অনেকে মনে করছেন, নারী ভোটাররা জয়-পরাজের ক্ষেত্রে বড় ধরনের ‘ফ্যাক্টর’ হয়ে দাঁড়াতে পারেন।
Published : 05 Mar 2024, 08:01 AM
কুমিল্লা সিটি করপোরেশনে নারী ভোটারের সংখ্যা বেশি; তবে তাদের দাবি-দাওয়া নিয়ে প্রার্থীরা কম কথা বলছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
নারী ভোটাররা বলছেন, নগরীর অনেক জায়গাতেই নারীদের জন্য আলাদা কোনো শৌচাগার নেই, রাতে প্রতিনিয়ত নারীরা ছিনতাইয়ের কবলে পড়ছেন, শহরে কিশোর অপরাধ বেড়ে গেছে যার শিকার হচ্ছেন নারীরা, শিশুদের জন্য সেই খেলার মাঠ বা বিনোদন কেন্দ্র- কিন্তু এসব নিয়ে প্রার্থীরা খুব বেশি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন না। অথচ একটি আদর্শ নগরী ‘নারীবান্ধব’ হওয়াই বাঞ্ছনীয়।
অপরদিকে প্রার্থীরা বলেছেন, নারীদের সমান অধিকারের বিষয়ে তারা সচেতন। নির্বাচিত হলে নারী ও শিশুদের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে আগামী দিনের কুমিল্লা নগরীকে পরিকল্পিতভাবে সাজানো হবে।
আগামী ৯ মার্চ কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের মেয়র পদের উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। নির্বাচনে যে চার প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন তার মধ্যে কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক চিকিৎসক তাহসিন বাহার সূচনা রয়েছেন।
অন্য তিন প্রার্থী হলেন- দুইবারের সাবেক মেয়র ও বিএনপির সাবেক নেতা মনিরুল হক সাক্কু, মহানগর স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক সভাপতি নিজাম উদ্দিন কায়সার এবং মহানগর আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা এবং কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের সাবেক ভিপি নুর-উর রহমান মাহমুদ তানিম।
এই উপনির্বাচনের প্রচার এখন তুঙ্গে। দম ফেলার সময়ও পাচ্ছেন না প্রার্থীরা। ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত তারা কড়া নাড়ছেন ভোটারদের দরজায়। ছুটছেন বাড়ি-বাড়ি। করছেন উঠান বৈঠক।
বিশেষ করে নারীদের মন জয় করতে প্রার্থীরা পরিবারের মা-বোনদের মাধ্যমে প্রচার চালাচ্ছেন। তারাই ঘরে ঘরে গিয়ে নারীদের কাছে নানা প্রতিশ্রুতির কথা তুলে ধরছেন। অনেকে মনে করছেন, নারী ভোটাররা জয়-পরাজের ক্ষেত্রে বড় ধরনের ‘ফ্যাক্টর’ হয়ে দাঁড়াতে পারেন।
তবে নারী ভোটারদের ভাষ্য, প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরিতে তাদের মন ভরবে না। তারা কুমিল্লাকে নারীবান্ধব নগরীতে পরিণত করতে পারবেন- এমন ব্যক্তিকেই ভোট দেবেন। পাশাপাশি অনেক নারী ভোটার শঙ্কায় রয়েছেন সুষ্ঠু ভোটের পরিবেশ নিয়ে।
নির্বাচন কমিশনের তথ্যমতে, ২০১১ সালে কুমিল্লা সিটি করপোরেশন প্রতিষ্ঠার পর থেকে এখন পর্যন্ত তিনটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রতিটি নির্বাচনেই নারী ভোটারের সংখ্যা ছিলো বেশি।
এবারের উপনির্বাচনে মোট ভোটার সংখ্যা ২ লাখ ৪২ হাজার ৪৫৮। এর মধ্যে নারী ভোটার ১ লাখ ২৪ হাজার ২৭৪ এবং পুরুষ ভোটার ১ লাখ ১৮ হাজার ১৮২ জন। তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার রয়েছেন দুইজন। পুরুষের চেয়ে নারী ভোটার ৬ হাজার ৯২ জন বেশি।
২০২২ সালের ১৫ জুন অনুষ্ঠিত তৃতীয় নির্বাচনে মোট ভোটার সংখ্যা ছিল ২ লাখ ২৯ হাজার ৯২০। এর মধ্যে নারী ভোটার ১ লাখ ১৭ হাজার ৯২ জন এবং পুরুষ ভোটার ১ লাখ ১২ হাজার ৮২৬ জন। হিজড়া ভোটার দুজন।
২০১৭ সালের দ্বিতীয় নির্বাচনে ভোটার সংখ্যা ছিল ২ লাখ ৭ হাজার ৫৬৬। এর মধ্যে পুরুষ ১ লাখ ২ হাজার ৪৪৭ এবং নারী ১ লাখ ৫ হাজার ১১৯ জন।
আর ২০১২ সালের নির্বাচনে ভোটার সংখ্যা ছিল ১ লাখ ৬৯ হাজার ২৭৯। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ৮৩ হাজার ২০১ ও নারী ভোটার ৮৬ হাজার ৭৮ জন।
যা বলছেন নারী ভোটাররা
নগরীর হাউজিং এলাকার গৃহিনী রোজিনা বেগম বলেন, “নারীদের চলাচলে প্রায়ই বিভিন্ন সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। নগরীর প্রাণকেন্দ্র কান্দিরপাড়ে কোনো পাবলিক টয়লেট নেই নারীদের জন্য। জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে নারীরা নগরীতে এলে তাদের বিড়ম্বনায় পড়তে হয়।
“আমরা নারীবান্ধব একটি আধুনিক নগরী চাই। সেখানে নারীদের জন্য সব সুযোগ-সুবিধা থাকবে। যিনি সেটি করতে পারবেন- এমন ব্যক্তিকেই আমরা ভোট দেব।”
নগরীতে শিশুদের জন্য তেমন কোনো খেলার মাঠ নেই, নেই তেমন কোনো বিনোদন কেন্দ্রও- এমন অভিযোগ টমছম ব্রিজ এলাকার বাসিন্দা বিলকিস আক্তারের।
তিনি বলছিলেন, “এ কারণে শিশু-কিশোররা অনেক সময় বিপদগামী হয়ে পড়ছে। এসব সমস্যা সমাধান করতে পারবেন, এমন ব্যক্তিকে মেয়র নির্বাচিত করতে চাই।”
দক্ষিণ চর্থা এলাকার বাসিন্দা সালমা আক্তারের অভিযোগ, নারীদের আলাদাভাবে কর্মসংস্থানের ব্যাপারে বিগত দিনে জনপ্রতিনিধিরা তেমন কোনো উদ্যোগ নেয়নি।
“এবার প্রার্থীরা বলছেন- নারীদের জন্য বিভিন্নভাবে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করবেন। তবে আমরা প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরি না, আমাদের জন্য কাজ করবেন এমন ব্যক্তিকে মেয়রের আসনে দেখতে চাই”, বলেন সালমা আক্তার।
রানীর বাজার এলাকার বাসিন্দা পারভীন আক্তার বলেন, “সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কুমিল্লা নগরীতে ছিনতাইকারী ও কিশোর অপরাধীদের প্রবণতা বেড়েছে। রাতে প্রায়ই নারীরা ছিনতাইকারীদের কবলে পড়েছেন।
“আমরা রাজনীতি বুঝি না; আমরা নিরাপদ কুমিল্লা চাই। যিনি নারীদের জন্য নিরাপদ কুমিল্লা গড়তে পারবেন, এমন ব্যক্তিকেই আমরা নির্বাচিত করতে চাই।”
প্রতিবছর নির্বাচন এলেই মেয়র-কাউন্সিলর প্রার্থীরা নারীদের কল্যাণে কাজ করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দেন; কিন্তু নির্বাচনের পর সব ভুলে যান বলে অভিযোগ করেছেন নগরীর ছোটরা এলাকার বাসিন্দা জান্নাতুল ফেরদৌস।
তিনি বলেন, “এবার আমরাও কাকে ভোট দেব, আগে বুঝে তারপর সিদ্ধান্ত নেব। গত নির্বাচনেও নারীদের জন্য অনেক প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে- কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি।”
কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী মিম আক্তার বলেন, “এটাই আমার জীবনের প্রথম ভোট। আমরা মাদক ও সন্ত্রাসমুক্ত কুমিল্লা চাই। চাই আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর কুমিল্লা। এজন্য যিনি কাজ করতে পারবেন, তাকেই আমরা ভোট দিতে চাই।”
প্রার্থীরা যা বলছেন
মেয়র পদের উপনির্বাচনে এবার অংশ নেওয়া চার প্রার্থীর মধ্যে একজন নারী। বাস প্রতীক নিয়ে কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক তাহসিন বাহার সূচনা লড়াই করছেন। তিনি কুমিল্লা সদর আসনের সংসদ সদস্য ও মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহারের মেয়ে।
নারী হওয়ায় ভোটের মাঠে নারীদের কাছে বাড়তি সমর্থন পাচ্ছেন জানিয়ে তাহসিন বাহার সূচনা বলেন, “প্রচারের শুরু থেকেই যেখানে যাচ্ছি সেখানে নারী ভোটারদের অভূতপূর্ব সাড়া পাচ্ছি। আমি একজন চিকিৎসক। আমি নির্বাচিত হলে নারীদের স্বাস্থ্যসেবায় গুরুত্ব দেব। নারীদের কথা শুনার জন্য আলাদা কক্ষের ব্যবস্থা করব।
“নারীদের জন্য ‘নারীবান্ধব’ কুমিল্লা শহর গড়তে চাই। নারী ও তরুণ ভোটারদের জন্য আমার বার্তা হচ্ছে, এবারের ভোটটা অবশ্যই যেন উন্নয়নের পক্ষে বাস মার্কায় হয়। কুমিল্লার উন্নয়নের নতুন অধ্যায় সূচনা করতে চাই আমি।”
সূচনা বলেন, “কুমিল্লার মানুষের সমস্যাগুলো আমার জানা আছে। নির্বাচিত হলে একটা পরিকল্পিত সুন্দর নগরী গড়ে তুলব। অবশ্যই সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করব।”
বিএনপিপন্থি টেবিল ঘড়ি প্রতীকের প্রার্থী মনিরুল হক সাক্কু সিটি করপোরেশনের প্রথম দুটি নির্বাচনে মেয়র পদে নির্বাচিত হন।
এবারের নির্বাচনে নারীদের জন্য প্রতিশ্রুতি কী- জানতে চাইলে বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত সাক্কু বলেন, “আমার কাছে নারী-পুরুষ সমান। কারণ তাদের সমান অধিকার রয়েছে। আমি মেয়র থাকাকালে চেষ্টা করেছি নারীদের জন্য বিভিন্ন কাজ করাসহ নারীবান্ধব নগরী গড়তে।
“আমি বিগত সময়ে নারীদের জন্য ক্ষুদ্র ঋণের ব্যবস্থা করেছি, বিভিন্ন এনজিওর মাধ্যমে নারীদের জন্য উন্নয়নমূলক কাজ করেছি, সেলাই প্রশিক্ষণসহ বিভিন্ন প্রকল্প নিয়েছি তাদের জন্য। কুমিল্লার নারীরা সচেতন। আশা করছি, তারা অতীতের মতই আমার পাশে থাকবেন। এবার নির্বাচিত হলে নারীদের কল্যাণে যা করার দরকার তাই করব।”
ঘোড়া প্রতীকের প্রার্থী কুমিল্লা মহানগর স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক সভাপতি নিজাম উদ্দিন কায়সার বলেন, “বিগত সময়ে নারীদের জন্য যেসব প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে, সেগুলো বাস্তবায়িত হয়নি। আমি নির্বাচিত হলে ই-কমার্সে নারী উদ্যোক্তা তৈরি করার জন্য কাজ করব। প্রতিটি ওয়ার্ডে নারীদের জন্য একটি ওয়াইফাই জোন থাকবে। সেখান থেকে নারীরা তাদের ই-কমার্সের কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবেন।
“স্বাস্থ্য সেবাসহ সব ক্ষেত্রে নারীদের জন্য কল্যাণকর নগরী গড়ব। আমি অতীতের মেয়রদের মত নারীদের বঞ্চিত করব না। যেখানেই যাচ্ছি নারী ভোটারদের ব্যাপক সাড়া পাচ্ছি। তারাও এখন পরিবর্তনের পক্ষে, ঘোড়া মার্কার পক্ষে কাজ করছেন”, বলেন কায়সার।
হাতি প্রতীকের প্রার্থী কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা এবং কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের সাবেক ভিপি নুর-উর রহমান মাহমুদ তানিম বলেন, “আমি নির্বাচিত হলে নারীদের স্বাবলম্বী করে তুলব। নারীরা যেন স্বাবলম্বী হতে পারে- এমন বেশ কিছু প্রকল্প আমি গ্রহণ করব। যাতে করে নারীরা হস্তশিল্প থেকে শুরু করে আধুনিক যেকোনো প্রযুক্তিগত শিক্ষা- বিশেষ করে কম্পিউটার, আউটসোর্সিংয়ে নারী যুক্ত হতে পারে।
তিনি বলেন, “এ ছাড়া নারীরা যেন দক্ষতার সঙ্গে কাজ করতে পারেন- এমন আরও বেশ কিছু প্রকল্প নেওয়া হবে সিটি করপোরেশন থেকে। আর কুমিল্লাকে অবশ্যই ‘নারীবান্ধব’ সিটিতে পরিণত করব।”