শুষ্ক মৌসুমে রংপুরের হারাগাছের মরা তিস্তা নদীর বুক চিরে হেঁটেই চলাচল করা গেলেও বর্ষা মৌসুমে নৌকা আর বাঁশের সাঁকোই ভরসা।
Published : 23 Jul 2023, 09:23 AM
রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার হারাগাছ পৌরসভায় মরা তিস্তা নদীর উপর একটি সেতুর আশ্বাস বারবার দিয়েছেন জনপ্রতিনিধিরা। কিন্তু কেউ কথা রাখেননি, তাই ঝুঁকি নিয়ে পুরোনো নড়বড়ে বাঁশের সাঁকো দিয়েই নদী পার হচ্ছেন নয়টি গ্রামের অর্ধ লক্ষাধিক মানুষ।
পাকা সেতু দিয়ে নদী পারাপারের স্বপ্নের কথা জানিয়ে হারাগাছ পৌরসভার বাংলাবাজার গোল্ডেনের ঘাট এলাকার বাসিন্দা আজিজুর রহমান (৫৫) বলেন, “এখন আবার ভোট আসছে, এখন কিন্তু সবাই আসবে আর কিন্তু এই ভুল করবাই নই হমারা।”
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ভোট আইলে (আসলে) হামাক বিভিন্ন মার্কার প্রার্থীরা কয় এবার তোমার এই ব্রিজটা করে দেব। হামাক তোমরা ভোট দ্যাও, হামরা যদি হই তাহলে ব্রিজ করি দেমো।
“কিন্তুক কোনদিন, কী ভাবে হইবে এখনা কথা কয় না, খালি ভোট নিয়ে যায়। হামারগুলার দিকে কেউ তাকায় না।
বারবার স্বপ্নভঙ্গের কথা জানিয়ে তিনি বলেন, “ভোটের আগত উপজেলার চেয়ারম্যান, পৌরসভার মেয়র ও হামার এলাকার বলে বাণিজ্যমন্ত্রী, তার লোকেরা পর্যন্ত ব্রিজ বানিয়ে দেওয়ার কথা বলে ওয়াদা করেছে। কিন্তু আইজ পর্যন্ত হামরা এই ব্রিজের মুখ দেকনো না।”
তিনি জানান, মরা তিস্তা নদীর ওপারে পাঁচটি বাজার, পাঁচটি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও দুটি মাদ্রাসা রয়েছে। সেতু না থাকায় সাধারণ মানুষের যাতায়াতে চরম বিপাকে পড়তে হয়। তাই নিজেরাই বাঁশের সাঁকো বানিয়েছেন তারা।
আজিজুর বলেন, “হামার কষ্ট কায় দেখলো বাহে কনত তোমরা। ওই তকনে হামরা নিজেরাই গ্রামে গ্রামে বাঁশ তুলিয়া ভাঙা নড়বড়া বাঁশের সাঁকো বানাইছি, এটাই হামার একমাত্র ভরসা।”
শনিবার সকালে সরেজমিনে দেখা যায়, মরা তিস্তা নদীটি হারাগাছ পৌরসভাসহ চারটি ইউনিয়নের ভিতর দিয়ে পার হয়ে তিস্তা রেল সেতু পয়েন্টে গিয়ে মিলিত হয়েছে। নদীর ওপর গোল্ডেনের ঘাট এলাকায় তৈরি করা হয়েছে ৩১০ হাত লম্বা বাঁশের সাঁকো।
শুষ্ক মৌসুমে নদীর বুক চিরে পায়ে হেঁটেই চলাচল করে এলাকাবাসী। কিন্তু বর্ষা মৌসুমে নৌকা আর এই বাঁশের সাঁকোই ভরসা তাদের।
এই নড়বড়ে সাঁকো দিয়ে খুনিয়াগাছ ইউপির মিলন বাজার, টাংরীর বাজার, তালপট্রি, হরিণ চড়া, হারাগাছ পৌরসভার চরচতুরা, ধুমগাড়া, রাজপুর ইউপির চিনাতুলি, প্রেমের বাজার, হারাগাছ ইউপির পল্লীমারী গ্রামের শিক্ষার্থীসহ প্রায় অর্ধ লক্ষাধিক মানুষ পৌরসভা ও উপজেলা সদরে যাতায়াত করে।
বাশের সাঁকো দিয়ে পারাপারের সময় কথা হয় এই এলাকার আমিনুর রহমানের (৫০) সঙ্গে। তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, গোল্ডেন নামের একজন নৌকা দিয়ে যাতায়াত ব্যবস্থা চালু করেছিলেন, তখন থেকে এর নাম হয় গোল্ডেনের ঘাট। পরবর্তীতে কমিশনার সাবেদ আলী, মানিক ও তাজুলসহ গ্রামবাসীর সহযোগিতায় ২০১৩ সালে নৌকার পরিবর্তে বাঁশের সাঁকো তৈরি করে নদী পারাপারের ব্যবস্থা করা হয়।
স্থানীয় মুদি দোকানদার আসাদুজ্জামান জানান, পাকা সেতু না থাকায় তারা ভারী যানবাহন নিয়ে চলাচল করতে পারেন না। ফলে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দোকানের মালামাল এই বাঁশের সাঁকো দিয়ে নিয়ে আসতে হয়।
তিনি বলেন, “একদিন দোকানের মালসহ পড়ে গিয়েছিলাম এই বাঁশের সাঁকোতে।”
কৃষক আজিম উদ্দিন (৬০) জানান, পাকা সেতু না থাকায় উৎপাদিত কৃষিপণ্য বিক্রয় করতে বহু দূর ঘুরে বাজারে নিতে হয়। এতে পরিবহন খরচ বেশি হয়। যথাসময়ে হাটবাজারে পৌঁছানোও সম্ভব হয় না।
কারমাইকেল কলেজের ছাত্র আরিফুল ইসলাম জানান, শুকনো মৌসুমে ভয়ভীতি না থাকলেও বর্ষা মৌসুমে নদীতে পানি বাড়লে চলাচলের সমস্যা হয়। তখন তারা খুব ভয়ে ভয়ে বাঁশের সাঁকো দিয়ে নদী পার হন।
“সবাই বলে পাকা সেতু হবে কিন্তু হয় না। আমাদের কষ্ট দেখার কেউ নেই। আমাদের সঙ্গে সবাই শুধু প্রতারণা করে ভোট নিয়ে যায়।”
স্থানীয় খোকন মিয়া জানান, আশপাশের গ্রামগুলোতে আলু, ভুট্টা, ধান, পাট, গম, মরিচ, বাদামসহ বিভিন্ন ধরনের শাক-সবজি উৎপাদন হয়। এসব কৃষিপণ্য হাট-বাজারে নিতে হলে অনেক পথ ঘুরে যেতে হয়। অথচ গোল্ডেনের ঘাটে পাকা সেতু নির্মাণ হলে অর্ধেক পথ কমে আসবে, সেইসঙ্গে এলাকার কৃষকরা পাবেন তাদের উৎপাদিত ফসলের ন্যায্যমূল্য।
হারাগাছ পৌরসভার ৮ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আব্দুল কাদের রানা সরকার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, গোল্ডেনের ঘাটে একটি স্থায়ী পাকা সেতু নির্মাণ জরুরি প্রয়োজন। কারণ এটি ৮ নম্বর এবং ৯ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দাদের পারাপারের অন্যতম যোগাযোগ মাধ্যম।
“এ নিয়ে আমি মেয়রের সঙ্গে অনেকবার কথাও বলেছি। আমাদের ইঞ্জিনিয়ার সরেজমিনে দেখে গেছেন। যতদূর জানি সেতু তৈরির একটা প্রস্তাবনা করা হয়েছে। এখন অর্থ বরাদ্দ মিললে সেতুর কাজ শুরু হতে পারে।”
৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মাহাবুবুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, জনগণের দুর্ভোগ হচ্ছে এটা তো অস্বীকার করার সুযোগ নেই। আমরা গোল্ডেনের ঘাটে সেতু নির্মাণ করব, ইনশাআল্লাহ।
“এখন শুধু অর্থ বরাদ্দের অপেক্ষায় আছি। আশা করছি আগামী অর্থ বছরে বরাদ্দ পেলে কাজ শুরু করা যাবে।”
এ ব্যাপারে হারাগাছ পৌরসভার মেয়র এরশাদুল হকের মোবাইল নম্বরে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি, তার ফোন বন্ধ থাকার কারণে।