Published : 18 Aug 2024, 09:59 AM
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ টাঙ্গাইলের ইমন ও তালহার চিকিৎসার ব্যয়ভার নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছে তাদের পরিবার।
পরিবারের আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে এই দুই আহতের সঠিক চিকিৎসা নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
সরকারি-বেসরকারি সহযোগিতা না পেলে হয় তাদের পঙ্গুত্ব বরণ করতে হবে অথবা অকালে প্রাণ ঝরে যাবে।
মো. ইমন (২১) গোপালপুর উপজেলার হেমনগর ইউনিয়নের নলিন এলাকার প্রয়াত জুলহাসের ছেলে।
তিনি মনিরুজ্জামান খান বিএম কলেজ থেকে ২০২৩ সালে এইচএসসি পাশ করে হেমনগর ডিগ্রি কলেজে ভর্তি হন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশ নিয়ে গত ৪ অগাস্ট বিকালে টাঙ্গাইলের মির্জাপুরের গোড়াইতে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের সময় তিনি গুলিবিদ্ধ হন। আহত অবস্থায় প্রথমে তাকে স্থানীয় একটি হাসপাতালে এবং পরে মির্জাপুর কুমুদিনী হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।
অবস্থা গুরুতর হওয়ায় ওই দিন আহত ইমনকে নিয়ে ঢাকার উত্তরার লেক ভিউ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে দু’দিনেই খরচ হয় লাখ টাকা।
অনেক কষ্টে ওই টাকা জোগাড় করে তার পরিবার। এরপর ৬ অগাস্ট ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাকে।
বর্তমানে সেখানেই আইসিইউতে চিকিৎসাধীন আছেন ইমন।
চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, তার অবস্থা আশঙ্কাজনক।
স্বজনরা জানান, ইমন ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ার সময় তার ভ্যানচালক বাবা মারা যান। চার ভাই-বোনের মধ্যে সবার বড় হওয়ায় অল্প বয়সেই সংসারের হাল ধরতে হয় তাকে।
টিউশনি করে নিজের পড়াশোনার পাশাপাশি সংসার চালিয়ে ছোট তিন ভাই-বোনকেও স্কুলে ভর্তি করান ইমন। অত্যন্ত মেধাবী ইমন স্বপ্ন দেখেন, পড়াশোনা শেষ করে ভালো চাকরি পেয়ে একদিন সংসারের দুঃখ দূর করবেন।
কিন্তু সেই স্বপ্ন এখন হাসপাতালের আইসিইউতে বন্দি।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের টাঙ্গাইলের অন্যতম সমন্বয়ক নবাব আলী বলেন, “ইমনের অবস্থা বেশি ভালো না। ঢাকা মেডিকেলের জরুরি বিভাগে লাইফ সপোর্টে আছে। গুলিবিদ্ধ স্থান থেকে অনেক রক্ত ঝরেছে। ১২ দিন ধরে অচেতন অবস্থায় আইসিইউতে আছেন।”
ইমনের চিন্তায় খাওয়া-ঘুম ছেড়ে দিয়েছেন তার মা রিনা বেগম। সারাক্ষণ বুক চাপড়ে সন্তানের জন্য আহাজারি করছেন।
তিনি বলেন, “বাবা মারা যাওয়ার পর সংসারের হাল ধরেছিল ইমন। পড়াশোনা আর সারাদিন টিউশনি করে সে।
“ওকে আন্দোলনে যেতে নিষেধ করেছিলাম, কিন্তু আমার কথা শোনেনি।
“এখন এর-ওর কাছ থেকে টাকা ধার করে চিকিৎসা করাচ্ছি। ডাক্তার বলেছেন, জ্ঞান ফিরলেই পেটে অপারেশন করা লাগবে। অনেক টাকার প্রয়োজন।”
ইমনের চাচাতো ভাই নয়ন বলেন, “চাচি অনেক কষ্টে ইমনের চিকিৎসার জন্য টাকা জোগাড় করে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যান।
“অবস্থা খারাপ হওয়ায় চিকিৎসকরা তাকে আইসিইউতে রাখছেন। কিন্তু টাকার অভাবে ইমনের চিকিৎসা বন্ধ হওয়ার পথে।”
তার চিকিৎসায় সমাজের বিত্তবানদের এগিয়ে আসার অনুরোধ জানান নয়ন।
টাঙ্গাইল শহরের হাজী আবুল হোসেন আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্র খন্দকার তালহা (১৭)।
তিনি পৌর এলাকার বেড়াবুচনা সবুজবাগ এলাকায় তার নানার ভিটায় মায়ের সঙ্গে থাকেন। তার বাবা খন্দকার আশরাফ আলীও এক সময় তাদের সঙ্গে থাকতেন। তবে মায়ের সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে যাওয়ার পর তিনি অন্যত্র বিয়ে করে চলে যান।
তালহার একমাত্র ছোট বোন আবুল হোসেন আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্রী। অভাবের সংসারে তালহা মাঝখানে পড়াশোনা ছেড়ে দেয়। পরে ফের ওই বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণিতে ভর্তি হয়।
৫ অগাস্ট তিনি ও তার বোন টাঙ্গাইলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশ নেয়।
আহত তালহার ভাষ্য, ওইদিন শহরের কলেজপাড়া এলাকায় পুলিশের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার একপর্যায়ে পুলিশ কাঁদুনে গ্যাস ছুড়ে। তখন পুরো এলাকা অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে।
তালহা দৌড়ে আশ্রয় নেন পাশে থাকা একটি চারতলা ভবনের ছাদে; পিছু নেয় পুলিশ। এক পর্যায়ে পুলিশের গুলিতে আহত হন তিনি। গুলিবিদ্ধ অবস্থায় সহপাঠীরা তাকে টাঙ্গাইল জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যায়।
গুলিবিদ্ধ তালহা বলে, “এতো বড় বিপদে প্রথম পড়েছিলাম। ওই দিন আমার বুকে যখন পুলিশ বন্দুক ঠেকিয়ে বলে গুলি করে দিব। দিশেহারা হয়ে বন্দুকটি বুক থেকে সরানোর জন্য ধস্তাধস্তি করি। এক পর্যায়ে বাম পায়ে গুলি লাগে। গুলিবিদ্ধ অবস্থায় পুলিশের কাছ থেকে দৌড়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় চিৎকার করলে সহপাঠীরা এসে সহযোগিতা করে।”
তালহার বোন সুমাইয়া আফরোজ বলেন, “ভাই-বোন মিলে আন্দোলনের অংশগ্রহণ করি। একপর্যায়ে পুলিশের গুলিতে ছত্রভঙ্গ হয়ে যাই। আমার ভাই যে গুলিবিদ্ধ হয়েছে, তখন জানতাম না। বাড়িতে আসার পর সহপাঠীরা আমাকে জানায়।”
এদিকে, টাকার অভাবে চিকিৎসা শেষ না করেই বাড়ি ফিরে যেতে হয় তালহাকে।
তালহার মা কোহিনুর বেগম বলেন, দুটি সন্তান রেখে স্বামী ছেড়ে যাওয়ার পর থেকে বাবার ভিটায় থেকে অন্যের বাড়িতে কাজ করে সামান্য কিছু টাকা রোজগার করেন। তা দিয়েই সংসার চালান।
তিনি বলেন, “ধারদেনা করে এ পর্যন্ত ৫০ হাজার টাকা শেষ করছি। আমার হাতে আর কোনো টাকা-পয়সা নাই। ডাক্তার বলছে, এখনো তালহার পায়ের বড় অপারেশন বাকি রয়েছে।”
কোহিনুর বেগম আরও বলেন, টাকার অভাবে ছেলের পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসা না করেই হাসপাতাল থেকে ছুটি নিয়ে বাড়ি চলে আসেন।
কিন্তু ছেলের পায়ে গুলির কিছু সিসা জাতীয় ধাতব ভেতরেই রয়ে গেছে। তার অবস্থা অবনতি হতে থাকলে, শনিবার ফের টাঙ্গাইল জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়।
চিকিৎসক বলছেন, অস্ত্রোপচার করতে হবে।
এ অবস্থায় কীভাবে তিনি সন্তানের চিকিৎসার ব্যয় মেটাবেন তা নিয়ে শঙ্কার মধ্যে আছেন।
তিনি বলেন, “সমাজের বিত্তবান ব্যক্তি ও সরকারের কাছে অনুরোধ, আমার ছেলেকে সহযোগিতা করুন।“
গুলিতে তালহার বাঁ পায়ের একটি আঙুল এরমধ্যে নষ্ট হয়ে গেছে জানিয়ে কোহিনুর বেগম বলেন, “আমার ছেলে আগের মত স্বাভাবিক না হলেও যদি নিজে একা একা চলাফেরা করতে পারে, সেই আশা নিয়ে সবার কাছে সহযোগিতা কামনা করছি।”
টাঙ্গাইল পৌরসভার ১১ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মেহেদী হাসান আলীম বলেন, “আমরা খোঁজ-খবর নেওয়ার চেষ্টা করছি। আসলে টানাটানির সংসারে গুলিবিদ্ধ ছেলেটা অসহায় হয়ে পড়ছে। আশপাশের মানুষ দুই-চারশ টাকা দেয়, সেই টাকা দিয়ে ব্যথার ওষুধ কিনে। পরিবারের যে অবস্থা, পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসা করানো তাদের পক্ষে সম্ভব না।”
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের টাঙ্গাইলের অন্যতম সমন্বয়ক ইফফাত রাইসা নূহা বলেন, “আমরা ইতোমধ্যে আন্দোলনে আহত বা শহীদের বাসায় যাচ্ছি। খোঁজ-খবর নিচ্ছি। আরও যাব। আমরা সমন্বয়করা আহতদের চিকিৎসার জন্য সর্বোচ্চ সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছি।
“প্রশাসন আমাদের কথা দিয়েছে, তারা আহতদের চিকিৎসার জন্য আর্থিক সহযোগিতা থেকে শুরু করে যা যা প্রয়োজন সবকিছুতেই আমাদের পাশে থেকে করবে। আমরা তাদের ওপর আস্থা রাখছি।”