সুন্দরবনে মূলত মায়া ও চিত্রা নামের দুই প্রজাতির হরিণের দেখা যায়। এরমধ্যে চিত্রা হরিণের সংখ্যাই বেশি।
Published : 15 Feb 2025, 01:58 AM
হরিণ লাজুক প্রাণী, দূর থেকে মানুষের শব্দ পেলেই ঘন বনে লুকোবার চেষ্টা করে তারা। তবু সুন্দরবন ঘুরতে যাওয়া পর্যটকরা এখন নিয়মিতই হরিণের দেখা পাচ্ছেন। বনের বাঁকে বাঁকে, খাল বা নদীর ধারে হরহামেশা চোখে পড়ছে দলবেঁধে হরিণের চলাফেরার দৃশ্য।
পৃথিবীর সবচেয়ে বড় এই ম্যানগ্রোভ ফরেস্টের দর্শনার্থী এবং বনসংলগ্ন এলাকার বাসিন্দারা বলছেন, সাম্প্রতিক সময়ে বনে হরিণের সংখ্যা বেড়েছে। বেশ কিছু পর্যটন স্পটে বা বন বিভাগের কার্যালয়ে দিনরাত সব সময়ই বন্য হরিণের দলকে ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়।
তবে হরিণের উপস্থিতি বেড়েছে বলে ভাবার কারণ নেই যে, সুন্দরবনের চোরাশিকারীদের হরিণ শিকার বন্ধ হয়ে গেছে। বরং শীত শুরু হওয়ার পর থেকে শিকারিদের দৌরাত্ম্য বেড়ে গেছে।
সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকার বাসিন্দারা বলছেন, গরু ও খাসির মাংসের তুলনায় হরিণের মাংসের দাম কম হওয়ায় এলাকায় এই বন্যপ্রাণীর মাংসের চাহিদা বাড়ছে। এ সুযোগে বেপরোয়া হয়ে উঠছে চোরাশিকারির চক্র।
সম্প্রতি বনের আশপাশে বিভিন্ন এলাকা থেকে হরিণের মাংস-চামড়াসহ আটক হয়েছেন বেশ কয়েকজন।
খুলনার সুন্দরবন অ্যাকাডেমির নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক আনোয়ারুল কাদির বলেন, “যে পরিমাণ হরিণের মাংস ও চামড়া আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে আটক হয়, তার থেকে কয়েকগুণ বেশি পরিমাণ হরিণ শিকার করা হয়।”
খুলনা অঞ্চলের প্রধান বন সংরক্ষক মিহির কুমার দো অবশ্য বলছেন, “বিচ্ছিন্ন কিছু শিকারের ঘটনা ঘটলেও সেটা আগের চেয়ে তুলনামূলক অনেক কম।”
তিনি বলেন, “কয়েক বছরে বনের জীববৈচিত্র্যে পরিবর্তন এসেছে। এখন সুন্দরবনে গেলেই হরিণ দেখা যাচ্ছে, যা আগে ছিল না। হরিণের সঙ্গে বাঘও দেখতে পাচ্ছেন সুন্দরবন দর্শনার্থীরা।”
১৯ বছরে হরিণ বেড়েছে ৫৩ হাজার ৬০৪টি
সুন্দরবনে মূলত মায়া ও চিত্রা নামের দুই প্রজাতির হরিণের দেখা যায়। এরমধ্যে চিত্রা হরিণের সংখ্যাই বেশি।
২০২৩ সালের ডিসেম্বর মাসে ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর দ্য কনজারভেশন অব নেচারের (আইইউসিএন) জরিপের তথ্য অনুযায়ী, সুন্দরবনে এক লাখ ৩৬ হাজার ৬০৪টি হরিণ রয়েছে। এর আগে ২০০৪ সালে হরিণের সংখ্যা ছিল ৮৩ হাজারটি। সেই হিসেবে ১৯ বছরে সুন্দরবনে হরিণ বেড়েছে ৫৩ হাজার ৬০৪টি।
হরিণের সংখ্যা বাড়ার কারণ হিসেবে মিহির কুমার দো বলেন, বনে সারা বছরই দস্যুরা এবং বছরের শেষের দিকে দুবলারচরে রাসমেলায় দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ৫০ হাজারের বেশি মানুষ আসত। ওই সময় বিপুল পরিমাণ হরিণ শিকার করা হত। অল্প লোকবল দিয়ে এত মানুষের নিরাপত্তা দেওয়া সম্ভব হত না।
“এখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও বন বিভাগের নিয়মিত টহল এবং বনে দস্যু কমার পাশাপাশি রাসমেলা বন্ধ হওয়ার কারণে হরিণ শিকার আগের তুলনায় অনেকাংশে কমেছে।”
তিনি বলেন, শিকারিদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানের কারণেই মাংসসহ হরিণ শিকারি ধরা পড়ছে। সুন্দরবনের বন্যপ্রাণী রক্ষায় অপরাধে জড়িতদের তথ্য প্রদানকারীকে সরকার পুরস্কার দেয়। ফলে এখন চোরাশিকারিদের ব্যাপারে সাধারণ মানুষ তথ্য দিতে উৎসাহিত হচ্ছে।
হরিণের ক্ষেত্রে বনের ভেতরে অপরাধ উদঘাটনের তথ্য দিলে ২০ হাজার টাকা এবং বনের বাইরে ১০ হাজার টাকা পুরস্কারের ঘোষণা দেওয়া আছে।
সক্রিয় ৩০টির বেশি চোরাশিকারি চক্র
খুলনার সর্বদক্ষিণের সমুদ্র উপকূলবর্তী উপজেলা কয়রা। তিন দিকে কপোতাক্ষ, কয়রা এবং শাকবাড়িয়া নদীতে ঘেরা উপজেলাটির সাতটি ইউনিয়নই সুন্দরবনের সীমানায় অবস্থিত। উপজেলার গ্রামগুলোতে বেশিরভাগই শ্রমজীবী মানুষের বসবাস আর প্রতিটি পরিবারের কেউ না কেউ সুন্দরবনকেন্দ্রিক কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত।
এ উপজেলার স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, উপজেলার ৩০টির বেশি চোরাশিকারি চক্র নির্বিচারে সুন্দরবনের হরিণ নিধন করছে। এর মধ্যে দক্ষিণ বেদকাশি ইউনিয়নের আংটিহারা ও জোড়শিং এলাকায় হরিণ শিকারি চক্রের আধিপত্য বেশি। আর হরিণ পাচারের নিরাপদ রুট হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে বজবজা ও খাসিটানা বন টহল ফাঁড়ি এলাকা।
এ ছাড়া মহেশ্বরীপুর ইউনিয়নের নয়ানি, হড্ডা, বানিয়াখালী, শেখেরকোনা ও তেঁতুলতলার চর; কয়রা সদর ইউনিয়নের ৪ নম্বর, ৫ নম্বর ও ৬ নম্বর কয়রা; উত্তর বেদকাশী ইউনিয়নের পাথরখালী, কাটকাটা; মহারাজপুর ইউনিয়নের পূর্ব মঠবাড়ি, মঠেরকোনা গ্রাম হরিণশিকারি চক্রের তৎপরতা রয়েছে।
উপজেলার দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়নের বাসিন্দা হাবি সরদার বলেন, একটি ছোট নদী পেরোলেই সুন্দরবনের গহিন জঙ্গল। শিকারিরা গোপনে সুন্দরবনে ঢুকে নাইলনের দড়ির ফাঁদ পেতে রাখেন। চলাচলের সময় হরিণ সেই ফাঁদে আটকে যায়। তারপর বনরক্ষীদের চোখ ফাঁকি দিয়ে হরিণের মাংস বিক্রি করা হয়।
সুন্দরবন সংলগ্ন খুলনার দাকোপ উপজেলার নলিয়ান গ্রামের বাসিন্দা ও স্থানীয় সংবাদকর্মী মো. আবুল বাশার বলেন, রামনগর, বানীশান্তা, সুতারখালী ও কালাবগি গ্রামের চিহ্নিত হরিণ শিকারিরা বেপরোয়া হয়ে নিয়মিত হরিণ শিকার করেই চলছে। নদীর জোয়ারে রাতে এবং দিনে ২০ থেকে ২৫ জন দলবদ্ধভাবে সুন্দরবনে প্রবেশ করে হরিণ শিকার করছে।
এ ছাড়া মোংলার চিলা, জয়মনি, বৈদ্যমারী, কাটাখাল কুল, বাঁশতলা, কাটাখালী; মোরেলগঞ্জের জিউধরা, গুলিশাখালী, সন্ন্যাসী; শরণখোলার ধানসাগর, তাফালবাড়ী, সোনাতলা, পানিরঘাট, রাজাপুর, রসুলপুর, চালিতাবুনিয়া,; সাতক্ষীরার শ্যামনগরের বেশ কিছু গ্রামে হরিণ শিকারিদের তৎপরতা রয়েছে।
৫০০-৬০০ টাকায় মেলে হরিণের মাংস
সুন্দরবন ঘেঁষা মহেশ্বরীপুর ইউনিয়নের কয়েকজন বাসিন্দা জানান, স্থানীয় পদ্ধতিতে মাংস, চামড়া, মাথাসহ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংরক্ষণ করে পাচার করে চোরাশিকারিরা। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ থাকে এজেন্ট-ব্যবসায়ীদের। এই এজেন্টদের মাধ্যমে কখনো অগ্রিম অর্ডার, আবার কখনো মাংস এনে তারপর বিক্রি করা হয়। এই চক্রের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন স্থানে পৌঁছে যায় হরিণের মাংস।
অবৈধ জেনেও হরিণের মাংস কেনেন অনেক মানুষ। সুন্দরবনসংলগ্ন এলাকায় প্রতি কেজি হরিণের মাংস ৫০০ থেকে ৬০০ টাকায় পাওয়া যায়। তবে জেলা শহরে প্রতি কেজি হরিণের মাংসের দাম ১০০০ টাকা থেকে ২০০০ টাকা পর্যন্ত। আর জীবিত হরিণের দাম চাওয়া হয় ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা।
তারা জানান, ক্রেতারাও অনেক সময় প্রতারণা ভেবে হরিণ নিজ চোখে না দেখে মাংস কিনতে চান না। তাই চোরাশিকারিরা জীবন্ত হরিণ লোকালয়ে এনে জবাই করেন।
মূল শিকারি ও পাচারকারীরা আটক হয় না
খুলনার সুন্দরবন অ্যাকাডেমির নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক আনোয়ারুল কাদির বলেন, “বন্যপ্রাণী শিকার নিষিদ্ধ হলেও আইন অমান্য করে সুন্দরবনের প্রধান আকর্ষণ চিত্রা হরিণ শিকার করছে কয়েকটি চক্র। সাম্প্রতিক সময়ে সুন্দরবনে বাঘ হত্যা কিছুটা কমলেও একেবারে বন্ধ হয়নি। আর বাঘের প্রধান খাবার হরিণ শিকার হচ্ছে প্রায়ই।”
“মাঝেমধ্যে দুই একটি অভিযানে হরিণের মাংস, চামড়া, মাথা উদ্ধার হলেও মূল চোরাশিকারি ও পাচারকারীরা আটক হয় না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে হরিণের মাংস বহনকারীরাই ধরা পড়ে। আর যারা আটক হন, তারা দুর্বল আইনের কারণে কয়েকদিন পর জেল থেকে ফিরে একই কাজে লিপ্ত হন।”
জানুয়ারির শেষ দিকে ১১ কেজি হরিণের মাংসসহ ছয় জনকে আটক করে কোস্ট গার্ড।
গোপন সংবাদের ভিত্তিতে মোংলা থেকে ঢাকাগামী একটি মাইক্রোবাসে তল্লাশি চালিয়ে মোংলার ফেরিঘাট সংলগ্ন এলাকা থেকে তাদের আটক করা হয় বলে জানান কোস্ট গার্ড পশ্চিম জোনের মিডিয়া কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট মুসফিক উস সালেহীন।
এর আগে ৩ জানুয়ারি কয়রা উপজেলার কালনা বাজার এলাকায় প্রায় ৩০ কেজি হরিণের মাংসসহ ইকবাল মোড়ল নামে এক তরুণকে আটক করে পুলিশে দিয়েছে স্থানীয় লোকজন।
২৩ বছর বয়সী ইকবাল পাইকগাছা উপজেলার কপিলমুনি ইউনিয়নের বাসিন্দা।
কয়রা থানার ওসি জি এম ইমদাদুল হক বলেন, জিজ্ঞাসাবাদে ইকবাল বলেছেন, কয়রার সুন্দরবন-সংলগ্ন এলাকা থেকে পূর্ব পরিচিত হরিণ শিকারি মনিরুল ইসলাম তাকে এ মাংস দিয়েছেন। ৩০ কেজি হরিণের মাংস নিতে মনিরুলকে ২ হাজার ৪০০ টাকা দিয়েছেন ইকবাল।
সাম্প্রতিক সময়ে সুন্দরবনে হরিণ শিকারিদের দৌরাত্ম্যের বিষয়ে বন সংরক্ষক মিহির কুমার দো বলেন, মূলত শুষ্ক মৌসুমে সুন্দরবনের ভেতরে খাল ও নদীতে পানি শুকিয়ে যাওয়ায় হরিণের বিচরণ বেড়ে যায়। যে কারণে চোরাশিকারিরা এ সময় তৎপর হয়।
“তবে বিচ্ছিন্ন কিছু শিকারের ঘটনা ঘটলেও সেটা আগের চেয়ে তুলনামূলক অনেক কম। অল্প জনবল দিয়ে এত বড় বনে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করতে হিমশিম খেতে হয় বনবিভাগের।”