হাওরে ‘দাওয়ামারির’ ধুম, ‘ইবার বছর বালা’

আবহাওয়ার খারাপ পূর্বাভাস থাকায় দ্রুত ধান কাটছেন কৃষক।

শামস শামিমসুনামগঞ্জ প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 22 April 2023, 07:25 PM
Updated : 22 April 2023, 07:25 PM

বছরের একমাত্র ফসল ঘরে তুলতে হাওরে শুরু হয়ে গেছে ‘দাওয়ামারি’। দিন-রাত এক করে কৃষক-কৃষাণি মগ্ন হয়ে আছে বোরো ধান কাটা, রোদে শুকানো আর সিদ্ধ করে গোলায় তোলার কাজে। এমন ব্যস্ততার মধ্যেই এবার তাদের ঈদ, ঘরে ঘরে আনন্দ-উৎসব।

পূর্বাঞ্চলের সবচেয়ে বড় এই জলভাণ্ডারের নীচু জমি দেশের খাদ্যশস্যের বড় জোগানদারও। এক ফসলি এই জমির দিকে সারা বছর তাকিয়ে থাকে হাওর অধ্যুষিত সাত জেলার কৃষক। তবে সবচেয়ে বেশি ধান হয় নেত্রকোণা ও সুনামগঞ্জ উপজেলায়।

সুনামগঞ্জ জেলার দেশি আগাম ধান কাটা হয়েছে মধ্য চৈত্র থেকে বৈশাখ শুরুর আগেই। বৈশাখের প্রথম দিন থেকে কাটা শুরু হয়েছে হাওরে মূল ফসল বোরো ধান। এরই মধ্যে কোথায় অর্ধেক, কোথায় ৪০ ভাগ, কোথায় বা ৩০ ধান কাটা হয়ে গেছে।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানিয়েছে, গড়ে প্রায় ৩৯ শতাংশ জমির ধান কাটা হয়ে গেছে। চলতি বছর ১ হাজার কম্বাইন হার্ভেস্টার, স্থানীয় ও অন্যান্য জেলা থেকে আসা প্রায় তিন লাখ কৃষি শ্রমিক নিয়ে এখন হাওরে ধান কাটার ধুম পড়েছে।

আবহাওয়ার খারাপ পূর্বাভাস থাকায় দ্রুত ধান কাটছেন কৃষকরা।

সুনামগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে জানা গেছে, জেলায় চলতি বছর দুই লাখ ২২ হাজার ৭৯৫ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হয়েছে। এর মধ্যে শুক্রবার পর্যন্ত পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ধান কাটা হয়েছে ৮৭ হাজার ৫৪১ হেক্টর।

হাওরে কাটা হয়েছে ৮৩ হাজার ৮৪৫ হেক্টর এবং হাওরের বাইরে কাটা তিন হাজার ৬৯৫.০৯ হেক্টর জমির ধান।

হাওরে গড়ে ধান কাটা হয়েছে ৫০.৮ ভাগ এবং হাওরের বাইরে ৬.৪ ভাগ। এরই মধ্যে যে ধান কাটা হয়েছে তা থেকে তিন লাখ ৫১ হাজার মেট্রিক টন চাল উৎপাদিত হবে বলে জানিয়েছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর।

দেশের খাদ্যশস্যের একটি বড় জোগান আসে হাওর থেকে। এ জমির পুরোটাই এক ফসলি। এই ফসলের ওপর নির্ভর করেই হাওরের কৃষক সারা বছরের খাওয়া-পরা, ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া, সামাজিক অনুষ্ঠানাদি সবকিছু চালায়।

তাই ফসল কাটার সময় হলে পরিবারের বাইরে থাকা সদস্যরাও বাড়ি ফিরে আসেন। দিনে ধান কাটা, শুকানো আর রাতভর উঠানে গৃহিণীরা ধান সিদ্ধ করেন। বাড়িভর্তি থাকে ‘ভাগালো’তে (বাইরে থেকে আসা শ্রমিক)। বলা হয়ে থাকে, ধান কাটা বা ‘দাওয়ামারি’র এই সময়ে হাওর ঘুমায় না।

হাওরের বোরো ধান রক্ষায় রয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বিস্তৃত ফসল রক্ষা বাঁধ। ভারী বৃষ্টি আর উজান থেকে আসা ঢলে এ বাঁধ তলিয়ে গেলে ক্ষেতে পানি ঢোকে যায়; তখন মানুষের দুর্দশার সীমা-পরিসীমা থাকে না।

গত বছর আগাম ঢলে হাওরের ফসলের কিছু ক্ষতি হয়েছিল কৃষকের। তাই বাঁধ নিয়ে শঙ্কা বোরো ফসল গোলায় না তোলা পর্যন্ত কাটে না কৃষকের। যদিও কৃষকরা বলছেন, এবার সেই ধরনের কিছুর আশঙ্কা করছেন না তারা।

তাহিরপুর উপজেলার মাটিয়ান হাওরের পাটাবুকা গ্রামের কৃষক মারুফ মিয়া বলেন, “ইবার বছর বালা দিছে। বিআর-২৮ ধান কিছু মাইর গ্যাছে। তার বাদেও আউরের হকল ধান তুলতাম পারলে ঋণ-ফিন মাইরা হারা বছর ঘরের খাইতাম পারমু।”

একই গ্রামের কৃষক আবুল আজাদ বলেন, “একটা ফসিল গেলে তিনটাত মাইর ফরে। ই ফসলের ক্ষতি ওঠাইতে তিন ফসিল লাগে। কিষক ঋণের জালে জড়াই যায়। ইবার দেখা যায়, বছর বালা। আল্লায় দিলে দিন বালা তাকলে আর সব ধান কাটতা পারলে দেনা মিটাইতাম পারমু। আমরার কোনো জমানোর দরহার নাই। কোনওমতে বাল-বাচ্চারে লইয়া হারা বছর ঘরের খাইতে পারলেই হইল।”

Also Read: উজানে বর্ষণের আভাস, সুনামগঞ্জের হাওরে ধান কাটতে মাইকিং

Also Read: হাওরে ধান কাটায় তিন মন্ত্রী, ২৩ এপ্রিল ‘ঢলের’ শঙ্কা

শনির হাওরের শাহগঞ্জ গ্রামের কৃষক সোহেল মিয়া বলেন, “সব কিছুর দাম বাড়ছে। ধানের দাম বাড়ানো দরকার। আমরা অনেক বেশি মূল্যে বীজ, সার, ডিজেল, কীটনাশক এনে জমি চাষ করেছি। এতে উৎপাদন খরচ বেড়েছে। এই তুলনায় বাজারে ধানের দাম কম। তবে আমাদের হাওরে এবার ফসল মোটামুটি ভাল হয়েছে। এই ফসল নিয়ে আমরা সন্তুষ্ট।”

হাওরে কৃষক পর্যায়ে নতুন ধানের দাম ৯০০ টাকা থেকে এক হাজার টাকা। দাম নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন কৃষকরা।

শাল্লা উপজেলার চাকুয়া গ্রামের কৃষক প্রীতম দাস বলেন, “হাওরের কৃষকের হাত এখন খালি। তাই সংসার চালাতে সস্তায় ধান বিক্রি করছে তারা। আমাদের এলাকায় ৯০০ টাকায় ধান বিক্রি হচ্ছে।”

ধর্মপাশা উপজেলার সুখাইর রাজাপুর উত্তর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ও এলাকার বড় কৃষক আমানুর রাজা চৌধুরী বলেন, “চৈত্র মাস থেকেই কৃষক অভাবে থাকে। তাই সংসারের চাহিদা মিটাতে আগাম বাজারের মূল্যের চেয়ে কম দামে ধান বিক্রি করে দেন তারা।

“এবার ভালো ফলন হলেও দাম কম। মাত্র ৯০০-১০০০ হাজার টাকায় ধান বিক্রি করছেন কৃষক। এতে ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন কৃষকরা।”

কৃষি বিভাগ জানায়, চলতি বছর জেলায় ১৪২টি ছোট-বড় হাওরে প্রায় চার লাখ চাষি বোরো আবাদ করেছেন। ঠিকমত সংগ্রহ করতে পারলে সে ধান থেকে প্রায় নয় লাখ মেট্রিক টন চাল উৎপাদিত হবে।

এ ছাড়া আউশ, আমন থেকে জেলায় আরও প্রায় আড়াই লাখ মেট্রিক টন চাল উৎপাদিত হয়।

জেলায় ছয় লাখ মেট্রিক টন খাদ্য চাহিদা পূরণ করে আরও প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ টন উদ্বৃত্ত রাখেন কৃষকরা।

এবার হাওরে উৎপাদিত ফসলের মূল্য প্রায় তিন হাজার ৮০০ কোটি টাকা বলে জানিয়েছে কৃষি বিভাগ।

সুনামগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক বিমল চন্দ্র সোম বলেন, “আমাদের জেলায় হাওরে ৫০ ভাগের বেশি ধান কাটা হয়েছে।

ধর্মপাশা ও শাল্লা উপজেলায় প্রায় ৭০ ভাগের কাছাকাছি ধান কাটা শেষ। আবহাওয়া ভালো থাকলে আগামী ১০ দিনে ৯০ ভাগ জমির ধান কাটা শেষ করা যাবে।”

ধান কাটা শ্রমিকের সংকট নেই জানিয়ে তিনি বলেন, “জেলায় এক হাজার হার্ভেস্টার যন্ত্রে ধান কাটছে। স্থানীয় কৃষি শ্রমিক আছেন তিন লাখের কাছাকাছি। এ ছাড়া সিরাজগঞ্জ, পাবনা, বরিশাল, সিলেট, হবিগঞ্জ, ময়মনসিংহ ও কিশোরগঞ্জসহ বিভিন্ন জেলা থেকে এবার প্রায় ১১ হাজার শ্রমিক সুনামগঞ্জে ধান কাটতে এসেছেন।”

এদিকে, বৃহস্পতিবার রাতে সুনামগঞ্জে প্রায় আধা ঘণ্টা ধরে মাঝারি বৃষ্টি হয়েছে। কয়েকটি উপজেলায় সামান্য শিলাবৃষ্টিও হয়েছে। সঙ্গে ছিল দমকা হাওয়া। শুক্রবার সকাল থেকে হাওরে দমকা হাওয়া বইছে। আকাশে দেখা যাচ্ছে মেঘের ওড়াউড়ি।

আবহাওয়া কার্যালয়ের পূর্বাভাস অনুযায়ী, আগামী রোববার থেকে মেঘালয়ে টানা বৃষ্টিপাত হতে পারে। এতে হাওরের বোরো ফসল হুমকির মুখে পড়ার আশঙ্কা থেকে মাইকিং করে কৃষকদের দ্রুত ধান কাটার আহ্বান জানাচ্ছে প্রশাসন।

সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক দিদারে আলম মোহাম্মদ মাকসুদ চৌধুরী বলেন, “এখন হাওরে ধান কাটার ধুম চলছে। শ্রমিক সংকট নেই। বৃহস্পতিবার সামান্য শিলা বৃষ্টি হলেও এতে কোনো ক্ষয়-ক্ষতি হয়নি।”

তিনি আরও বলেন, “আমরা প্রতিনিয়ত হাওরের খবর রাখছি। প্রাকৃতিক দুর্যোগে বাঁধগুলো যেন আপৎকালে ঝুঁকি মোকাবিলা করতে পারে সেজন্য প্রতিটি প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটিকে সতর্ক রাখা হয়েছে।”