“আমাগো কোনো ঈদ আর উৎসব নাই; বছর ভইরাই ব্যস্ততা থাকে”, বলেন শ্রমিক আলমগীর।
Published : 13 Apr 2023, 09:10 AM
তপ্ত গরমে উদোম গায়ে তাঁত চালাচ্ছেন কারিগররা। হাতের সুনিপুন দক্ষতায় সুতো চালিয়ে জামদানি কাপড়ে ফুটিয়ে তুলছেন নানা নকশা। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত চলে এই কর্মযজ্ঞ।
তবে ঈদকে সামনে রেখে নারায়ণগঞ্জের জামদানি পল্লীর তাঁত ঘরগুলোতে কারিগরদের ব্যস্ততা দেখা গেলেও জামদানি শাড়ি বিক্রেতারা বলছেন ভিন্ন কথা।
তাদের দাবি, ঈদের মৌসুমে এবার আশানুরূপ ক্রেতার দেখা মিলছে না। উৎসব ছাড়াও জামদানি পল্লীতে ভালো বিক্রি হয়। কিন্তু এবার পহেলা বৈশাখ ও ঈদের মতো উৎসব সামনে থাকলেও ক্রেতাদের তেমন সাড়া মিলছে না এখনও।
রাজধানী ঢাকা থেকে মাত্র ৩০ কিলোমিটার দূরে শীতলক্ষ্যার তীর ঘেঁষে রূপগঞ্জ উপজেলার নোয়াপাড়া গ্রামে অবস্থান এই জামদানি পল্লীর। ঢাকাই মসলিনের হাত ধরে জামদানির আগমন ঘটে এই অঞ্চলে। জামদানি শিল্পকে অগ্রসর করার জন্য বিংশ শতাব্দীর শুরুতে ২০ একর জমির উপর বিসিকের জামদানি শিল্পনগর কার্যক্রম শুরু হয়। যার উদ্যোগ নেওয়া হয় নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিকেই।
বিসিকের জামদানি শিল্পনগরীর কর্মকর্তা বায়েজিদ হোসেন বলেন, পুরো শিল্পনগরীতে ৪০৭টা প্লট আছে। প্রতি প্লটে অন্তত চারটা করে তাঁত আছে। এখানে প্রায় এক হাজার ৬০০ তাঁতী নিয়মিত জামদানি শাড়ি তৈরি করেন। প্রতি সপ্তাহে শুক্রবার সকালে পল্লীতে হাট বসে। এই হাটে সারাদেশের বিপুল ক্রেতা-বিক্রেতার সমাগম ঘটে।
জামদানি পল্লীর ২ নম্বর গলির ৩৩ নম্বর প্লটে ১১টি তাঁত আছে সেলিম হোসেনের। এক সময় নিজে জামদানির কারিগর ছিলেন। এখন কারিগর খাটিয়ে শাড়ি তৈরি করে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করেন।
মঙ্গলবার দুপুরে সেলিমের তাঁত ঘরে কারিগরদের ব্যস্ততা দেখা যায়। কথা হয় কয়েকজন কারিগরের সঙ্গে। কথা বলতে বলতেই শাড়ি বোনার কাজ চলছিল তাদের।
কিশোরগঞ্জ জেলার ২৯ বছর বয়সী মো. আলমগীর ১০ বছর বয়স থেকে জামদানি শাড়ি তৈরির কাজ করেন। এখন তার তিন ভাইও জামদানির কারিগর। এই জামদানি পল্লীতেই কাজ করেন তারা। সকাল ৭টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত শাড়ি বুনে সপ্তাহান্তে পান ছয় হাজার টাকা।
আলমগীর বলেন, “আমাগো কোনো ঈদ আর উৎসব নাই। বছর ভইরাই ব্যস্ততা থাকে। দুপুরে একবার খাওনের সময় ছাড়া বাকি সময় একটানা তাঁতে বইসা কাপড় বুনি। কষ্ট হিসাবে মজুরি কম। তারপরও এই এক কামই শিখছি, এইটাই করি।”
তাঁতী ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, সুতার কাউন্ট অনুযায়ী জামদানির মান ও দাম নির্ধারিত হয়। কাউন্ট যত বেশি সুতা তত চিকন এবং সেই সুতার তৈরি শাড়ির দামও তত বেশি। এই পল্লীতে ৩০ থেকে ১০০ কাউন্টের জামদানি তৈরি হয়। জামদানি শাড়ি ছাড়াও পুরুষদের পাঞ্জাবি ও নারীদের থ্রি-পিছও বিক্রি হয় এখানে।
১০০ কাউন্টের সুতা দিয়ে আইয়ুব আলীর তাঁত ঘরে শাড়ি বুনছিলেন মো. শাহ্জাহান নামে এক কারিগর।
তিনি বলেন, “১৯৮৮ সাল থেইকা জামদানি বুনি। একটা শাড়ি বুনতে এক সপ্তাহ সময় লাগে আবার এক বছরও সময় লাগে। ১০০ কাউন্টের একটা শাড়ি বুনতে অন্তত এক মাস লাগে। আমাদের কোনো বিশ্রাম নাই। মহাজনের কাছে সারা বছরই অর্ডার থাকে, তাই সারা বছরই কাম।“
তাঁতীদের ব্যস্ততা দেখা গেলেও পল্লীর জামদানি শাড়ি বিক্রির দোকানগুলোতে একেবারেই ভিন্ন চিত্র দেখা গেছে।
জামদানির বিক্রেতারা বলছেন, পহেলা বৈশাখ ও ঈদ- বড় এই দুই উৎসব সামনে থাকলেও আশানুরূপ বিক্রি নেই। বরং অন্যান্য সময়গুলোতেও এর চেয়ে ভালো বিক্রি থাকে বলে দাবি তাদের।
তবে বিক্রি কেন কম তার সঠিক কারণ ধরতে পারছেন না ব্যবসায়ীরা। তবে কেউ কেউ বলছেন, দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য বাড়ার কারণে মানুষের আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হয়ে গেছে। ‘মানুষের পকেটে টাকা কম থাকায়’ তারা বিলাসী পণ্য কেনা থেকে বিরত থাকছেন।
হাজী আলী আজগর উইভিং ফ্যাক্টরির সত্ত্বাধিকারী আলী আজগর বলেন, “হঠাৎ কইরা রোজার মাসে ব্যবসা খারাপ। এক বঙ্গ নাকি পুড়ছে, তাগোর কাছে মাল নাই। আর আমাদের কাছে মাল থাকতেও বিক্রি নাই। রোজার মাসে এত খারাপ ব্যবসা কখনও ছিল না। করোনাভাইরাসের সময়ও এরচেয়ে ভালো ব্যবসা ছিল।“
বিক্রি কম দাবি মো. শাহীনেরও। জামদানি পল্লীর প্রবেশমুখেই তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সাফওয়ান জামদানি উইভিং ফ্যাক্টরি। তার নিজেরই ১২টি তাঁত আছে। এ ছাড়া অন্য তাঁতীদের কাছ থেকেও শাড়ি কেনেন। সর্বনিম্ন চার হাজার টাকা থেকে দেড় লাখ টাকা পর্যন্ত একটি শাড়ি বিক্রি করেন শাহীন।
তিনি বলেন, “মাসে অন্তত ১৫ লাখ টাকার বেচাকেনা হয়। ঈদ এলে তা বেড়ে মিনিমাম ২৫ লাখে ওঠে। কিন্তু এইবার ঈদের বাজার খারাপ। এখন পর্যন্ত ৫-৭ লাখ টাকার বিক্রি হইছে। সবকিছুর দাম বাড়তি, আয়ের চেয়ে ব্যয় বেড়ে গেছে। মানুষের পকেটে টাকা কম। তাই জামদানির মতো শৌখিন জিনিস কেনা থেকে হয়তো তারা বিরত থাকছেন।”
“তাও আশা করতেছি, রোজার তো আরও কয়টা দিন বাকি আছে। তখন হয়তো বিক্রি বাড়বো।”
পল্লীতে থাকা নিজের দোকানের পাশাপাশি অনলাইনেও জামদানি বিক্রি করেন ব্যবসায়ী আমিনুল ইসলাম রবিন। ‘অফলাইন ও অনলাইন’ উভয় স্থানেই বিক্রি কম বলে জানান তিনি।
রবিন বলেন, “জামদানি শাড়ি পড়েন বিলাসী লোকজন। তাদের তো আর টাকার কমতি নাই। তারপরও কেন যে বিক্রি কম বুঝতে পারতেছি না। হইতে পারে তারাও হিসাব কইরা খরচ করতেছেন।”
তবে তাঁতী সেলিম হোসেন বলেন, “পল্লীতে যাদের দোকান আছে তাদের সরাসরি খুচরা ক্রেতার কাছে বিক্রি করতে হয় বলে ঘাটতির কথা বলছেন। তবে আমাদের নিয়মিত পার্টির অর্ডার থাকে, বছরজুড়েই আমাদের বেচাকেনা ভালোই চলে।”
বিসিকের জামদানি শিল্পনগরী কর্মকর্তা বায়েজিদ হোসেন বলেন, “ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধসহ নানা কারণে বৈশ্বিক অর্থনীতি কিছুটা নাজুক অবস্থাতে আছে। এর প্রভাব আমাদের দেশেও রয়েছে। এই কারণে হয়তো বেচাকেনা অন্যান্যবারের চেয়ে কিছুটা কম। তবে জামদানি ও জামদানি কারিগরদের উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে বিসিক। আমাদের সর্বাত্মক সহযোগিতা তাদের জন্য রয়েছে।”