বনটি প্রাণীদের ‘অভয়াশ্রম’ হয়ে উঠেছে; পাশাপাশি পাহাড়িদের চাষের জন্য আর সেচের পানির অভাবে পড়তে হচ্ছে না।
Published : 21 Mar 2025, 01:54 AM
সারাদেশে দখল আর ধ্বংসের বিপরীতে প্রাকৃতিক বন তৈরির প্রবণতা একেবারে নগণ্য হলেও খাগড়াছড়ির দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় স্থানীয়দের ভালবাসা আর বিহারের বিধি-নিষেধের কারণে শত একরের বনভূমি যুগের ব্যবধানে শত শত উদ্ভিদ আর প্রাণীর নিরাপদ আশ্রয়স্থলে পরিণত হয়েছে।
জেলা সদর থেকে ৭০ কিলোমিটার দূরে দীঘিনালা উপজেলার মেরুং ইউনিয়নে বড় কাঙড়াখাইয়ায় এই বন। সংরক্ষিত বনের পাশে পাহাড়ের কোলে চাকমাপ্রধান নৃগোষ্ঠীর বাসিন্দাদের বসবাস। তারা যুগ যুগ ধরে এই বনকে আশ্রয় করে বেঁচে আছেন।
এক যুগ আগে পাড়ার লোকজন মিলে সেখানে একটি বিহার তৈরি করেন। সেই বিহার থেকে নিয়ম করে দেওয়া হয়, অনুমতি ছাড়া কেউ এখানে গাছ কাটতে পারবে না। নিয়ম করে শুধু বাঁশ কাটা যাবে। আর প্রাণী হত্যা একেবারেই নিষিদ্ধ।
এই নির্দেশনা মেনে চলায় বনটি প্রাণীদের ‘অভয়াশ্রম’ হয়ে উঠেছে। পাশাপাশি পাহাড়িদের চাষের জন্য আর সেচের পানির অভাবে পড়তে হচ্ছে না। পাহাড়ের ঝিরিগুলো থেকে যখন পানি উধাও বা বিষাক্ত হয়ে যাচ্ছে- তখন এই ধরনের প্রাকৃতিক বনকে অনন্য দৃষ্টান্ত বলছে বনবিভাগ।
বন্যপ্রাণীর ছবি তুলতে গিয়ে দেখা গেছে, সেখানে প্রায় শত প্রজাতির প্রাণী আছে। যার বেশ কয়েকটি বিরল ও বিলুপ্তপ্রায়। শতায়ু গাছও আছে এই বনে।
খাগড়াছড়ির বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. ফরিদ মিঞা বলেন, “দীঘিনালার বগাপাড়া বিহার সংলগ্ন এলাকায় যে প্রাকৃতিক বন রয়েছে তা খুবই ব্যতিক্রমী এবং সম্ভাবনাময় একটি বন। কারণ, এই বনে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিলুপ্ত প্রায় বন্যপ্রাণী যেমন রয়েছে; তেমনি ঘন বন হওয়ার কারণে বনটা চিরসবুজ থাকে। বিশ্বের অনেক দেশে বার্ডিং বা পাখির ছবি তোলাকে কেন্দ্র করে পর্যটকদের আগমন ঘটে। পার্বত্য চট্টগ্রামে সে সম্ভাবনা রয়েছে।”
প্রাণ-বৈচিত্র্য
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার হিসাবে, বাংলাদেশে প্রতিবছর যে পরিমাণ বন উজাড় হয়; তা বৈশ্বিক গড় হারের প্রায় দ্বিগুণ। এখানে প্রতি বছর গড়ে প্রায় ৬৬ বর্গকিলোমিটার গ্রীষ্মমণ্ডলীয় রেইন ফরেস্ট ধ্বংস করা হয়।
আর বনবিভাগের হিসাবে, সারাদেশে এরই মধ্যে দখল হয়ে গেছে ২ লাখ ৮৭ হাজার ৪৫৩ একর বনভূমি। যার মধ্যে এক লাখ ৩৮ হাজার একর সংরক্ষিত বনভূমি।
পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত ‘পার্বত্য চট্টগ্রামে বিপন্ন প্রজাতির উদ্ভিদ’ গ্রন্থে বলা হয়েছে, দেশের সর্বমোট পাহাড়ি বনের ৯০ শতাংশই পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলায়। এ ছাড়া মোট জীববৈচিত্র্যের ৮০ শতাংশই পাহাড়ে বিদ্যমান।
এই বনে দেখা মিলেছে লাল উড়ন্ত কাঠবিড়ালী বা ‘ছলক’ এর। সাম্প্রতিককালে এই বন ছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামের আর কোনো বনে এ প্রাণীর দেখা মেলেনি। রয়েছে মুখপোড়া হনুমান, মায়া হরিণ, বন্য শুকর, কালো কাঠবিড়ালী।
বাংলাদেশে যত প্রজাতির হরিয়াল রয়েছে, তার সবই এই প্রাকৃতিক বনে পাওয়া গেছে। সবশেষ দেখা মিলেছে গেঁজলেজ হরিয়ালের। হবিগঞ্জের সাতছড়ি বন এবং বান্দরবানের পর খাগড়াছড়ির এই বনে এই প্রজাতির হরিয়াল দেখা গেছে।
বনে দুর্লভ লাল মাথা কুচুকুচি, পাকড়া ধনেশ, জলপাই বুলবুল, বন মোরগ, সবুজ ঘুঘু, কালো মাথা বুলবুল, কালো মথুরা, বড় কাবাসি, পাহাড়ি ময়না, এশীয় দাগী প্যাঁচা, কমলা বুক হরিয়াল, ল্যাঞ্জা হরিয়াল, এশীয় নীল পরী, ঠোঁট মোটা হরিয়াল, ছোট হরিয়াল, নীল দাঁড়ি সুইচোরা, সিঁদুরে মৌটুসি, ইন্ডিয়ান রোলার, বন কোকিলের জাত পাওয়া গেছে।
একই রকম বৈচিত্র্য রয়েছে উদ্ভিদ বা গাছের ক্ষেত্রেও। মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে এক একটি শতবর্ষী গাছ। তার শরীর বেয়ে নেমে আসে সূর্যের আলো। এসব গাছ বন্যপ্রাণীদের আশ্রয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
শতবর্ষী ভাদি, ফুলশুমারী, কড়ই, বিশাল আকারের বন শিমুল, সোনালু, চাপালিশ, নাইচিচা উদাল, ফাইশ্যা উদাল, অশ্বত্থ, কামালা ফল, মেহগনি, বড় ডুমুর, গর্জন, চিকরাশি, ঢেউয়া, বাজনা, মান্দার, নাগেশ্বরসহ অনেক গাছ এখানে টিকে আছে।
স্থানীয় গ্রামবাসীর সহায়তায় বনটি এখনো অক্ষত রয়েছে বলে জানান গ্রামের বয়োজ্যেষ্ঠ বাসিন্দা জ্ঞানপূর্ণ চাকমা।
তিনি বলছিলেন, পাকা সড়ক থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরে বনটিতে সাধারণত কোনো গাছপালা কাটা হয় না। কয়েক বছর পর পর বাঁশ বিক্রি করা হয়। বাঁশ বিক্রি করার পর পুনরায় প্রাকৃতিকভাবে বাঁশ বাগান গড়ে ওঠে।
“এ ছাড়া আমরা ওই এলাকায় শিকার সর্ম্পূণভাবে নিষিদ্ধ করেছি। ফলে পাখি বা অন্যান্য বন্যপ্রাণী সেখানে বিচরণ করতে পারে। বিহার এলাকার আশপাশে গ্রামে শিকার করলেও একশ একরের এই বনের ভেতরে কেউ শিকার করেন না।”
আকৃতি চাকমা বলেন, গ্রামের মানুষ মিলে ২০১৩ সালে সেখানে ওই বিহার গড়ে তোলে। বিহারের আশপাশের অনেকগুলো পাহাড় নিয়ে প্রায় শত একরের বন। বৃক্ষগুলো বেশিরভাগই শতবর্ষী। এখানে সেগুন, গামারি বা বিদেশি প্রজাতির বৃক্ষ নেই। প্রাকৃতিকভাবে গড়ে ওঠায় বনটি সারা বছরই চিরসবুজ থাকে। শুষ্ক মৌসুমেও পুরো বিহার এলাকাটি থাকে ঘনসবুজে মোড়ানো।
রবি রঞ্জন চাকমা বলেন, সারা বছরই বিভিন্ন প্রজাতির পাখির দেখা মেলে এখানে। পুরো বনাঞ্চলটি জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ হয়ে ওঠেছে।
চলতি বছর আত্মপ্রকাশ করা বায়োডারভার্সিটি কনজারভেশন সোসাইটি অব সিএইচটির সংগঠক এবং শৌখিন আলোকচিত্রী সবুজ চাকমা বলেন, পার্বত্য যত প্রজাতির পাখি রয়েছে তার কয়েকটি ছাড়া বেশির ভাগই এই বনে রয়েছে। তার মূল কারণ হচ্ছে বৃক্ষের বৈচিত্র্য। কারণ সারা বছরই এখানে পাখি তাদের খাবার পায় এবং বড় বৃক্ষ থাকায় কোটরে বাসা বাঁধে।
“প্রাকৃতিক বনের পাশাপাশি এখানে কয়েক বছর আগে নতুন করে স্বর্ণচাপা গাছের চারা রোপণ করা হয়েছে। সেসব গাছে ফলও ধরা শুরু হয়েছে। তাছাড়া এখানে লাল উড়ন্ত কাঠবিড়ালীর দেখা পাওয়া গেছে। এটি খুবই দুর্লভ প্রাণী। অনুকূল পরিবেশ থাকায় বনে এ ধরনের প্রাণী এখনো টিকে আছে। এটা আমাদের জীববৈচিত্র্যের জন্য ভালো দিক। পাহাড়ের বনগুলো সংরক্ষণ করা গেলে জীববৈচিত্র্য সুরক্ষিত হবে।”
ঝিরি ও জল
দখল আর বন সৃজন করতে গিয়েও পাহাড়ের অনেক ঝিরি হারিয়ে গেছে। পাহাড়ের এই ঝিরির জলই স্থানীয় মানুষের চাষ ও গৃহস্থালী কাজের অন্যতম উৎস। দুর্গম পাহাড়ের মানুষের কাছে পানি সংকটের আরেক নাম। কিন্তু বড় কাঙড়াখাইয়া বন ব্যতিক্রম।
গ্রামের বাসিন্দা প্রিয়শংকর চাকমা বলছিলেন, বনটি থাকায় পাহাড়ের নিচের ঝিরিগুলোতে শুষ্ক মৌসুমের পানির প্রবাহ থাকে। যেসব পাহাড়ে সেগুন বাগান রয়েছে সেসব পাহাড়ের নিচে ঝিরিগুলো এই সময়ে মৃতপ্রায়।
“কিন্ত এখানে বন অক্ষত থাকায় ঝিরিগুলোতে সারাবছর প্রাণ থাকে। আর বিভিন্ন প্রজাতির বৃক্ষ থাকার কারণে এই বনটি আশপাশের এলাকা থেকে একেবারে ভিন্ন। বিভিন্ন ধরনের প্রাণী হরহামেশা দেখা যায়। কারণ, পাখিরা এখানে পানি পায়।”
ঝিরিতে পানি না থাকার কারণে পাহাড়ের নিচে ধানি জমিতে শুষ্ক মৌসুমে চাষাবাদে সেচ কাজ ব্যাহত হয়। গ্রামের কৃষক রিপন চাকমা বলেন, “আমাদের গ্রামের সব জমিতে শুষ্ক মৌসুমে চাষাবাদ হয়। পাহাড়ের পাদদেশে অন্তত ১০ একরের বেশি জমি আছে। ঝিরিতে পানি থাকার কারণে সেই পানি আমরা সেচের কাজে ব্যবহার করি।”
সুকৃতি চাকমা বলেন, “বনের ঝিরিতে সারা বছরই পানি থাকে। এমনকি বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসেও পাড়ার বনের ভেতরের ঝিরিতে পানির প্রবাহ স্বাভাবিক থাকে। এটা আমরা সেচের কাজে লাগাই।"
‘সে গুণ নেই সেগুনের’
বড় কাঙড়াখাইয়া বনের আশপাশে বেশ কয়েকটি সেগুন বাগান রয়েছে। বন বিভাগের কর্মকর্তারাও বলছেন, সেগুন পরিবেশগত দিক থেকে উপকারী গাছ নয়; বরং এটি বনের ভারসাম্য নষ্ট করে। প্রাকৃতিক বনের উদ্ভিদ যেভাবে বনের ভারসাম্য রক্ষা করে, সেগুনের সেই গুণ নেই। সেগুন প্রচুর পানি টানে; ফলে সেগুন বাগান সংলগ্ন ঝিরিতে পানির প্রবাহ কম বা একেবারেই নেই।
গ্রামের বাসিন্দা সুমিত্র চাকমা বলেন, “প্রাকৃতিক বনের সুফল এখানকার মানুষ পাচ্ছে। তবে এই বনে প্রবেশের আগে বেশ কিছু সেগুন বাগান রয়েছে। সেখানের ঝিরিগুলো শুকনো, পানির প্রবাহ নেই।”
সেগুন পাহাড়ের পানি শোষণ করে ফেলে জানিয়ে তিনি বলেন, “অনেকে বাণিজ্যিক কারণে লাভের আশায় সেগুন লাগালেও প্রকৃতির ক্ষতি হয়েছে। গ্রামের মানুষ প্রাকৃতিক বনের গুরুত্ব উপলব্ধি করার পর থেকে বিহার সংলগ্ন এলাকার শত একরের পাহাড়ি বন থেকে কোনো গাছ কর্তন করা হয় না।"
প্রাকৃতিক বন রক্ষা ও সংরক্ষণের ওপর জোর দিয়েছেন খাগড়াছড়ির বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. ফরিদ মিঞা।
তিনি বলেন, বন মানে শুধু গাছপালা বা বড় বড় বৃক্ষ নয়। বনের উদ্ভিদের পাশাপাশি সেখানে বন্যপ্রাণীও থাকতে হবে। সবটা নিয়েই বন। পাখিসহ বন্যপ্রাণী বনায়নে সহায়তা করে।
“চির সবুজ প্রজাতি এবং পাখি ও প্রাণীর খাবার উপযোগী প্রচুর গাছ লাগানো উচিত। সেগুন প্রকৃতির জন্য উপকারী নয়। প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় এসব প্রজাতি অবদান রাখতে পারে না। এ প্রজাতিগুলো ধীরে ধীরে কমাতে হবে। প্রকৃতিতে অবদান রাখে না এমন প্রজাতি দিয়ে বনায়ন করা যাবে না।”