উপাধ্যক্ষ মাজারুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, “মহাসড়কে ধাওয়ার ঘটনায় আমাদের ৩০ শিক্ষার্থী আহত হয়েছে।”
Published : 16 Apr 2025, 05:45 PM
ছয় দফা দাবিতে পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীরা ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে কুমিল্লার কোটবাড়িতে অবরোধের ফলে তীব্র যানজট সৃষ্টি হয়ে যাত্রী ও পরিবহন চালকরা ভোগান্তির মধ্যে পড়েছেন।
কুমিল্লা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীরা বুধবার বেলা ১১টা থেকে বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ কর্মসূচি শুরু করে। দুপুর ১২টা থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে অবস্থান নিয়ে যান চলাচল বন্ধ করে দেয় তারা।
দুপুর ২টা পর্যন্ত টানা দুই ঘণ্টার অবরোধে মহাসড়কের ঢাকা ও চট্টগ্রামমুখী লেনে অন্তত ১০ কিলোমিটার যানজট সৃষ্টি হয়।
দুপুর ২টার দিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী শিক্ষার্থীদের ধাওয়া দিয়ে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। তারপর শুরু হয় এই পাটকেল নিক্ষেপ। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী লাঠিপেটা করে বলে অভিযোগ শিক্ষার্থীদের। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সেখানে সেনাবাহিনীর সদস্যরাও ছিলেন।
এ সময় অন্তত ৩০ জন আহত হয় বলে কুমিল্লা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে। তাদের কয়েকজনকে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে।
এ ব্যাপারে সদর দক্ষিণ থানার ওসি রফিকুল ইসলাম বলেন, “আমরা আন্দোলনকারীদের শান্তিপূর্ণভাবেই সরিয়ে দিয়েছি। কেউ আহত হয়েছে বলে আমার কাছে তথ্য নেই।”
সরকারি এবং বেসরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট ও টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজসহ (টিএসএস) বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের আওতাধীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষার্থীদের জোট ‘কারিগরি ছাত্র আন্দোলন বাংলাদেশ’ এর ব্যানারে তারা এ আন্দোলন করছেন।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, শিক্ষার্থী ও পরিবহন শ্রমিকরা জানান, সারাদেশে কর্মসূচির অংশ হিসেবে কুমিল্লা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীরা ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ করে। এ সময় জেলা প্রশাসন, সেনাবাহিনী ও পুলিশের পক্ষ থেকে অবরোধ তুলে নেওয়ার জন্য বারবার বলা হলেও শিক্ষার্থীরা সরে যায়নি।
এক সময় সদর দক্ষিণ উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) সৈয়দ রেফাই আবিদ শিক্ষার্থীদের সড়ক থেকে সরে যেতে মৌখিকভাবে বলেন। কিন্তু শিক্ষার্থীরা সরে যায়নি। পরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী শিক্ষার্থীদের ধাওয়া দেয়। এ সময় ফাঁকা গুলির শব্দ শোনা যায়। এ সময় দুজনকে আটক করতে দেখা যায়। শিক্ষার্থীরা সড়ক ছেড়ে যাওয়ার পর যান চলাচল স্বাভাবিক হয়।
কুমিল্লা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীরা জানান, তারা যৌক্তিক দাবি আদায়ে আন্দোলন করছেন। তারা চেয়েছিলেন, প্রশাসন থেকে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এসে তাদের সঙ্গে কথা বলুক। কিন্তু তা হয়নি; উল্টো ধাওয়া দিয়েছে।
সাত রাস্তা, মিরপুর, মোহাম্মদপুরে পলিটেকনিক শিক্ষার্থীদের অবরোধ
কুমিল্লা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের উপাধ্যক্ষ মো. মাজারুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, “মহাসড়কে ধাওয়ার ঘটনায় আমাদের ৩০ শিক্ষার্থী আহত হয়েছে। তাদের মধ্যে যাদের জখম রয়েছে তাদেরকে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। আর যারা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে ছিল আমরা তাদেরকে নিয়ে এসেছি তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করছি।”
১০ কিলোমিটার যানজট, গরমে ভোগান্তি
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ করে রাখায় কোটবাড়ি থেকে ঢাকা ও চট্টগ্রাম উভয়মুখী লেনে ১০ কিলোমিটার যানজট সৃষ্টি হয়। প্রচন্ড গরমের মধ্যে ভোগান্তিতে পরে সাধারণ মানুষ। শত শত পণ্যবাহী ও যাত্রীবাহী যানবাহন ২ ঘণ্টারও বেশি সময় প্রায় এক জায়গাতেই আটকে থাকে। কেউ কেউ উল্টো গাড়ি ঘুরিয়ে চলে যেতেও দেখা যায়।
নোয়াখালী থেকে ঢাকাগামী জননী পরিবহনের যাত্রী আমিনুল ইসলাম বলেন, “সকাল সাড়ে ১১টা থেকে কোটবাড়ি এলাকায় আটকে আছি। প্রচন্ড গরমে হাঁসফাঁস অবস্থা। শিশু ও নারীদের অবস্থা আরো খারাপ।”
ট্রাকচালক বাদল মিয়া বলেন, “যাত্রীবাহী গাড়ি চাইলে ঘুরিয়ে চলে যেতে পারে, কিন্তু আমরা তো এক জায়গাতেই আটকা। শিক্ষার্থীদের আন্দোলন চলতেছে, আর শত শত গাড়ি আটকা পড়ে আছে।”
চাকরি সংক্রান্ত কাজে ঢাকাগামী প্রাইভেট কার যাত্রী মনিরা ইসলাম বলেন, “আমার দুপুর ২টার মধ্যেই ঢাকায় উপস্থিত থাকার কথা। কিন্তু কোনোভাবেই সেটি সম্ভব হল না। গাড়ি থেকে নেমে প্রতিবাদস্থল ছাড়িয়ে অন্যপ্রান্তে গিয়েও গাড়িতে ওঠার চেষ্টা করেছি, কিন্তু সেখানেও গাড়ি নেই। বিপত্তিতে পড়তে হল।”
কুমিল্লা ময়নামতি হাইওয়ে থানার ওসি ইকবাল বাহার মজুমদার বলেন, “দুপুর পর্যন্তই পাঁচ কিলোমিটারেরও বেশি যানজট ছিল। পরে আরো বেড়েছে। যেসব গাড়ি আটকা পড়েছে আমরা চেষ্টা করেছি সেগুলো যেন উল্টো পথে না আসে। দুপুর ২টায় যান চলাচল শুরু হলে স্বাভাবিকভাবেই মহাসড়কের গতি ফিরে আসে।”
কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) সৈয়দ রেফাঈ আবিদ বলেন, “আমরা বিক্ষোভকারীদের বারবার বলছিলাম শান্তিপূর্ণভাবে সরে যাওয়ার জন্য। তারা বলছে, কেন্দ্রীয়ভাবে সিদ্ধান্ত আসলে মহাসড়ক থেকে সরবে, তার আগে সরবে না।
“কিন্তু ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক সারা বাংলাদেশের অর্থনীতির ‘লাইফ লাইন’। এভাবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা মহাসড়ক বন্ধ থাকায় চালক ও যাত্রীরা যেমন ভোগান্তির শিকার হচ্ছিলেন, তেমনি অর্থনৈতিকভাবেও ক্ষতি হচ্ছিল। তাই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ব্যবস্থা নিয়েছে।”
শিক্ষার্থীদের ছয় দফা দাবিনামা
শিক্ষার্থীরা জানান, তাদের মূল দাবির মধ্যে রয়েছে- জুনিয়র ইন্সট্রাকটর পদে ক্রাফট ইন্সট্রাকটরদের অবৈধ প্রোমোশনের হাই কোর্টেরর রায় বাতিলসহ ক্রাফট ইন্সট্রাকটর পদবি পরিবর্তন ও ওই মামলার সাথে সম্পৃক্ত সকলকে স্থায়ীভাবে চাকুরিচ্যুত করতে হবে।
২০২১ সালের বিতর্কিত ক্রাফট ইন্সট্রাকটর নিয়োগের জন্য রাতের আঁধারে নিয়োগবিধি অনতিবিলম্বে বাতিল করতে হবে, সুষ্ঠু তদন্তের ভিত্তিতে নিয়োগ বাতিল করতে হবে এবং মামলার প্রধান কারিগর ক্রাফট ইন্সট্রাকটরদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।
শিক্ষার্থীদের অন্য দাবিগুলো হল–
>> ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্স চার বছর মেয়াদী অব্যাহত রাখা এবং মানসম্মত সিলেবাস ও কারিকুলাম আধুনিক বিশ্বের আদলে প্রণয়ন করা।
>> উপ-সহকারী প্রকৌশলী ও সমমান (১০ম গ্রেড) পদে ৪ বছর মেয়াদি ডিপ্লোমা-ইন-ইঞ্জিনিয়ারিং ও মনোটেকনোলজি (সার্ভেয়িং) হতে পাস করা শিক্ষার্থী ছাড়া অন্য কেউ আবেদন করতে পারবে না এবং এই পদ সংরক্ষিত করতে হবে। প্রাইভেট সেক্টরে ডিপ্লোমা-ইন-ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করা ছাত্রদের ন্যূনতম ১০ম গ্রেডের বেসিক অর্থাৎ ১৬০০০ টাকা দেওয়া।
>> কারিগরি শিক্ষা সংস্কার কমিটি প্রকাশ করে কারিগরি সেক্টর পরিচালনায় পরিচালক, উপ-পরিচালক, অধ্যক্ষ ও দায়িত্বে থাকা সকল পদে কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত জনবলকে দায়িত্ব/নিয়োগ দেওয়া।
>> কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের বিতর্কিত সকল নিয়োগ বিধিমালা সংশোধন এবং কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত জনবল সকল শূন্য পদে পলিটেকনিক ও টিএসসিতে দক্ষ শিক্ষক ও দক্ষ ল্যাব সহকারীর নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা।
>> ডিপ্লোমা ইন-ইঞ্জিনিয়ারিং ও মনোটেকনোলজি থেকে পাস করা শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষার জন্য আধুনিক বিশ্বের আদলে একটি বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করার গেজেট পাস করতে হবে এবং বর্তমানে প্রস্তাবিত চারটি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ (নওগাঁ, ঠাকুরগাঁও, নড়াইল, খাগড়াছড়ি) শতভাগ সিট নিশ্চিত করা।