“বাংলাদেশের অন্যান্য হস্তশিল্পের মতই এ শিল্পের শিল্পীরা দরিদ্র ও অবহেলিত। সরকারের এ শিল্পের দিকে একটু নজর দেওয়া উচিত।”
Published : 24 May 2024, 12:25 PM
গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্যের সঙ্গে জড়িয়ে আছে শীতলপাটির নাম। গ্রীষ্মের হাঁফ উঠা দুপুরে বাড়ির উঠানে বা পাশের বাগানে শীতলপাটি বিছিয়ে একটু পিঠ এলিয়ে জিরিয়ে নিতে কে-না পছন্দ করে?
প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে শুরু করে শহরের সৌখিন মানুষ; সবার কাছেই শীতলপাটির বেশ কদর রয়েছে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে মানুষের চাহিদার ধরন বদলে যাওয়ায় শীতলপাটির জৌলুস কমেছে। সে জায়গা দখল করেছে প্লাস্টিকের পাটি আর রেক্সিনের মাদুর।
পাশাপাশি শীতলপাটি তৈরির কাঁচামালের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে এ ঐতিহ্যবাহী হস্তশিল্প এখন বিলুপ্তির পথে। ফলে এ শিল্পের সঙ্গে জড়িতরা দুর্দিন পার করছেন।
এমন চিত্র দেখা গেছে টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার উপজেলায়। শীতলপাটির জন্য বিখ্যাত এ উপজেলার কারিগরদের পূর্ব-পুরুষের পেশা এখন হুমকির মুখে পড়েছে।
এজন্য পর্যাপ্ত পুঁজি ও বেতের অভাব, প্লাস্টিকের দ্রব্যের আধিক্য এবং সুষ্ঠু বাজার ব্যবস্থাপনা না থাকাসহ বিভিন্ন সমস্যাকে দায়ী করছেন পাটি তৈরির শিল্পীরা। দেলদুয়ারের হিঙ্গানগর, গজিয়াবাড়ি, আটিয়া ও নাল্লাপাড়ায় মূলত শীতলপাটি তৈরি হয়।
গ্রামগুলো ঘুরে দেখা গেছে, বাড়িতে বাড়িতে কেউ পাটি বুনছেন; কেউ বেত কাটছেন; আবার অনেকে তা বাজারে নেওয়ার ব্যবস্থা করছেন। পাটি বুনন কাজে এ উপজেলার চার থেকে পাঁচশ পরিবার যুক্ত রয়েছে বলে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে।
হিঙ্গানগর গ্রামের রামকুমার নন্দীর ছেলে পৌষ নন্দী বংশগতভাবে শীতলপাটি তৈরির পেশায় আসেন। ছোটবেলা থেকে বাপ-দাদা ও পূর্ব পুরুষদের এ কাজ করতে দেখে আসা পৌষের নিজের এ পেশায় ৪০ বছর গড়িয়েছে।
৫৫ বছর বয়সী শীতলপাটির এ কারিগর বলছিলেন, “আমরা সবাই এ পেশার ওপর নির্ভরশীল; কাকারাও এ পেশায় জড়িত। সপ্তাহে শুক্র ও শনিবার হিঙ্গানগর গ্রামে কামনায় পাটির হাট বসে। বিভিন্ন স্থান থেকে পাইকাররা এসে এখান থেকে পাটি কেনেন। আমরা হাটে পাইকারি ও খুচরা বিক্রি করি।”
পরের প্রজন্ম এ পেশায় আসতে চায় কি-না জানতে চাইলে দুই সন্তানের জনক বলেন, “আমার এক ছেলে পড়ালেখা শেষ করে চাকরি করছে। আর অন্য ছেলে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করছে। ছেলেরা এ পেশায় আসবে না।”
কীভাবে শীতলপাটি তৈরি হয়? জানতে চাইলে কারিগররা জানান, প্রথমে জঙ্গল থেকে মোরতা গাছ কেটে ছাঁটা হয়। তারপর প্রতিটি মোরতা বটি বা ছুরি দিয়ে লম্বালম্বি তিন ভাগে কেটে বেত তৈরি করে ভাতের মাড়ে ভিজিয়ে রাখা হয়।
এরপর ভাতের মাড় ও পানির মিশ্রণে সেগুলো সেদ্ধ করা হয়। সেদ্ধ বেত পরিষ্কার পানি দিয়ে ধুয়ে রোদে শুকিয়ে শুরু হয় পাটি বোনার কাজ। মোরতার উপরিভাগ দিয়ে বানানো হয় মসৃণ এ শীতল পাটি।
এরপর বুনন কৌশল ও দক্ষতায় পাটিতে ফুটিয়ে তোলা হয় নকশা। জীবজন্তু, ফুল, লতাপাতা, নৌকা ও পালকিসহ বিভিন্ন ছবি ফুটিয়ে তোলা হয় শীতলপাটির বুননে।
কারিগরদের অনেকেই বলছেন, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পাটির দাম বাড়েনি। এ কারণে এ শিল্পের সঙ্গে জড়িতদের সমস্যায় পড়তে হয়েছে।
পর্যাপ্ত ঋণের সুবিধা পেলে এবং সুষ্ঠু বাজার ব্যবস্থা সৃষ্টি হলে এখানকার শীতল পাটি দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানি করা সম্ভব হবে।
হিঙ্গানগর গ্রামের কালী নন্দীর ছেলে ৬২ বছর বয়সী খুশী নন্দী বলছিলেন, “শীতল পাটি তৈরির কারিগর দিন দিন কমে যাচ্ছে। আগে পাটির উপকরণ মোরতা কিনতে সাধারণত টাকা লাগত না। এগুলো আগাছার মতো যেখানে সেখানে জন্মাত। কারিগররা সেগুলো সংগ্রহ করে পাটি বুনতেন।
“শুধু সময় ও পরিশ্রমের দাম হিসেবে এগুলোর মূল্য নির্ধারণ হতো। কিন্তু বর্তমান সময়ে মোরতা কিনে নিতে হচ্ছে। কারণ মোরতা ক্রমশ কমে যাচ্ছে।”
কালিহাতী উপজেলার আউলটিয়া গ্রামের জ্যোতি চন্দ্র দাসের মেয়ে শিল্পী নন্দীর বিয়ে হয়েছে হিঙ্গানগর গ্রামের উজ্জ্বল নন্দীর সঙ্গে। তিনি ছোটবেলায় বাবার কাছ থেকে পাটি তৈরি শিখেছেন; এখন সিদ্ধহস্ত। শ্বশুরবাড়িতে এসেও পাটি তৈরি করছেন।
শিল্পী নন্দী বলেন, “নকশা করা শীতলপাটির অন্যরকম চাহিদা আছে, তাই রঙ করে মোরতা শুকিয়ে বিভিন্ন নকশা করে পাটি বানালে তা দেখতে সুন্দর এবং মানে ভালো হয়। এগুলোর দামও বেশি।
“বর্তমানে ৫ থেকে ৭ ফুটের একটি শীতলপাটি আড়াই থেকে ৪ হাজার টাকায় বিক্রি হয়। এ ছাড়া ছোট আকারের পাটি হাজার টাকায় পাওয়া যায়।”
প্রতিটি পাটি তৈরি করতে দুদিন সময় লাগে জানিয়ে শিল্পী বলছিলেন, প্রায় ২০ বছর ধরে এ পাটি তৈরি করছেন। যে পরিমাণ পরিশ্রম তিনি করেন, সে পরিমাণ মজুরি পান না।
মোরতা গাছ বা বেত বাগানের মালিক সুদাম চন্দ্র দে বলেন, একটা বেতগাছ বড় হতে তিন বছর লাগে। বেত পরিপূর্ণ হলে কাটার পর সেখানে আবারও ছোট বেতের চারা লাগান। এভাবে তিনি পাটি তৈরির ব্যবসায় নিজেকে জড়িয়ে রেখেছেন। নিজেও শীতলপাটি তৈরি করেন।
শীতলপাটি শিল্পটি এখন মহাজনের ওপর নির্ভরশীল বলে কারিগর মৃত্তিকা রানী নন্দীর ভাষ্য। মহাজনেরা মোরতা জঙ্গল ইজারা নেয় এবং অনেক বেশি দামে কারিগরদের কাছে বিক্রি করেন। অনেক সময় দাদনও দিয়ে থাকেন।
মৃত্তিকা বলেন, “বাংলাদেশের অন্যান্য হস্তশিল্পের মতোই এ শিল্পের শিল্পীরা দরিদ্র ও অবহেলিত। সরকারের এ শিল্পের দিকে একটু নজর দেওয়া উচিত। এ ব্যাপারে সরকারের এগিয়ে আসা উচিত।”
কালিহাতীর পাটির পাইকারি আড়তের মহাজন জ্যোতি চন্দ্র দাস বলেন, বর্তমানে গ্রাম কিংবা শহরে আগের মতো শীতলপাটির চাহিদা নেই। প্লাস্টিকের ম্যাট, বৈদ্যুতিক পাখা কিংবা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্রের যুগে শীতলপাটির চাহিদা একটু কমবেই; এটা মেনে নিতেই হবে।
তারপরও শীতল পাটি তৈরি থেমে থাকবে না আশা প্রকাশ করে তিনি বলেন, একটি শীতলপাটি তৈরি করতে কারিগরদের ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা মজুরি দিতে হয়। এ ছাড়া পাটি তৈরিতে বেতকেনাসহ বিভিন্ন খরচ রয়েছে।
পাটি বাজারজাতকরণের সুষ্ঠু ব্যবস্থা না থাকায় বাণিজ্যিক ব্যাংক ও বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা থেকে ঋণ পাওয়া খুবই কঠিন বলে জানান তিনি।
শীতলপাটির কারিগরদের সহায়তা প্রদানের কোনো পরিকল্পনা রয়েছে কি-না জানতে চাওয়া হয়েছিল দেলদুয়ার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইউএনও শাকিলা পারভীনের কাছে।
তিনি বলেন, “পাটি শিল্পীদের সমস্যা নির্ণয়ে কাজ করছি। এ শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে সমস্যা নির্ণয় করে সমাধানের চেষ্টা করব। প্রয়োজনে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি অবগত করে হলেও শিল্পীদের পাশে থেকে সহযোগিতা দেব।