“টানা বৃষ্টিতে সড়কের বিভিন্ন অংশ ভাঙন দেখা দিয়েছে। কিছু এলাকায় গাছ উল্টে সড়কে বড় বড় গর্ত সৃষ্টি হয়েছে।”
Published : 10 Sep 2024, 02:40 PM
চাঁদপুরে বন্যা এবং অতিবৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা তৈরি হয়ে ছয় উপজেলায় সড়ক ও জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর জানিয়েছে, বন্যায় জেলায় ১৯২ সড়ক ও ৪৪টি কালভার্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ খাতে সম্ভাব্য ক্ষতি প্রায় ৪০ কোটি টাকা। তবে ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়তে পারে।
আর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বলছে, বন্যায় ১২ হাজার হেক্টর জমির ধানসহ অন্যান্য ফসলের ক্ষতি হয়েছে। ক্ষতির পরিমাণ ৮৬ কোটি ৬৬ লাখ ২২ হাজার টাকা। এছাড়া বন্যা ও জলাবদ্ধতায় জেলায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের সংখ্যা ৪৭ হাজার।
সরেজমিনে দেখা গেছে, বন্যা দুর্গত শাহরাস্তি, কচুয়া ও হাজীগঞ্জ উপজেলার যেসব গ্রামীণ পাকা সড়কে পানি উঠেছিল, পানি নেমে যাওযার পর সেখানে ভাঙনের চিহ্ন ফুটে উঠছে। সদর, হাইমচর ও ফরিদগঞ্জ উপজেলারও অধিকাংশ গ্রামীণ পাকা সড়ক দীর্ঘ একমাস পানির নিচে ছিল। ফলে সড়কগুলোর পাশের মাটি নরম হয়ে ভেঙে পড়ছে। সড়কের পাশে তৈরি হয়েছে বড় বড় গর্ত।
কচুয়া ও শাহরাস্তি উপজেলায় রোপা আউশ পানিতে নিচে তলিয়ে রয়েছে। কয়েকটি মাঠে রোপা আউশ দেখা গেলেও ধানের গোড়া পচে নুয়ে পড়েছে।
স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর চাঁদপুরের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আহসান কবির বলেন, “এবারের বন্যায় কচুয়া, শাহরাস্তি, হাজীগঞ্জ এবং অতিবৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা তৈরি হয়ে ফরিদগঞ্জ, সদর ও হাইমচর উপজেলায় ১৯২ সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
“এর মধ্যে সদরে ১২টি, হাইমচরে ১০টি, হাজীগঞ্জ ৪৫টি, কচুয়ায় ২২টি, শাহরাস্তিতে ৫৩টি ও ফরিদগঞ্জে ৫০টি সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এছাড়া ছয় উপজেলায় ৪৪টি কালভার্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।”
কচুয়া উপজেলার আশ্রাফপুর ইউনিয়নের পিপলকরা গ্রামের কৃষক শহীদ উল্লাহ বলেন, “বানের পানিতে রাস্তার পাশাপাশি আমাদের ফসলেরও ক্ষতি হয়েছে। গর্ত হওয়ার কারণে সড়কে যানবাহন চলাচল এখন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। ফলে দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা বেশি।”
শাহরাস্তি উপজেলার উনকিলা গ্রামের মনির হোসেন বলেন, “আমাদের এলাকায় বানের পানিতে বহু সড়ক তলিয়ে গেছে। এসব সড়ক ভেঙে এখন বড় বড় গর্ত তৈরি হয়েছে। তবে কিছু সড়ক আগ থেকে ভাঙা ছিল। এখন আরও বেড়েছে।”
সদর উপজেলার বালিয়া ইউনিয়নের ঢালীরঘাট-ফরক্কাবাদ সড়কের বাসিন্দা মফিজুল ইসলাম খান বলছিলেন, “টানা বৃষ্টিপাতের কারণে সড়ক যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তেমনি মাটি নরম হয়ে বড় বড় গাছ উল্টে পড়েছে। একটি গাছ উল্টে আমার ঘরের ওপরে পড়ে। প্রায় এক সপ্তাহ পার হলেও গাছটি কেউ কেটে সরিয়ে নেয়নি।”
ফরিদগঞ্জ উপজেলার মানিকরাজ গ্রামের মোক্তার হোসেন বলেন, “টানা বৃষ্টিতে সড়কের বিভিন্ন অংশ ভাঙন দেখা দিয়েছে। সড়কের পাশের অংশগুলো বেশি ভেঙেছে। কিছু এলাকায় গাছ উল্টে সড়কে বড় বড় গর্ত সৃষ্টি হয়েছে।”
বন্যার পানি এখনও পুরোপুরি নামেনি এবং জলাবদ্ধতাও রয়েছে জানিয়ে নির্বাহী প্রকৌশলী আহসান কবির বলেন, “আমরা গ্রামীণ সড়ক ও কালভার্টের ক্ষতির পরিমাণ এখনও চূড়ান্ত করিনি। প্রাথমিকভাবে প্রায় ৪০ কোটি টাকার ক্ষতির আশঙ্কা করছি।
“এই পরিমাণ আরও বাড়তে পারে। একই সঙ্গে আমরা এসব গুরুত্বপূর্ণ সড়ক ও কালভার্ট মেরামতের সম্ভব্য ব্যয় (প্রাক্কলন) তৈরী করছি। কিছু স্থানে মেরামত কাজ শুরু হয়েছে।”
এদিকে কুমিল্লা, ফেনী ও নোয়াখালী জেলার বানের পানিতে তলিয়ে গেছে চাঁদপুরের কচুয়া, শাহরাস্তি ও হাজীগঞ্জ উপজেলার অধিকাংশ ফসলি জমি। একই সময়ে টানা বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা তৈরি হয়ে ফরিদগঞ্জ, সদর ও হাইমচর উপজেলায় পান, আখ, রোপা আউশ ও আমনের বীজতলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
চাঁদপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক সাফায়েত আহম্মদ ছিদ্দিকী বলেন, “আমাদের মাঠ জরিপের তথ্য অনুযায়ী, বন্যা ও জলাবদ্ধতায় প্রায় জেলায় ৪৭ হাজার কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফসলের মধ্যে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মাঠে থাকা রোপা আউশ, আমন ও পান। পানিতে তলিয়ে ক্ষতি হয়েছে বীজতলা।
“জেলার ছয় উপজেলায় ১২ হাজার হেক্টর জমির ধানসহ অন্যান্য ফসলের ক্ষতির পরিমাণ ৮৬ কোটি ৬৬ লাখ ২২ হাজার টাকা। ইতোমধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের প্রণোদনা হিসেবে আমনের বীজ ও সার সরবরাহ শুরু করা হয়েছে।”
বন্যা দুর্গত কচুয়া ও শাহরাস্তি উপজেলার কয়েকটি এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, রোপা আউশ পানির নিচে তলিয়ে আছে। কয়েকটি মাঠে রোপা আউশ দেখা গেলেও ধানের গোড়া পচে নুয়ে পড়েছে।
জেলার সবচাইতে বেশি আখের আবাদ হয় ফরিদগঞ্জ ও সদর উপজেলায়। এই দুই উপজেলায় জলাবদ্ধতার কারণে ১২৮ হেক্টর জমির আখ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
ফরিদগঞ্জ উপজেলার মদনেরগাঁও গ্রামের কৃষক জসিম উদ্দিন বলেন, “জলাবদ্ধতার কারণে রোপান আমান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সেইসঙ্গে আখের জমিগুলো সব নুয়ে পড়েছে। এসব আখ বিক্রি কররেও দাম পাওয়া যাবে না।”
পাশের মানিকরাজ গ্রামের কৃষক মো. রহুল আমিন বলেন, “জলাবদ্ধতায় আমাদের বেশি ক্ষতি হয়েছে রোপা আমন ও বীজতলা। এ বছর আর রোপা আমন করা সম্ভব হবে না; কারণ সময় পার হয়ে গেছে।”
ফরিদগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কল্লোল কিশোর সরকার বলেছেন, “জলাবদ্ধতায় উপজেলায় প্রায় ১ হাজার হেক্টর জমির রোপা আউশ, আমন, আখ, বীজতলা ও অন্যান্য ফসলের ব্যপক ক্ষতি হয়েছে।
“আমরা কৃষকদের পরামর্শ দিচ্ছি, পানি নেমে গেলে বীনা জাতের বিআর-২২ ও ২৩ জাদের ধান আবাদ করে। কারণ খুব দ্রুত সময়ে এ ধানের ফলন হয়।”
শাহরাস্তি রায়শ্রী উত্তর ইউনিয়নের সীমান্ত এলাকা উনকিলা গ্রামের কৃষক কেরামত আলী বলেন, “আমার এক একর জমিতে আউশের আবাদ করা আছে। ধান কাটার সময় হয়েছে। কিন্তু এখন সবই শেষ। আমাদের এই ক্ষতির কি হবে বলতে পারছি না।”
একই এলাকার দুলাল নামে আরেক কৃষক বলেন, এ বছর তিনিও এক একর অধিক জমিতে রোপা আউশ আবাদ করেছেন। তার জমিগুলোও এখন পানিতে তলিয়ে রয়েছে। গাছের চিহ্নও দেখা যায় না। ঋণ করে টাকা নিয়ে জমিতে বিনিয়োগ করেছিলেন। এখন কী করে সেই টাকা শোধ করবেন তা ভেবে দিশেহারা পড়েছেন।
শাহরাস্তি উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আয়শা আক্তার বলেন, “উপজেলার বন্যা কবলিত ইউনিয়নের মাঠ জরিপে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত সাড়ে ৪ হাজার কৃষকের তথ্য পেয়েছি। রোপা আউশসহ বিভিন্ন ফসলে ৬ কোটি ৪০ লাখ ৫০ হাজার টাকার প্রাথমিক ক্ষতির আশঙ্কা করছি। ইতোমধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষদের মাঝে প্রণোদনা হিসেবে সার ও বীজ বিতরণ করা হয়েছে।”
এদিকে টানা বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা তৈরি হয়ে হাইমচর উপজেলার প্রায় ১০০ হেক্টর জমির পানের বরজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
এ উপজেলার উত্তর আলগী ইউনিয়নের মহজমপুর গ্রামের পান চাষী আবু তাহের বলেন, তিনি এ বছর ৪০ শতাংশ জমিতে প্রায় ১০ লাখ টাকা খরচ করে পানের বরজ করেছেন। টানা বৃষ্টিতে দুটি পানের বরজ তলিয়ে গেছে।
বরজের ভবিষ্যৎ কি হবে তাও বলতে পারছে না তিনি।
হাইমচর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. শাকিল খন্দকার বলেন, “উপজেলার ১১৯ হেক্টর জমিতে পানের আবাদ আছে। অতিবৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা তৈরি হয়ে প্রায় ১০০ হেক্টর জমির পান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পান চাষের সঙ্গে জড়িত আছে ১ হাজার ৭২ জন কৃষক। ক্ষতিগ্রস্ততের তালিকা তৈরি এবং ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ করে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়েছে।”
চাঁদপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক সাফায়েত আহম্মদ বলেন, “ইতোমধ্যে প্রায় সব উপজেলায় কৃষকদের মাঝে প্রণোদনা হিসেবে আমনের বীজ, সার ও নগদ অর্থ বিতরণ করা হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত সকল কৃষকদেরকে আমরা প্রণোদনার আওতায় আনার চেষ্টা করছি।”