন জনসহ এ পর্যন্ত ৩৫ জনকে আটক করা হয়েছে। প্রথম দফায় আটক ১৮ জনের মধ্যে ১৫ জনকে লিটন হত্যা মামলার এজাহারভুক্ত আসামি হিসেবে আদালতে পাঠানো হয়েছে। বাকি তিন জনকে অন্য মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়।
এদের মধ্যে মাহতাব হোসেন, আইয়ূব আলী, মহসিন আলী, সিরাজুল ইসলাম, রাতুল ইসলাম, লাল মিয়া, আলম মিয়া, ভুট্টু মিয়া, আমজাদ হোসেন, রুবেল মিয়া, আজিজুর রহমান, গোলাম মোস্তফা, হাফিজ উদ্দিন, মোজাম্মেল হক ও ছানু মিয়াকে আদালতে পাঠানো হয়েছে।
শোকাহত পরিবারের পাশে কাদের সিদ্দিকী
মঙ্গলবার সকালে লিটনের কবর জিয়ারত করেছেন কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি কাদের সিদ্দিকী। এরপর তিনি লিটনের বাসভবনে গিয়ে তার শোকাহত পারিবারে খোঁজখবর নেন এবং পরিবারের সদস্যদের সমবেদনা জানান।
কাদের সিদ্দিকী সাংবাদিকদের বলেন, “নিজের ঘরে যদি একজন সংসদ সদস্য নিহত হন সেখানে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা কোথায়। এ হত্যার ঘটনা অত্যন্ত ভয়াবহ। সাধারণ মানুষের কোনো নিরপত্তা নেই। আগামীকাল কী হবে তা আমরা কেউ বলতে পারছি না।”
এ ঘটনায় জড়িত প্রকৃত অপরাধীকে গ্রেপ্তার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান তিনি।
গাইবান্ধায় বিক্ষোভ সমাবেশ
লিটন হত্যার প্রতিবাদের গাইবান্ধা শহর মঙ্গলবার স্থানীয় শহীদ মিনার চত্বরে বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে আওয়ামী লীগ।
শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি পৌর মেয়র শাহ মাসুদ জাহাঙ্গীর কবির মিলনের সভাপতিত্বে বক্তব্য রাখেন জাতীয় সংসদের হুইপ মাহাবুব আরা বেগম গিনি, জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি সৈয়দ-শামস-উল-আলম হিরু, সাধারণ সম্পাদক আবু বকর সিদ্দিক প্রমুখ।
এছাড়া সুন্দরগঞ্জ আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছেন মঙ্গলবার। করে। পরে সুন্দরগঞ্জ উপজেলা শহরের বঙ্গবন্ধু ম্যুরাল চত্বরে এক প্রতিবাদ অনুষ্ঠিত হয়।
হত্যার ঘটনায় সুন্দরগঞ্জ ডি ডব্লিউ ডিগ্রি কলেজে মঙ্গলবার এক শোক সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
শোক সভায় অধ্যক্ষ এ কে এ এম হাবিব সরকারের সভাপতিত্বে বক্তব্য রাখেন কলেজের গভর্নিং বডির সদস্য নাসরিন সুলতানা, লুৎফর রহমান, মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল ইসলাম প্রমুখ।
শোক সভায় নিহত এমপির আত্মার মাগফেরাত কামনায় এক মিনিট নীরবতা পালন করে মোনাজাত ও দোয়া করা হয়।