১৫ থেকে ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত ধান কাটার চূড়ান্ত মুহূর্তে বৃষ্টিপাত ও উজানের ঢলের আশঙ্কা রয়েছে বলে মনে করছে আবহাওয়া কার্যালয়।
Published : 09 Apr 2025, 09:52 AM
সুনামগঞ্জের বিস্তীর্ণ হাওরের পর হাওরে দুলছে বোরো ধান। বিচ্ছিন্নভাবে কাটাও শুরু হয়েছে। কয়েকদিনের মধ্যেই পুরো ধান কাটা শুরু করবে কৃষক। গোলায় ধান তোলার স্বপ্ন নিয়ে এখন তারই প্রস্তুতি চলছে।
জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ধান সবুজের খোলস ছেড়ে হাল্কা হলুদের রূপ নিচ্ছে। তারপরেই ছড়াবে সোনালী আভা। আগামী সপ্তাহেই সারাজেলায় ধান কাটা শুরু হবে। পহেলা বৈশাখ আনুষ্ঠানিকভাবে হাওরের বোরো ধান কাটা উদ্বোধন করবে কৃষি বিভাগ।
বোরো ধানের সঙ্গে বৃষ্টিপাত ও পাহাড়ি ঢলের সম্পর্ক ওতপ্রতভাবে জড়িত। ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কম থাকবে। তবে ১৫ থেকে ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত ধান কাটার চূড়ান্ত মুহূর্তে বৃষ্টিপাত ও উজানের ঢলের আশঙ্কা রয়েছে। তাই দ্রুত ধান কাটার তাগিদও দিয়েছে জেলা প্রশাসন।
চলতি মৌসুমে সুনামগঞ্জের ১৩৭টি হাওরের প্রায় দুই লাখ ২৩ হাজার ৪১০ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। এর মধ্যে ২ লাখ ২৩ হাজার ৫১০ হেক্টরে চাষ হয়েছে। চার লাখ পরিবারের প্রায় ১০ লাখ চাষি বোরো চাষে জড়িত বলে কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
সুনামগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) মোস্তফা আজাদ বলেন, “এবার জেলায় লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি চাষ হয়েছে। আমরা মাসখানেক আগেই সরকারি ভর্তুকিতে দেওয়া ধান কাটার যন্ত্রগুলো তথ্য উপজেলা থেকে নিয়ে এসে সংশ্লিষ্ট কোম্পানিকে মেরামত করে দিতে বলেছি।
“এ ছাড়া স্থানীয় প্রায় ৫৫ হাজার শ্রমিকসহ বাইরের জামালপুর, ময়মনসিংহ থেকে কিছু শ্রমিক ও বাইরের জেলা থেকে আরো প্রায় ২৩৬টির মত মেশিন ধান কাটার জন্য আসবে।”
তিনি জানান, হাওরে চলতি বছর মোট চাষাবাদের ৩০ ভাগ হাইব্রিড, ৬৯.০৫ ভাগ উফশী ও ০.০৫ ভাগ দেশি ধান চাষ হয়েছে।
উফশীর মধ্যে বিআর ২৯, ৮৮, ৮৯, ৯২ চাষ হয়েছে বেশি। হাইব্রিডের মধ্যে সিনজেনটা, হীরা-১, ২, সুরভি, এসএলএইটএইচ, ময়নাসহ বিভিন্ন প্রজাতির রয়েছে। আর দেশি যে অল্প ধান রয়েছে তার মধ্যে দেশি গচি, টেপি, বোরো আবাদ করা হয়েছে। ৭০ থেকে ৮০ ভাগ ধান পাকলেই কেটে ফেলতে কৃষকদের বলা হয়েছে।
বৃষ্টি কম হওয়ায় দুশ্চিন্তা
জেলার শাল্লা, দিরাই ও বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার কয়েকটি হাওর ঘুরে দেখা গেছে, হাওরে-হাওরে পতিত জমিতে তৈরি হচ্ছে ধান কাটার পর সিদ্ধ করে শুকানোর জন্য ‘খলা’ (মাঠ বিশেষ) এবং কান্দায় (পতিত উঁচু ভূমি) থাকায় জন্য তৈরি করা হচ্ছে ‘ওড়া’ (অস্থায়ী খুপড়ি ঘর)।
শেষ মুহূর্তে উজানের ঢল বা প্রাকৃতিক দুর্যোগ এসে যাতে কষ্টের ফসল কেড়ে না নেয় তার জন্য গ্রামে গ্রামে হিন্দু-মুমলমানের ঘরে পালন করা হচ্ছে বিশেষ লোকাচার। প্রকৃতিকে খুশি রেখে মানত পূরণ করে সোনার ধান গোলায় ভরতে চায় কৃষক।
আর মাত্র এক সপ্তাহ পরেই পুরোদমে শুরু হয়ে যাবে ধান কাটার উৎসব; স্থানীয়ভাবে যা ‘দাওয়ামারি’ নামে পরিচিত। গ্রামে গ্রামে এখন সেই প্রস্তুতিই চলছে।
তবে এবার সময়মত ও পর্যাপ্ত বৃষ্টি না হওয়ায় ফলন কম হওয়ার শঙ্কা রয়েছে কৃষকের।
পূর্বাঞ্চলের সবচেয়ে বড় এই জলভাণ্ডারের নিচু জমি দেশের খাদ্যশস্যের বড় জোগানদারও। এক ফসলি এই জমির দিকে সারাবছর তাকিয়ে থাকে হাওর অধ্যুষিত সাত জেলার কৃষক। তবে সবচেয়ে বেশি ধান হয় নেত্রকোণা ও সুনামগঞ্জ জেলায়।
সুনামগঞ্জ জেলার দেশি আগাম ধান কাটা হয় মধ্য চৈত্র থেকে বৈশাখের শুরুতে। হাওরের জমির পুরোটাই এক ফসলি। এই ফসলের ওপর নির্ভর করেই হাওরের কৃষক সারা বছরের খাওয়া-পরা, ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া, সামাজিক অনুষ্ঠানাদি সবকিছু চালায়। এটাই অনেকের বেঁচে থাকার অবলম্বন।
বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার খরচার হাওরের কৃষ্ণনগর গ্রামের স্বপন কুমার বর্মণ বেশ অবস্থাসম্পন্ন কৃষক। তিনি এবার হাইব্রিড ও উফশি মিলিয়ে প্রায় সাড়ে ৪০০ শতাংশ জমিতে ধান চাষ করেছেন। এ ছাড়া খরচে কুলাতে না পেরে নিজের কিছু জমি বর্গাও দিয়েছেন।
স্বপন কুমার বর্মণ হিসাব দিয়ে বলছিলেন, এক কেদার (৩০ শতাংশ) জমিতে চাষ থেকে গোলায় তোলা পর্যন্ত ছয় থেকে সাত হাজার টাকা খরচ হয়। ফলন ভাল হলে সর্বোচ্চ ১৩ থেকে ১৫ হাজার টাকার ধান পাওয়া যায়।
তিনি বলছিলেন, “এবার ধান রোপণের পর দীর্ঘদিন বৃষ্টি হয়নি। এতে ফলন কম হবে। এ ছাড়া কৃষকদের অনেক যন্ত্রপাতি এখনো মেরামত করা যায়নি। দ্রুত মেরামত করা না গেলে পাকা ধানক্ষেত হুমকিতে পড়ে পাহাড়ি ঢলে ফসলহানীর আশঙ্কায় থাকবে।”
একই হাওরের মুক্তিখলা গ্রামের কৃষক কামরুল ইসলাম বলেন, “কৃষিতে মানুষের আগ্রহ কমছে। প্রতি বছরই বন্যা, খরায় ক্ষতি হচ্ছে। সময়মত সার ও বীজও পাওয়া যায় না। তারপরও উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া কৃষিকাজ করতে হচ্ছে কৃষকদের।”
ধান কাটা কিছু কিছু জায়গায় শুরু হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “কয়েকদিনের মধ্যেই ধান কাটার ধুম পড়ে যাবে। দুই সপ্তাহ সময় পেলেই আমাদের ধান প্রায় ৮০ ভাগ কেটে তুলতে পারব।”
শাল্লা উপজেলার ছায়ার হাওরের প্রান্তিক কৃষক অপু চন্দ্র দাস সাধারণত অন্যের জমি বর্গা চাষ করে থাকেন। সারা বছর নিজে দিনমজুরি করেন। সেখান থেকে কিছু টাকা উদ্বৃত্ত রেখে দেন। সেই টাকা দিয়েই বর্গা চাষ করেন।
তিনি বলছিলেন, “আগাম ঢল বা বন্যা না আসলে আমাদের খোরাকি তোলতে পারি। বন্যায় ক্ষতি হলে খোরাকির সঙ্গে আমাদের ধারদেনাও বেড়ে যায়। প্রান্তিক কৃষকরা মৌসুমে সরকারি সার ও বীজ পায় না। যারা প্রভাবশালী তারাই এসব হাতিয়ে নেয়।”
জগন্নাথপুর উপজেলার নলুয়ার হাওরের কৃষক সালেহ আহমদ বলেন, “আমরা ধান কাটার সব প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছি। দুই সপ্তাহ লাগবে।”
তাছাড়া কম্বাইন হার্ভেস্টরের কারণে এখন ধান কাটা সহজ হয়েছে। তবে নিচু জমিতে এই যন্ত্রে ধান কাটা যায় না বলে জানান তিনি।
‘লাভবান অইতে পারতাম না’
দেখার হাওরসহ কিছু কিছু জায়গায় অল্প পরিমাণে ধান কাটা শুরু হয়েছে। মূলত যারা আগে আগে ধান রোপণ করতে পেরেছিলেন তারাই এখন ধান কাটতে পারছেন। তবে, ধানের মান নিয়ে সন্তোষ্ট না কৃষক।
দেখার হাওরের মধুপুর গ্রামের ইছব আলী বলেন, “চৈত মাসের ২৩ তারিখ তনি ধান কাটেরাম। ইবার বিআর ২৯, ৮১ ও ৮৮ লাগাইছিলাম। ধান নষ্ট অইগিছে তিন ভাগের একভাগ। কৃষি বিভাগ ২৮, ২৯ এর বদলা ৮১, ৮৮ লাগাইতে কয়। কিন্তু ফলন তো বালা অইছে না। লাভবান অইতে পারতাম না। কোনো লাখান খরচ ওঠব।
কৃষক ইছব আলী দেখার হাওরের হিয়ালমারা অংশে দুই একর জমিতে ধান লাগিয়েছিলেন।
সদর উপজেলার অক্ষয়নগরের ধানকাটা শ্রমিক সিরাজ মিয়া ওই কৃষকের ধান কাটছেন।
তিনি বলেন, “নষ্ট ধান কাইট্যা পোষতোনা।”
৬ টুকরি ধান কৃষকের আর এক টুকরি শ্রমিকের (ছয় হিস্যা হিসেবে) কাটছেন তারা। কিন্তু বিআর ২৯, ৮১ ও ৮৮ ধান নষ্ট হওয়ায় তাদের পোষছে না বলে জানান তিনি।
এদিকে বৃহস্পতিবার কৃষি উপদেষ্টা শান্তিগঞ্জ উপজেলার দেখার হাওরে ধান কাটা উদ্বোধন করবেন বলে প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
কম্বাইন হার্ভেস্টর আর রিপার নিয়ে দুশ্চিন্তা
সুনামগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত উপ-পরিচালক মোস্তফা আজাদ জানান, দ্রুত ধান কাটতে জেলায় ৭৫০টি কম্বাইন হার্ভেস্টর এবং ১৭০টি রিপার রয়েছে। এ ছাড়া বাইরের জেলা থেকেও আরো ২৩৬টি যন্ত্র ধান কাটার জন্য আসার কথা রয়েছে।
একটি কম্বাইন হার্ভেস্টর মেশিনে দৈনিক ৩০ বিঘা এবং একটি রিপার মেশিনে প্রতিদিন পাঁচ বিঘা জমির ধান কাটতে পারে। যেখানে একজন শ্রমিক গড়ে প্রায় ১৫ শতাংশ জমির ধান কাটতে পারেন।
তবে কৃষকরা জানিয়েছেন, সরকারি ভর্তুকিতে পাওয়া ধান কাটার কয়েকশ মেশিন দীর্ঘদিন ধরে বিকল আছে। কোম্পানির ওয়ারেন্টি টাইম থাকলেও মেরামত করে দিতে নানা টালবাহানা করছে তারা। বাধ্য করছে কোম্পানির কাছ থেকে যন্ত্রপাতি কিনতে হচ্ছে। তাই এসব নিয়ে বিপাকে পড়েছেন কৃষকরা। নিম্নমানের যন্ত্র কৃষকদের গছিয়ে দিয়েছে অভিযোগ করেছেন একাধিক কৃষক।
কৃষি বিভাগ জানিয়েছে, সারাজেলায় ১৭০টি কম্বাইন হার্ভেস্টর যন্ত্র বিকল ছিল। এগুলো মেরামত করে দিতে মাস খানেক আগে সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলোকে জরুরি চিঠি লেখা হয়। এর মধ্যে মাত্র ৭১টি যন্ত্র মেরামত করা হয়েছে। বাকিগুলো এখনো মেরামত হয়নি।
ফসলরক্ষা বাঁধের কাজ নিয়ে অসন্তোষ
চলতি বোরো মৌসুমে এবার জেলার ৫৩টি হাওরের প্রায় ৬০০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ মেরামত, সংস্কার ও পুননির্মাণে ৬৮৭টি প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি বা পিআইসি কাজ করেছে। প্রতিটি পিআইসিতে সর্বনিম্ন পাঁচ লাখ থেকে সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এতে সর্বমোট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে প্রায় ১২৭ কোটি টাকা।
গত বছরের ১৫ ডিসেম্বর কাজ শুরু করে ২৮ ফেব্রুয়ারি কাজ শেষ করার কথা থাকলেও কাজ শেষ করা হয়েছে ১০ মার্চ। তবে এবারও কাজ নিয়ে অনিয়ম, দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন কৃষকরা।
‘হাওর বাঁচাও আন্দোলন’ নামে একটি সংগঠন ২৪ জানুয়ারি সংবাদ সম্মেন করে বাঁধের কাজে অসচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাবের অভিযোগ করেছিল। পরে ১২ মার্চ আবারও সাংবাদ সম্মেলন করে বাঁধের কাজ শেষ হয়নি বলে দাবি করে সংগঠনটি।
২০১৮ সাল থেকে ঠিকাদারি প্রথার বদলে পিআইসির মাধ্যমে হাওরের ফসলরক্ষা বাঁধ নির্মিত হচ্ছে। এতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সভাপতি ও পাউবোর স্টেশন অফিসার সদস্যসচিব হিসেবে পিআইসি গঠন করে জেলা কমিটির কাছে পাঠিয়ে দেন। বাঁধের বরাদ্দ উপজেলা সভাপতি ও সদস্যসচিবের স্বাক্ষরে পিআইসির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক উত্তোলন করেন।
‘হাওর বাঁচাও আন্দোলন’ এর কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক বিজন সেনরায় বলেন, “বরাবরের মত এবারও বাঁধের কাজে অনিয়ম, দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা হয়েছে। যথাসময়ে কাজ না করে শেষ দিকে এসে তড়িগড়ি করে কাজ করা হয়েছে।”
‘হাওর বাঁচাও আন্দোলন’ এর জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল হক মিলন বলেন, “প্রতিটি হাওরেই প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন, প্রি-ওয়ার্ক ও পোস্ট-ওয়ার্কে দুর্নীতি হয়। এবারও তাই হয়েছে। অক্ষত বাঁধেও বিপুল বরাদ্দ দিয়ে লোপাট করা হয়েছে সরকারি টাকা।
“দেখার হাওর, খরচার হাওর, শনির হাওর, ছায়ার হাওরসহ বিভিন্ন হাওরে আমরা এমন একাধিক দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ এবং প্রমাণ পেয়েছি।”
এসব বিষয়ে সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী ও বাঁধ সংক্রান্ত কমিটির সদস্যসচিব মামুল হাওলাদার বলেন, “১০ মার্চ বাঁধের কাজ শেষ হয়েছে। বাঁধের কাজ শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আমরা তদারকি করেছি। কোনো অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়নি। তবে কিছু হাওরে মাটি সংকট ও পানির বিলম্বে নামার কারণে কাজে বিলম্ব হয়েছে।”