নারায়ণগঞ্জ শহরের পাঁচ খুনে স্বজনদের পাশাপাশি পুলিশও সন্দেহ করছে আলোচিত ওই ঘটনায় স্ত্রী, দুই সন্তান ও ভাইবৌ হারানো শফিকুল ইসলামের ভাগ্নে মাহফুজকে।
Published : 17 Jan 2016, 10:51 PM
আগের দিন গলা কেটে খুনের কথা পুলিশ বললেও ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক বলেছেন, এক বাড়িতে পাঁচজনকেই শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়েছে।
হত্যার ধরন দেখে সিআইডি কর্মকর্তারা বলেছেন, খুনিরা অপেশাদার এবং নিহতদের পূর্ব পরিচিত বলে মনে করছেন তারা।
শনিবার রাতে শহরের ২ নম্বর বাবুরাইল এলাকার প্রবাসী ইসমাইলের পাঁচতলা বাড়ির একতলার পূর্ব পাশের ফ্ল্যাটে ওই পাঁচজনের লাশ পাওয়া যায়।
নিহতরা হলেন- তাসলিমা বেগম (৪০), তার ছেলে শান্ত (১০), মেয়ে সুমাইয়া (৫), ভাই মোরশেদুল (২৫) ও তাসলিমার জা লামিয়া (২৫)।
তাসলিমার স্বামী শফিকুল ইসলাম ঢাকায় একটি প্রাইভেট কোম্পানির গাড়ির চালক। তার ছোট ভাই নিহত লামিয়ার স্বামী শরীফ মিয়া ঢাকার মোতালেব প্লাজায় মোবাইল ফোন সার্ভিসিংয়ের কাজ করেন।
পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন, মাহফুজ তার ছোট মামীকে অশালীন প্রস্তাব দিতেন। এ নিয়ে পারিবারিক সালিশও হয়।
বিষয়টি শফিকুল রোববার সকালে নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানায় দায়ের করা হত্যা মামলায়ও উল্লেখ করেছেন।
তাসলিমার খালা রমিজা খাতুন সাংবাদিকদের বলেন, “লামিয়াকে কুপ্রস্তাব দেওয়ায় ১৫ দিন আগে মাহফুজকে জুতাপেটা করা হয়। এরপর পারিবারিক সালিশেও তাকে বকাঝকা করা হয়।”
নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানা ওসি আব্দুল মালেক সাংবাদিকদের বলেন, জিজ্ঞাসাবাদের জন্য মাহফুজ ও মোরশেদের খালাত ভাই শাহজাদাকে আটক করা হয়েছে। এছাড়া আটজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে।
তাসলিমার কাছে পাওনা টাকা নিয়ে দেওয়া হুমকির বিষয়টিও গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে পুলিশ।
নিহত মোরশেদের সঙ্গে ঢাকার একটি পক্ষের সঙ্গে সুদের টাকা নিয়ে বিবাদের জেরে এই হত্যাকাণ্ড ঘটে থাকতে পারে তার মা মুর্শেদা বেগম ও খালাত বোনের স্বামী মোহাম্মদ মিলন আগে বলেছিলেন।
নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার খন্দকার মহিদ উদ্দিন সাংবাদিকদের বলেন, “হত্যাকাণ্ডের পেছনে ব্যক্তিগত সম্পর্ক বা দেনা-পাওনার বিষয় থাকতে পারে। ধরন দেখে মনে হচ্ছে, খুনিরা নিহতদের পূর্বপরিচিত। আমরা আশা করছি, আগামী ৭২ ঘণ্টার মধ্যে রহস্য উদঘাটন করতে পারব।”
মামলায় আসামি অজ্ঞাত
স্ত্রী-সন্তানসহ স্বজনদের হত্যার ঘটনায় শফিকুল যে মামলা করেছেন, তাতে আসামির তালিকায় কারও নাম উল্লেখ করা হয়নি। তবে বলা হয়েছে সন্দেহের কথা।
এজাহারে শফিকুল ছোটভাই শরীফের স্ত্রী লামিয়ার কাছে ভাগ্নে ‘যৌন আবেদন’ করার বিষয়টি উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, লামিয়া বিষয়টি তার স্বামী শরীফ ও জা তাসলিমাকে জানিয়েছিলেন।
এছাড়া শফিকুল বলেছেন, তার স্ত্রী তাসলিমার কাছে ঢাকার কলাবাগান এলাকার নাজমা, শাহজাহানসহ কয়েকজন প্রায় ১২ লাখ টাকা পেত, যা মাসিক চক্র বৃদ্ধি হারে সুদে নেওয়া। পাওনা টাকার জন্য তারা প্রায়ই নারায়ণগঞ্জের বাসায় এসে হুমকি দিত। তাসলিমার ভাই মোশারফ হোসেন ওরফে মোরশেদের কাছেও ব্যবসায়িক কারণে অনেকে টাকা পেত।
তাসলিমা যে বাড়িতে ভাড়া থাকেন তার কাছের এক বাড়ির কক্ষ ভাড়া নিয়ে তার ভাই মোরশেদুল দর্জি কারখানা চালাতেন।
শফিকুল এজাহারে বলেছেন, “আমার সন্দেহ উক্ত ব্যক্তিগণসহ অজ্ঞাতনামা দুষ্কৃতকারীরা পরস্পরের যোগসাজশে গত ১৫ জানুয়ারি রাত সাড়ে ১০টার পর থেকে ১৬ জানুয়ারি রাত ৮টা ২০ মিনিটের মধ্যে ভোতা অস্ত্র দিয়ে গুরুতর জখম কর গলায় ফাঁস লাগিয়ে পাঁচজনকে হত্যা করেছে।”
হত্যাকাণ্ডের পর থেকে তাসলিমা ও মোরশেদের মোবাইল ফোন পাওয়া যাচ্ছে না বলে জানান শফিকুল।
পুলিশ মামলাটি গ্রহণ করে প্রাথমিক তথ্য বিবরণীতে আসামির ঘরে অজ্ঞাতনামা আসামিরা উল্লেখ করেছে।
দণ্ডবিধির ৩০২/৩৪ ধারায় (পরিকল্পিতভাবে পরস্পরের যোগসাজশে খুন করার অপরাধ) দায়ের মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে সদর মডেল থানার এসআই হামিদুল ইসলামকে।
এদিকে রোববার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে র্যাব প্রধান বেনজীর আহমেদ বলেছেন, তারা এই হত্যাকাণ্ডের ছায়াতদন্ত করছে।
হত্যা শ্বাসরোধে
রোববার বিকালে পাঁচজনের লাশের ময়নাতদন্ত হয় নারায়ণগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে, তা করেন হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) মো. আসাদুজ্জামান।
তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “প্রত্যেককে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়েছে। মাথায় ভারী বস্তুর আঘাতের চিহ্নও রয়েছে।”
নিহত নারীদের ধর্ষণের কোনো আলামত পাওয়া যায়নি বলে এই চিকিৎসক জানান, যে সন্দেহের কথা আগের দিন পুলিশ জানিয়েছিল।
নিহতদের খাবারে বিষ কিংবা চেতনানাশক কিছু মেশানো হয়েছিল কি না, তাও খতিয়ে দেখার কথা বলেছিলেন নারায়ণগঞ্জের সহকারী পুলিশ সুপার ফোরকান আহমেদ।
তিনি বলেন, “ঘটনাস্থলে ধ্স্তাধস্তির কোনো আলামত নেই, প্রতিবেশীরাও কোনো চেঁচামেচি শোনেনি। সম্ভবত খাবারে চেতনানাশক কিছু মিশিয়ে সবাইকে অচেতন করে হত্যা করা হয়েছে।”
ডা. আসাদুজ্জামান বলেন, খাবারে বিষক্রিয়ার বিষয়টি তদন্তের জন্য ভিসেরা পরীক্ষার জন্য নমুনা পরীক্ষাগারে পাঠানো হয়েছে।
নারায়ণগঞ্জ সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার এহসান উদ্দিন চৌধুরী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “খুনিরা পেশাদার নয়। ধারালো অস্ত্র দিয়ে মাথায় আঘাতের পর তাদেরকে গলায় কাপড় পেঁচিয়ে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়েছে।”
এই হত্যায় তিনজনের বেশি লোক অংশ নিয়ে থাকতে পারে বলে ধারণা করছেন নারায়ণগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) মো. মহিবুল ইসলাম খান।
লাশ হস্তান্তর
ময়নাতদন্ত শেষে সন্ধ্যায় হাসপাতাল থেকে লাশগুলো স্বজনদের কাছে দেওয়া হয়।
লামিয়ার লাশ তার স্বামী শরিফ নিয়ে যান। তার স্ত্রীর দাফন হবে ময়মনসিংহে।
তাসলিমা, তার ছেলে শান্ত, মেয়ে সুমায়াইয়া ও ভাই মোরশেদের লাশ গ্রহণ করেন শফিকুল। তাদের লাশ নারায়ণগঞ্জের পাইকপাড়া কবরস্থানে দাফন করা হয়।