ইউএনও বলেন, “আমি অভিযোগকারীদেরকে শাহজাহানের বিরুদ্ধে থানায় মামলার পরামর্শ দিয়েছি।”
Published : 26 Oct 2024, 04:51 PM
ষাটোর্ধ্ব সেলিম মিয়া বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লার পদুয়ার বাজার এলাকায় তিনি ভিক্ষা করেন। যাত্রী ও পথচারীদের কাছে হাত পেতে যা পান তা দিয়েই স্ত্রী আর দুই সন্তানকে ভরণপোষণ দেন তিনি।
ভূমিহীন সেলিম মিয়া ১৫ বছর আগে লালমাই পাহাড়ের কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলার বিজয়পুর ইউনিয়নের শ্রীবিদ্যা এলাকার তেত্যুইয়া মুড়া নামক স্থানে সরকারি পরিত্যক্ত একটি জায়গায় বসতি গড়তে যান। সেখানে গিয়ে তিনি জানতে পারেন, ওই এলাকায় কেউ নতুন বসতি গড়তে চাইলে জমির পরিমাণ অনুযায়ী স্থানীয় ২ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি শাহজাহানকে টাকা দিতে হয়।
সেলিম মিয়া উপায়ান্তর না পেয়ে শাহজাহানের কাছে ভিক্ষা করে জমানো ৪০ হাজার টাকা দিয়ে চার শতক জমিতে একটি ঘর তৈরি করে বসবাস শুরু করেন।
সেলিম মিয়া একা নন। আওয়ামী লীগ নেতা শাহজাহান ও তার সঙ্গীদের টাকা দিয়ে গত দুই দশকে লালমাই পাহাড়ে জমির তথাকথিত দখলস্বত্ব কিনেছেন ভূমিহীন অন্তত ২০টি পরিবার। এদের মধ্যে ১২টি পরিবার বসতি গড়েছে।
আটটি পরিবার টাকার অভাবে এখনো ঘর নির্মাণ করতে পারেননি। ওই ভূমিহীন পরিবারগুলোই এখন উচ্ছেদ আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন।
ভুক্তভোগীদের দাবি, আওয়ামী লীগের পতন হলেও এই এলাকায় পতন হয়নি শাহজাহানের রাজত্বের। তিনি এখন কৌশলে ভূমিহীন পরিবারগুলোকে উচ্ছেদ করে পাহাড়ের ভূমি মোটা অংকের টাকায় বিক্রির পাঁয়তারা করছেন।
সরজমিনে পাহাড়ের তেত্যুইয়া মুড়া এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, সেখানে বসবাসকারীদের জীবন যেন দুর্বিষহ। তাদের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় রয়েছেন ভিক্ষুক সেলিমের পরিবার। ভাঙা দোচালা একটি টিনের ঘরে তাদের বসবাস। আশপাশের সকলের ঘরে বিদ্যুৎ থাকলেও চাহিদামতো শাহজাহানকে টাকা দিতে না পারায় বিদ্যুতের সংযোগ ভাগ্যে জোটেনি প্রতিবন্ধী সেলিমের।
সেলিমের ঘরের পেছনেই ১৫ ফুটের পাহাড়ি মাটির বেস্টনির মধ্যে বসতি গড়েছেন রিকশাচালক মফিজ মিয়া। তার স্ত্রী বিলকিছ আক্তার কুমিল্লা ইপিজেডের একটি কারখানায় শ্রমিকের কাজ করেন। তাদের একটি কন্যাসন্তান রয়েছে। বৃষ্টি হলেই তাদের রাত কাটে পাহাড়ি ঢল আর ধসের আতঙ্কে।
উচ্ছেদ আতঙ্কে থাকা ভুক্তভোগী সীমা বেগম বলেন, “প্রায় ১৬ বছর আগে আওয়ামী লীগ নেতা শাহজাহানের কাছ থেকে এক লাখ ১০ হাজার টাকায় সাড়ে তিন শতক জায়গা কিনেছি। তিনি দলিল বা স্ট্যাম্প দেননি।
“তিনি টাকা নিয়ে আমাদের নিজেদের নামে বিদ্যুতের মিটারও নামিয়ে দিয়েছেন। অথচ গত কয়েকদিন ধরে বিভিন্ন মাধ্যমে আমাদেরকে এই জমি থেকে সরে যেতে বলতেছেন শাহজাহান।”
মমিনা বেগম নামে আরেক নারী বলেন, “১৫ বছর আগে স্ট্যাম্পে লেখালেখির মাধ্যমে ৬০ হাজার টাকা মূল্য পরিশোধ করে শাহজাহানের মাধ্যমে শ্রীবিদ্যার রফিক মিয়া কাছ থেকে ছয় শতক জমি দখল বুঝে পেয়ে বসতি স্থাপন করেছি।
“এখন তারা বলে আমাকে বাড়ি ছেড়ে দিতে হবে। এগুলো সরকারি জমি। আমার প্রশ্ন হলো সরকারি পাহাড় তারা কিভাবে আমাদের কাছে বিক্রি করেছেন?”
আরেক ভুক্তভোগী বিল্লাল হোসেন বলেন, “শাহজাহানকে টাকা দিয়ে আমরা ২০টি পরিবার তেত্যুইয়া মুড়া দখলস্বত্ব কিনেছি। টাকার অভাবে আটটি পরিবার এখনো ঘর করেনি। শাহজাহান নিজের খতিয়ান দিয়ে আমাদের বিদ্যুতের মিটারও নামিয়ে দিয়েছেন। ঘর করার কয়েকবছর পর মাহবুব আলম নামের একজন এখান থেকে চলে গেছেন।
“তার ঘরটিসহ সেখানকার অন্য একটি পাহাড়ি জমি একজন প্রবাসীর কাছে দখলস্বত্ব বিক্রি করেছেন শাহজাহান। শুনতেছি তিনি আমাদেরকে উচ্ছেদ করে ওই প্রবাসীর কাছে আমাদের বসতির জমিগুলো বেশি দামে বিক্রি করবেন।
বিল্লাল বলেন, “এ ঘটনায় ভুক্তভোগী ১৯টি পরিবারের পক্ষে আমি ৩ অক্টোবর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কাছে লিখিত অভিযোগ করেছি। প্রয়োজনে আদালতে মামলা করবো। আমরা ন্যায়বিচার চাই।”
স্থানীয় বিজয়পুর ইউনিয়ন পরিষদের ২ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য জামাল হোসেন বলেন, “আওয়ামী লীগ নেতা শাহজাহান ভূমিহীন ওই পরিবারগুলোকে টাকার বিনিময়ে পাহাড়ের দখলস্বত্ব দিয়েছেন। এখন কী নিয়ে সমস্যা সেটা জানি না।”
তবে আওয়ামী লীগ নেতা শাহজাহান এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, “বনবিভাগের জায়গায় তারা কয়েক দশক ধরে দখল করে বসবাস করছে- এখানে আমার কী? আমি তাদের কাছে বসতি বিক্রি করেছি- এমন একটা লিখিত প্রমাণ দেখাতে বলেন।
“আমি এসবের বিষয়ে কিছুই জানি না। আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার ও ষড়যন্ত্র করছে তাঁরা।”
এ প্রসঙ্গে জানতে সদর দক্ষিণ চাইলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রুবাইয়া খানম বলেন, “শাহজাহান নামের ওই আওয়ামী লীগের নেতা মুখে মুখে ওই পরিবারগুলোর কাছে বনবিভাগের জমি বিক্রি করেছেন বলে অভিযোগ পেয়েছি। শাহজাহান তাদের বিদ্যুতের মিটারের ব্যবস্থাও করে দিয়েছেন।
“আমি অভিযোগকারীদেরকে শাহজাহানের বিরুদ্ধে থানায় গিয়ে নিয়মিত মামলা দায়েরের পরামর্শ দিয়েছি।”