ঘের ও পুকুর ভেসে যাওয়ায় মাছ ছড়িয়ে পড়েছে চারিদিকে। নদীতে খালি চোখেই দেখা যাচ্ছে মাছ ভেসে যাওয়ার দৃশ্য; তাই ফেনী নদীতে চলছে মাছ ধরার ‘উৎসব’।
Published : 30 Aug 2024, 12:18 PM
ফেনী সদরের ধলিয়া ইউনিয়নের বড় ধলিয়া গ্রামের বাসিন্দা গিয়াস উদ্দিন। দুই বন্ধু মিলে মুরগি আর মাছের খামার তৈরি করেছিলেন বছর কয়েক আগে। এবারের হড়কা বানে ভেসে গিয়ে অনেকটাই নিঃস্ব এখন তারা।
শুধু তারা নন, ফেনীর বিভিন্ন উপজেলার মাছ চাষিদের করুণ অবস্থা তাদের মতই।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে গিয়াস উদ্দিন বলেন, সোনাগাজী উপজেলার মুছাপুর এলাকায় ১০ একর আয়তনের তিনটি ও সদর উপজেলার বাড়ির কাছে তিন একরের তিনটি পুকুরে বিভিন্ন ধরনের মাছের চাষ করতেন তারা।
বানের পানিতে সবকিছু ভেসে গেছে। সব পুকুর তলিয়ে গিয়ে এখন মাছশূন্য।
গিয়াসের দাবি, বর্ষা মৌসুম শেষ হলেই পুকুরের মাছগুলো বিক্রি করার কথা ছিল। ছয়টি পুকুরে তাদের বিনিয়োগ আছে এক কোটি টাকার বেশি। কিন্তু স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় তারা এখন পথে বসেছেন।
গিয়াসের অংশীদার সাখাওয়াত হোসেন পিন্টু বললেন, প্রায় ২৮ বছর প্রবাস জীবন কাটিয়ে ২০২৩ সালে দেশে এসেছেন। তার চিন্তা ছিল আর বিদেশ না গিয়ে দেশে ব্যবসা করবেন।
“আমরা কখনও কল্পনাও করিনি। এভাবে বন্যার পানিতে আমাদের সব তলিয়ে যাবে। একটি পুকুরে আমরা ডিম থেকে পোনা তৈরি করি। সে পুকুরটির সব মাছ কিছু দিন আগে ১৭ লাখ টাকায় কিনতে চেয়েছিলেন অপর এক ব্যবসায়ী। আমরা বিক্রি করিনি। এখন সব শেষ।”
“এ বন্যা আমাদের একেবারে নিঃস্ব করে ফেলেছে। আমাদের ঘুরে দাঁড়ানোর অবস্থা নেই।”
ফেনী জেলা মৎস্য অফিসের হিসেবে, স্মরণকালের ভয়াবহ এ বন্যায় জেলার ১৮ হাজার ৭৬০টি মাছের পুকুর, দিঘি ও খামার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যেগুলোর মোট আয়তন দুই হাজার ২৭৮ দশমিক ৫৩ হেক্টর।
সব মিলিয়ে ফেনী জেলায় শুধু মৎস্য খাতে ৭৪ কোটি ৯৭ লাখ ৮১ হাজার টাকার ক্ষতি হয়েছে। যদিও মাছ চাষিদের মতে এর চেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে তাদের।
ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সবচেয়ে বেশি সোনাগাজী উপজেলায় চার হাজার ২৮০টি পুকুর, দিঘি ও খামার, যার আয়তন প্রায় ৫২০ হেক্টর।
চাষিদের ভাষ্য, মৎস্য অফিস থেকে বড় বড় পুকুর দিঘিগুলোর হিসাব করা হয়। কিন্তু নিজস্বভাবে বাড়ির কাছে যেসব পুকুরে মাছ চাষ করা হয় সেগুলোর হিসাবটা অনেকাংশে আসে না।
সোনাগাজীর মুহুরি প্রজেক্ট এলাকার মৎস্য খামারি মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মোতালেব। কয়েকজন মিলে প্রজেক্ট এলাকায় তারা একাধিক মাছের খামার তৈরি করেছেন।
মোতালেব বলেন, ”বন্যার কারণে বেশ কিছু খামারে মাছ ভেসে গেছে। সবমিলিয়ে আমাদের কোটি টাকার উপর লোকসান হতে পারে।”
নিজের ঘরও পানিতে তলিয়ে গেছে জানিয়ে মোতালেব বলেন, “মোবাইল সংযোগ না থাকায় অন্যান্য শেয়ারহোল্ডার ও খামারের দায়িত্বরত কর্মচারির সাথে এখনো যোগাযোগ করতে পারিনি। নিজের বসত ঘর নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছি।”
ফেনীর সদর উপজেলার রানীরহাট ইউনিয়নের কয়েকটি পুকুর নিয়ে ‘তৃপ্তি এগ্রো পার্ক’ গড়ে তুলেছেন দুই বন্ধু মো. নাজমুল হক ও রাজন দেবনাথ ।
রাজনের বলেন, বানের পানিতে তাদের পুকুরের অন্তত ৫ লাখ টাকার মাছ ভেসে গেছে।
“দোকান থেকে বকেয়া করে আমরা মাছের খাবার সংগ্রহ করি। বিক্রি করে টাকা পরিশোধ করি। দুই বন্ধুর স্বল্প পুঁজি নিয়ে মাছ চাষে নেমেছিলাম। এক বন্যায় সর্বস্ব হারিয়েছি।”
পরশুরাম উপজেলার বিসমিল্লাহ ফিশারিজের পরিচালক রফিকুল ইসলাম দাবি করেছেন, বানের পানিতে তার ৫০টি বেশি পুকুরের মাছ ভেসে গেছে । যেখানে তার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে প্রায় তিন কোটি টাকা।
তিনি বলেন, ডিএম সাহেবনগর, মির্জানগর, মেলাঘর এলাকায় তার মাছের খামারগুলো একেবারে ভেসে গেছে।
জেলা মৎস্য অফিসের হিসেব মতে, ফেনী সদরে তিন হাজার ২৭০টি, ছাগলনাইয়া উপজেলায় দুই হাজার ৮৭০টি, ফুলগাজীতে দুই হাজার ৫১০টি, পরশুরামে দুই হাজার ২৫০টি ও দাগনভূঞাতে তিন হাজার ৫৮০টি পকুর, দিঘি ও খামার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
মুহুরি প্রজেক্টে মাছ ধরার ‘উৎসব’
ফেনীর হ্যাচারি মালিকদের কথার সত্যতা মেলে সোনাগাজী উপজেলার ফেনী নদীর উপর নির্মিত ক্লোজার গেইট এলাকায় গিয়ে।
ফেনী নদীর উপর নির্মিত ক্লোজার গেইটটি সাধারণের কাছে ‘মুহুরি প্রজেক্ট’ নামে পরিচিত। নদীর এক প্রান্তে ফেনীর সোনাগাজী উপজেলা আর অন্য প্রান্তে চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার বারৈয়াহাট।
৪০টি রেগুলেটরের গেইট বন্ধ করে রেখে শুকনো মৌসুমের জন্য পানি আটকে রাখা হয় নদীতে। যে পানি দিয়ে শুকনো মৌসুমে চাষাবাদ হয় ফেনীতে।
নদীর দুই প্রান্তে ক্লোজার গেইট সংলগ্ন এলাকায় এখন চলছে মাছ ধরার উৎসব। ফেনীর সোনাগাজী উপজেলা ছাড়াও চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার বিভিন্ন স্থান থেকে সেখানে মাছ ধরতে যান বিভিন্ন বয়েসী লোকজন।
নদীতে খালি চোখেই দেখা যাচ্ছে মাছ ভেসে যাওয়ার দৃশ্য।
মুহুরি প্রজেক্টের গেইট অপারেটর নূর মোহাম্মদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, স্বাভাবিক সময়ে এ গেইটের পাশে মাছ পাওয়া যায় না। এখন নদীতে প্রচুর মাছ ভেসে আসছে। বন্যায় সব মাছের ঘের শেষ। মাছ চাষিরা পথে বসে গেছে। সব মাছ নদীতে ভেসে আসছে।
প্রতিদিন বিভিন্ন এলাকা থেকে জাল নিয়ে মাছ ধরতে আসে নদীতে। তারা প্রচুর মাছ পাচ্ছে, কাউকে মাছ ধরে বিক্রি করতে আবার কাউকে ঘরে নিয়ে যেতে দেখা যাচ্ছে।
মুহুরি প্রজেক্টে মাছ ধরতে গেছেন মো. মহিউদ্দিন। তিনি বলেন, ”যেভাবে মাছ ভেসে যাচ্ছে সবাই ধরতে আসছে। তাই আমিও বারৈয়াহাট থেকে এসেছি। প্রায় ১০ বছর জাল মারি না। এখন অনেকের সাথে আমিও আসছি জাল মারতে।”
সদ্য উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দেয়া রুবেল। কয়েক বন্ধু মিলে মিরসরাই থেকে মুহুরি প্রজেক্টে গেছেন মাছ ধরতে।
তিনি বলেন, ”এখন কোন কাজ নাই। তাই বন্ধুরা মিলে মাছ ধরতে আসলাম। জালে মাছ আসছে তাই ভালো লাগছে। আগে কখনও এভাবে মাছ ধরিনি নদীতে।”
জালের পাশাপাশি অনেককেই দেখা গেছে ঝুড়ি বানিয়ে মাছ ধরতে।
গেইটের পানি নামার স্থানে ঝুড়ি বসিয়ে রেখে তারা নিজেদের মত করে গল্প করছেন। স্রোতের পানিতে মাছ উঠছে ঝুঁড়িতে।