সিলেটের গোয়াইনঘাটের রাধানগর গ্রামের এ ঘটনায় আহত অপর এক কিশোরকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
Published : 25 Dec 2024, 11:41 PM
প্রতিদিনের মত জাফলংয়ে বালুর কাজে গিয়েছিলেন হেলাল মিয়া। কাজ না পেয়ে ফেরার পথে তাকে গরু চোর সন্দেহে সারাদিন পিটিয়ে বালু-চুন মিশ্রিত এসিড পানি জোর করে খাওয়ানো হয়। আর তাতেই তার মৃত্যু হয় বলে অভিযোগ করেছেন পরিবারের সদস্যরা।
গোয়াইনঘাট থানার পুলিশ জানিয়েছে, বুধবার সকালে উপজেলার ডৌবাড়ী ইউনিয়নের ঘোষগ্রামের মৃত শফিকুর রহমানের ছেলে হেলাল মিয়া (৩৫) মারা যান। তার আগে তিনি ঘন ঘন বমি করেন, নাক দিয়ে সাদা শ্লেষার মত যায় এবং পায়খানার সঙ্গে রক্ত যায়।
মঙ্গলবার গোয়াইনঘাট উপজেলার রাধানগর গ্রামের এ ঘটনায় গুরুতর আহত অপর এক কিশোরকে সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তার অবস্থাও আশঙ্কাজনক।
বুধবার সন্ধ্যায় হেলাল মিয়ার মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য হাসপাতালের মর্গে পাঠায় পুলিশ।
রাতে হেলাল মিয়ার ছোট ভাই আলিম উদ্দিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তিনি ভাইয়ের মরদেহ মর্গে রেখে গ্রামে ফিরেছেন। আগামীকাল বৃহস্পতিবার মরদেহের ময়নাতদন্ত হবে।
হেলাল স্ত্রী, তিন ছেলে ও এক মেয়ে রেখে গেছেন। পরিবারটি হেলালের উপার্জনের ওপর নির্ভরশীল ছিল। হেলাল জাফলংয়ে বালুশ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন।
গোয়াইনঘাট থানার ওসি সরকার তোফায়েল আহমেদ রাতে বলেন, “এ ঘটনায় জড়িতদের গ্রেপ্তারে পুলিশ ও ডিবি অভিযান চালাচ্ছে।”
এ ঘটনার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়েছে। চার মিনিট সাত সেকেন্ডের ওই ভিডিওতে দেখা যায়, গ্রামের একটি মাঠের মধ্যে এক যুবক ও কিশোরকে ঘিরে মানুষের জটলা। তাদের মধ্যে কেউ কেউ মোবাইলে ভিডিও করছিলেন। হেলালকে চিৎ করে মাটিতে ফেলে তার পিঠের উপর উঠেন লুঙ্গি ও সাদা গেঞ্জি পরা এক যুবক। তখন হেলাল হাত পিছমোড়া করে বাঁধা ছিল।
এরপর ওই ব্যক্তি হেলালের পা দুটি উপর দিকে তুলে ধরেন; তখন তার পায়ের পাতায় লাঠি দিয়ে আরেকজন বেধড়ক পেটাতে থাকে। এ সময় হেলাল চিৎকার করছিলেন। একটু পরে ওই ব্যক্তি হেলালের মুখ মাটিতে রেখে তার ঘাড়ের উপর বসেন। তারপর আরেকজন তার পায়ের পাতা ও শরীরের বিভিন্ন স্থানে বাঁশ দিয়ে পেটাতে থাকেন।
পাশেই পিছমোড়া করে বেঁধে রাখা হয়েছিল আরেক কিশোরকে। সে হাঁটতে পারছিল না। পরে ওই কিশোরকে দিয়েও হেলালকে পেটানো হয়। জড়ো হওয়া লোকজন গরু চুরি নিয়ে কথা বলছিলেন। সেখানে একটা লাল গরুও ছিল।
ওই ভিডিও দেখে হেলালের পরিবার ও স্থানীয়রা জানিয়েছেন, নির্যাতনের সময় সেখানে ইসলামপুর গাংপার গ্রামের মোশাররফ হোসেন, আমির উদ্দিন, সালামসহ তাদের সহযোগিরা ছিলেন। তারাই হেলালকে ধরে নিয়ে যান।
হেলালের ছোট ভাই আলিম উদ্দিন বলেন, “মঙ্গলবার বাড়ি থেকে বালুর কাজে যায় ভাই। কিন্তু গিয়ে কোনো কাজ না পেয়ে ফিরে আসছিলেন। তার সঙ্গে তখন আরেকজন (১৭ বছরের কিশোর, যার বাড়ি উপজেলার চারগ্রামের চাতল হাওরে) ছিল। জাফলং চা বাগান এলাকায় রাধানগর গ্রামের মানুষ তাদের ধরে মারছে। আমরা বেলা সাড়ে ৩টার সময় খবর পাই তাদের বেঁধে রাখছে। গ্রামবাসী মোবাইলে জানিয়েছেন, গরু নিয়ে যেতে। আমার ভাই সবসময় বালুর কাজে যায়।”
এ সময় পাশে থাকা হেলালের চাচা মো. মাহমুদ আলী বলেন, “আমার ভাতিজা প্রতিদিন বালুর কাজে যায়। মঙ্গলবার সকালেও বের হয়েছিল বালুর কাজে। কাজে যাওয়ার সময় প্রথমে হেলাল আর কিশোর একসঙ্গে ছিল, পরে গ্রামের আরও একজন গিয়ে তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়। কাজ না পেয়ে ফিরে আসার সময় বাগানে তাদের ধাওয়া দিয়ে ধরে পিটানো হয়।
“পরে দুটি গরু নিয়ে আসা হয়, গরু দুটি রাখা হয় তাদের পাশে। এ ঘটনার খবর পেয়ে পুলিশ গিয়ে বলছে, গরুসহ ধরেছেন যখন তখন বাদী হয়ে মামলা করেন। তারা কেউ বাদী হয়নি। পুলিশ ফিরে যায়। আমার ভাতিজাকে বলেছে, বালুর কাজে যখন এসেছিস তখন বালু খা, এই বলে চুন-বালু পানি খাওয়ানো হয়েছে।’’
মাহমুদ আলী বলেন, “আমাদের গ্রামের মেম্বারকে জানানো হয় (চুরি করা) গরু নিয়ে যেতে। তখন আবার আমরা রাতে ফোন দিয়ে বলেছি, আমাদের হেলাল বালুর কাজে গিয়েছে। সে গরু চুরি করেছে কি-না আমরা জানি না। আপনারা যখন এই কথা বলেছেন, তাহলে আমরা মনে করছি, আপনাদের এলাকায় গেছে যখন, আপনারা ধরে মারছেন, ঠিক আছে।
“পরে রাতে কিশোরের মা গিয়ে তাকে নিয়ে আসতে চাইলে ওই গ্রামের মানুষজন বলে, দুইজনকে নিতে হবে। তারপর কিশোরের মা দুজনকে নিয়ে আসেন। এটা আমরা জানি না।”
তিনি বলেন, “সকালে আমরা ঘুম থেকে উঠার পর কিশোরের বাড়ি থেকে আমাদের হেলালকে নিয়ে আসার পথে সে মারা যায়।”
ডৌবাড়ী ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য নিজাম উদ্দিন বলেন, “মঙ্গলবার আমাদের গ্রামের যারা বালুর কাজে গিয়েছিলেন তারা জানিয়েছেন, হেলাল ও ওই কিশোর তাদের সঙ্গে কাজে গিয়েছিল। এর আগে হেলাল চুরি করেছে বলে কোনো রেকর্ড নেই। আমাকে কল দেওয়ার আগেই তাদের মারধর করা হয়। চুন-বালু ও এসিড মোশানো পানি খাওয়ানো হয়।’’
বিকালে এই ইউপি সদস্য জানিয়েছিলেন, সকালের দিকে পুলিশের এক এসআই তাকে ফোন দিয়ে বিষয়টি জানান। পরে রাধানগর গ্রামের সাবেক মেম্বার বাবুলও তাকে ফোন দিয়ে ঘটনাস্থলে যেতে বলেন।
এর মাঝে তিনি খবর পান হেলালকে মারধর করে চুন, বালু ও গাড়ির ব্যাটারির এসিড পানির সঙ্গে মিশিয়ে খাওয়ানো হয়েছে। এসব জানার পর তিনি আর ঘটনাস্থলে যাননি। তাদের বলেন, মানুষই যখন মেরে ফেলেছে, এখন গিয়ে আর কী হবে?
গোয়াইনঘাট থানার ওসি সরকার তোফায়েল আহমেদ বলেন, “গরু চোর সন্দেহে আটকের পর হেলালকে জনতা মারধর করে। এক পর্যায়ে আধা কেজি চুন পানিতে মিশানো হয়, তারপর এতে বালু দেওয়া হয়। সেই মিশ্রণ হেলালকে জোর করে খাওয়ানো হয়।
“বুধবার সকাল ৬টার দিকে হেলাল বমি করে; তখন তার নাক দিয়ে সাদা পানি বের হয়েছিল। বারবার বাথরুম হচ্ছিল। পরিবারের লোকজন জানিয়েছে, তখন তার পায়খানার সঙ্গে রক্তও গেছে। তারপর তিনি মারা গেছেন।”
ওসি বলেন, “আমরা দোষীদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা করছি। পুলিশ, ডিবি মিলে অভিযান চলছে। এ ধরনের ঘটনা খুবই খারাপ। এর সঙ্গে যারাই জড়িত, তাদের গ্রেপ্তার করা হবে। মরদেহটি ময়নাতদন্তের জন্য সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।”
গণপিটুনি দিয়ে চুন-বালু মেশানো এসিড পানি খাওয়ানো হয় যুবককে, পরে মৃত্যু